ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

মত-মতান্তর

শেখ মুজিবুর রহমান: পাকিস্তানের নেমেসিস

দীপাঞ্জন রায় চৌধুরী

(২ বছর আগে) ১৯ এপ্রিল ২০২২, মঙ্গলবার, ৩:২২ অপরাহ্ন

mzamin

পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে পশ্চিম পাকিস্তানের নিপীড়ন থেকে মুক্ত করার জন্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রতীক, জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তার অগ্রণী ভূমিকার জন্য তিনি ‘জাতির জনক’ হিসাবে আখ্যায়িত, ‘বঙ্গবন্ধু’ সম্মানসূচক উপাধিতে বিশ্বজুড়ে তিনি সম্মানিত। আজ বৃহস্পতিবার (১৭ মার্চ) তার ১০১তম জন্মবার্ষিকী পালিত হচ্ছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি নিজগুণে বাংলাদেশের একজন গণমানুষের নেতা হয়ে উঠেছিলেন। ১৯৫৩ সালে তিনি গোপালগঞ্জের নির্বাচনী এলাকা থেকে পূর্ব বাংলার আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর, বাঙালি জাতি এবং মাতৃভাষা বাংলার জন্য যে অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তার কারণেই তিনি বাংলার কিংবদন্তি হয়ে উঠেছিলেন।
আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হওয়ার পর এবং পরবর্তীকালে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের অন্যায় এবং বৈষম্যমূলক নীতির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করার মাধ্যমে তিনি হয়ে উঠেছিলেন সবার প্রিয়। অন্যায়ের প্রতিবাদের জন্য তাকে ভোগ করতে হয়েছিল সীমাহীন কারাবাস। ১৯৫০ এবং ৬০ এর দশকে তিনি পূর্ব পাকিস্তানিদের স্বায়ত্তশাসনের জন্য ‘ছয় দফা আন্দোলন’র নেতৃত্ব দেন। পরে আগরতলা মামলা, ছাত্রদের এগারো দফা আন্দোলনে তিনি বছরের পর বছর কারাভোগ করেছেন।

 

ততক্ষণ তিনি অনড় ছিলেন, যতক্ষণ না স্বায়ত্তশাসন অর্জনের জন্য বাঙালির গণআন্দোলন পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষকে নির্বাচন করতে এবং বাংলার অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে তাকে মুক্তি দিতে বাধ্য করে।
পরবর্তীতে ১৯৭০ সালে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনে, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ জাতীয় আইনসভার প্রায় সবকটি আসনে জয়লাভ করে এবং পাকিস্তানে সরকার গঠনের অবস্থানে উঠে আসে। ঠিক তখনই দ্বিতীয় বৃহত্তম দলের পরাজিত নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানকে নিয়ন্ত্রণকারী সামরিক একনায়কতন্ত্রের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে জাতীয় পরিষদের উদ্বোধন স্থগিত করেন।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে আসে সেই মহান দিন, ১৯৭১ এর ৭ মার্চ। এক ঐতিহাসিক বক্তৃতায় সেদিন জাতির পিতা সবার প্রতি আহ্বান জানান এমন একটি প্রতিরোধ গড়ে তুলতে যা জনগণকে পাকিস্তান থেকে বের হয়ে সম্পূর্ণ আলাদা একটি রাষ্ট্রের দিকে, স্বাধীনতার দিকে নিয়ে যাবে।

সেদিন ঢাকার রমনা রেসকোর্স ময়দান থেকে তিনি ঘোষণা করেন, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম; এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।

বিজ্ঞাপন
রক্ত যখন দিয়েছি, আরও রক্ত দেব। এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো,ইনশাআল্লাহ। প্রতিটি ঘরকে দুর্গে পরিণত কর, তোমার যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা কর।’
বক্তৃতার শেষাংশে তিনি বাঙালিদের লড়াকু চেতনা ও বীরত্বের কথা উল্লেখ করে পরোক্ষভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। তিনি বলেন, ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোল এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকো। মনে রাখবা, রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাল্লাহ্। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম, জয় বাংলা।’
প্রসঙ্গত ২০১৭ সালের ৩০ অক্টোবর, ইউনেস্কো শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক এই ভাষণকে বিশ্বের প্রামাণ্য ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ওই ঘোষণার পরেই পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃত্ব সামরিক আইন জারি করে, আওয়ামী লীগকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে নির্দেশ দেওয়া হয় শেখ মুজিব ও অন্যান্য বাঙালি নেতা-কর্মীদের গ্রেপ্তার করতে। ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে সেনাবাহিনী শুরু করে অপারেশন সার্চলাইট।
২৬ মার্চ পাকিস্তানের সেনাবাহিনী তার নৃশংস দমন-পীড়ন শুরু করার সঙ্গে সঙ্গেই, একটি রেডিও সম্প্রচারে শেখ মুজিব তার সহযোগীদের সেনা দখলের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে নির্দেশ দেন। তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনী পিলখানা ইপিআর সদর দপ্তর এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনে অতর্কিত হামলা চালিয়েছে এবং অনেক নিরপরাধকে হত্যা করেছে। ঢাকায়... আমি এই বিশ্বের সব দেশের কাছে সাহায্য চাইছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা মাতৃভূমিকে বাঁচাতে শত্রুদের বিরুদ্ধে বীরত্বের সাথে লড়াই করে যাচ্ছেন। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের সকলের কাছে আমার শেষ অনুরোধ এবং আদেশ- মৃত্যু পর্যন্ত স্বাধীনতার জন্য লড়াই করুন। পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং আনসার ভাইদের আপনার সঙ্গে যুদ্ধ করতে বলুন। কোনো আপস নয়, জয় আমাদেরই। আমাদের পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে সরিয়ে দিতে হবে।দেশের প্রতিটি কোণে থেকে আমার বার্তা সকল নেতাকর্মী ও অন্যান্য দেশপ্রেমিকদের কাছে পৌঁছে দিন। আল্লাহ আপনাদের সকলকে মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।’

সেই রাতেই বঙ্গবন্ধুকে কোনো অভিযোগ ছাড়াই গ্রেপ্তার করা হয় এবং মধ্যরাতের পর তাকে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। আন্তর্জাতিক চাপ সত্ত্বেও পাকিস্তান সরকার তাকে মুক্তি দিতে বা তার সঙ্গে আলোচনা করতে অস্বীকার করে।
১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের পর, যখন যুদ্ধ ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে রূপ নেয়, তখন শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাঙালি মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত যৌথ বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। জুলফিকার আলী ভুট্টো আন্তর্জাতিক চাপের কাছে নতি স্বীকার করেন এবং ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে শেখ মুজিব মুক্তি পান।
মুক্তি পাওয়ার পর লন্ডনে আন্তর্জাতিক মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলার পর, বঙ্গবন্ধু ব্রিটিশ সরকারের দেওয়া রয়্যাল এয়ারফোর্স জেট বিমানে নয়াদিল্লির উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। যেখানে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভারাহগিরি ভেঙ্কটাগিরি এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী এবং সমগ্র ভারত তাকে অভ্যর্থনা জানান, তাদের সঙ্গে ছিলেন ভারতীয় মন্ত্রিসভা এবং সশস্ত্র বাহিনীর প্রধানরা। ভারতের বিশাল জনতাকে সম্বোধন করে প্রকাশ্যে তার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে মুজিব বলেছিলেন ‘আমার জনগণের সেরা বন্ধু, ভারতের জনগণ’। পরে নয়াদিল্লি থেকে শেখ মুজিব আরএএফ জেটে করে ঢাকায় ফিরে আসেন, তেজগাঁও বিমানবন্দরে বিপুল ও আবেগঘন জনতা তাকে নিজ দেশে স্বাগত জানায়।
দেশে ফিরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংক্ষিপ্তভাবে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করেন এবং পরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে ‘বিশ্বের সবচেয়ে বড় মানবিক বিপর্যয়’ হিসাবে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, প্রায় ৩০ লাখ মানুষের মৃত্যু এবং দুই লাখেরও বেশি নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর দার্শনিক অবস্থানটি প্রধানত মুজিববাদ নামে পরিচিত এবং গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতীয়তাবাদের চারটি মূল নীতি নিয়ে গঠিত। তার সমগ্র রাজনৈতিক জীবনে তিনি এসব নীতির প্রচার করেছেন এবং বাংলাদেশের সংবিধানে সেসব নীতিমালা অন্তর্ভুক্ত করে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন।

বাংলাদেশ বিশ্বে প্রধানদেশগুলোর কাছ থেকে স্বীকৃতি অর্জনের পর, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই বাংলাদেশ জাতিসংঘ এবং জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনে প্রবেশ করতে পেরেছিল। ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বজায় রাখার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঘোষণা করেছিলেন যে, বাংলাদেশ হবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড।
তবে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তিনি বিদ্রোহী সেনা সদস্য এবং তার নিজের দলের অসন্তুষ্ট কিছু কর্মীর দ্বারা নিহত হন। তিনি মারা যাওয়ার পর যেসব সামরিক সরকার দেশ শাসন করেছে, প্রকাশ্যে তারা জাতর জনকের ভাবমূর্তি মুছে ফেলারও চেষ্টা করেছে। তবে ১৯৯৬ সালে তার কন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের নির্বাচনের মাধ্যমে জয়ী হয়ে তার ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার করেছিলেন।
বঙ্গবন্ধুর মৃত্যুর পর ১৫ আগস্টকে ’জাতীয় শোক দিবস’ হিসেবে স্মরণ করা হয়। পাকিস্তানে সামরিক শাসনের নিন্দা এবং জাতিগত বৈষম্য এবং অধিকার ও স্বাধীনতার জন্য বাঙালির সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ায় ভারতে এবং সারা বিশ্বে তিনি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত।
কিউবার নেতা ফিদেল কাস্ত্রো ১৯৭৩ সালে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলনের সময় শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্বকে হিমালয়ের সঙ্গে তুলনা করেছিলেন। বিশ্ব শান্তি ও সহযোগিতার প্রতীক হিসেবে তিনি ‘জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কার’ পান। তৃতীয় বিশ্বের মানুষ তাকে এশিয়ার শান্তি ও উন্নয়নের প্রতীক হিসেবেই মনে করে। বিবিসির বাংলা রেডিও সার্ভিসের বিশ্বব্যাপী শ্রোতাদের উপর পরিচালিত ২০০৪ সালের একটি জরিপে, শেখ মুজিব, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং অন্যান্যদের পরাজিত করে ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি’ নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু তার জনগণের হৃদয়ে বাস করেন। বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু এক এবং অবিচ্ছেদ্য। .
উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু সারাজীবন যে স্বাধীন ও স্বনির্ভর বাংলাদেশের স্বপ্ন লালন করেছেন, তা বাস্তবায়নে বর্তমানে আপ্রাণ কাজ করে চলেছেন তার কন্যা ও বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

সূত্র :দ্য ইকোনমিক টাইমস

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

   

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সবদলই সরকার সমর্থিত / ভোটের মাঠে নেই সরকারি দলের প্রতিদ্বন্দ্বী কোনো বিরোধীদল

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status