ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

অনলাইন

লন্ডন-ইউরোপ এসে হাজারো তরুণের স্বপ্নভঙ্গ

আব্দুল মোমিত (রোমেল), ফ্রান্স থেকে

(১ বছর আগে) ১৫ মে ২০২২, রবিবার, ২:১৬ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ৫:৪৩ অপরাহ্ন

mzamin

লন্ডন-ইউরোপ এসে হাজারো তরুণের স্বপ্নভঙ্গ। বাংলাদেশী মধ্যবিত্ত তরুণদের কাছে লন্ডন-ইউরোপ, আমেরিকা যাওয়াটা সবসময়ই এক সোনার হরিণ। আজ-কাল এই সোনার হরিণের পেছনে কম-বেশি ছোটেননি কিংবা আশা করেননি এমন তরুণ বা যুবকদের পাওয়া  মুশকিল। লন্ডন-ইউরোপ, আমেরিকা সবার কাছেই এ এক স্বপ্নের সুন্দর ঠিকানা। তরুণদের বদ্ধমূল ধারণা ইউরোপের যে কোন দেশ বা লন্ডন অথবা আমেরিকার কোনো স্টেটসে একবার যেতে পারলে শুধু অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা পূরণই নয় সামাজিক স্ট্যাটাসেরও  কয়েকধাপ বেড়ে যায়। বরাবরই তাই লন্ডন-ইউরোপ-আমেরিকাতে যাওয়ার জন্য আমাদের মধ্যবিত্ত তরুণদের দৌড়ঝাঁপ লক্ষণীয়। অভিভাবক মহলেও এ নিয়ে উৎসাহ-উদ্দীপনার শেষ নেই।  বর্তমানে বাংলাদেশ থেকে স্টুডেন্ট ভিসা এবং হোম কেয়ার ভিসায়  প্রচুর তরুণ-তরুণী আসছেন লন্ডনে। সিলেট থেকে আসা একজন ছাত্র ফাহাদ। কথা হয় তার সঙ্গে। 

তিনি বলেন, যে স্বপ্ন নিয়ে লন্ডনে এসেছিলাম আসার পর সেটা দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে।

বিজ্ঞাপন
 বিয়ে করে স্থায়ী হওয়ার কথা ছিল খালাতো বোনকে। কিন্তু এখানে এসে এখানের কালচার অনুযায়ী ২৫ হাজার পাউন্ড খালাতো বোনের ব্যাংক একাউন্টে জমা দিতে হয়। কিন্তু সেই সামর্থ্য তার নেই এবং তিনি বিয়ে করার স্বপ্ন বাদ দিয়ে তিনি এখন রেস্টুরেন্টে কাজ করছেন এবং টাকা উপার্জন করছেন কি করে ইউনিভার্সিটির ফি দিয়ে ভিসা এক্সটেনশন করা যায় বা বৈধ থাকা যায় সেই পথেই হাঁটছেন। মৌলভীবাজার থেকে আসা আরেকজন ছাত্র রাতুল। তিনি বলেন, লন্ডনে আসার শুধু স্বপ্ন দেখলেই হবে না আসার পর তা বাস্তবের জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হবে। তা না হলে এই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হবে এটাই স্বাভাবিক। রাতুল বলেন, বিয়ের চিন্তা এসব মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলেছি লন্ডন আসার পর। 

এখন কিভাবে প্রতিষ্ঠিত হবো কিভাবে একটা ভালো জব করবো ইউনিভার্সিটি কমপ্লিট করে সেই রাস্তায় হাঁটছি।  কথা হয় ঢাকা থেকে আসা আরেকজন ছাত্রী অনন্যার সাথে। তিনি বলেন, এখানে আসার পর যে স্বপ্ন নিয়ে এসেছিলাম সেই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা অনেক কঠিন। কাজ করে ইউনিভার্সিটির ফ্রি দেয়া অসম্ভব তার পক্ষে। তাই ভাবছেন একটা ভালো সিটিজেনশিপ ছেলে পেলে তিনি বিয়ে করে এখানে স্থায়ী হবেন। বৃটেনের পরিসংখ্যান বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৮-২০১৯ সাল থেকে ৪ লাখ ৮৫ হাজার ৬৪৫ জন বিদেশি শিক্ষার্থী বৃটেনে অধ্যয়নে এসেছেন। এর মধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন বহির্ভূত শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১ লাখ ৪৩ হাজার ২৫ জন। ২০২০ সালের ‘টিয়ার ফোর স্টুডেন্ট’ ভিসায় কিছু পরিবর্তন আনার পর বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের বৃটেন গমন বেড়েছে। 

করোনাকালেও বাংলাদেশ থেকে স্টুডেন্ট ভিসায় বিপুল সংখ্যক শিক্ষার্থী এসেছেন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশেই এখন বেশ বড় সংখ্যায় বাংলাদেশি অভিবাসী বসবাস করছেন। গত দু দশকে ইতালি, জার্মানি, ফ্রান্স, গ্রিস, অস্ট্রিয়া, স্পেন বা পর্তুগালে বেশ বড় বাংলাদেশি কমিউনিটি গড়ে উঠেছে। মৌলভীবাজারের ছেলে সাইমন। তিনি আজ থেকে ১০ বছর আগের লন্ডন এসেছিলেন। কিন্তু তার স্বপ্ন পূরণ করা অনেকটা তার সাধ্যের বাইরে ছিল। তাই তিনি লন্ডন থেকে ফ্রান্সে চলে এসেছিলেন এবং এখানে আসার পর তিনি বৈধ হন এবং ফ্রান্স-সিটিজেনশিপ নিয়ে আবারও তিনি লন্ডনে ফিরে এসেছেন এবং এখন তার স্বপ্ন পূরণ করতে তিনি যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছেন। 

সাইমন জানান, তাঁর দীর্ঘ ১২ বৎসরের ইউরোপ জীবনে যে কষ্টে তিনি সফলতা অর্জন করেছেন বা স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করেছেন সেই স্বপ্ন পূরণ করতে তিনি লন্ডনে বিয়ে না করে দেশি একটি মেয়েকে বিয়ে করতে দেশে যাচ্ছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিলেটের আরেক যুবকের সাথে কথা হয়। তিনি লন্ডন ওয়ার্ক পারমিট ভিসায় এসেছিলেন। কিন্তু ভিসা এক্সটেনশন করতে ব্যর্থ হলে তিনি লন্ডনে বিয়ে করতে বাধ্য হন। কিন্তু তার বিয়ে করে এই লন্ডনে স্থায়ী হবার স্বপ্নটি দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। জীবনসঙ্গী হিসেবে যাকে তিনি পছন্দ করেছিলেন তার চাহিদা মেটাতে তার গত ১২ বছরের সব উপার্জন প্রিয়তমার হাতে তুলে দিলেও তার মন জয় করতে পারেননি। শেষমেশ তিনি তাকে ছেড়ে চলে আসতে বাধ্য হন। ছন্দ নাম (আসু) জানান, তিনি প্রতি শনিবার বেতন পেতেন একটা রেস্টুরেন্টে কাজ করে। বেতন পাওয়ার পর পুরো বেতনটি তার স্ত্রীর হাতে তুলে দিতে হতো।  

কিন্তু একটা সপ্তাহ তার বেতন পেতে দেরি হয়েছিল। কিন্তু তার স্ত্রী তার বসকে ফোন করে তার বেতন চান এবং এটা নিয়ে তাকে অনেকটা লজ্জায় পড়তে হয়। সেদিন থেকে লন্ডনে স্থায়ীভাবে বসবাস করার স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। এখনও তিনি বেঁচে আছেন জীবন যুদ্ধে টিকে থাকার জন্য। লন্ডনের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে এখানে থাকার জায়গা খুবই অভাব। আত্মীয়-স্বজন দেশ থেকে এলে তাকে বাসায় তুলতে অনেকেরই স্ত্রী অপারগতা প্রকাশ করেন। এতে করে অনেক লন্ডনপ্রবাসীকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে পড়তে হয়। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে লন্ডনে এসে রঙিন স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে বেশকিছু প্রবাসী নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, যে প্রতি শনিবার তারা রেস্টুরেন্টে কাজ করেন এবং বেতন পাওয়ার পর স্ত্রীর হাতে সেই পুরো সপ্তার বেতনটা তুলে দিতে হয়। 

নিজের পকেট খরচের টাকাটা পর্যন্ত সাথে থাকে না। কারণ স্বপ্ন একটাই সেই স্ত্রী তাকে বৈধ করে দেবে সিটিজেনশিপ পাবে এবং স্বাধীনভাবে জীবন যাপন করবে এবং তার স্বপ্নটা পূরণ হবে একদিন। একটা সময় এই তরুণ এবং যুবকরা যখন স্ত্রীদের এবং তাদের শাশুড়িদের চাহিদা পূরণ করতে ব্যর্থ হন তখন তাদেরকে ডিভোর্সের পথে আগাতে হয়। এরকমই তাদের স্বপ্নগুলো দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়ে যায়। আবারো তাদের জীবন যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হয় জীবিকার তাগিদে এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য। নোয়াখালী থেকে সুমন  আসছেন ফ্রান্সে বৈধ হওয়ার জন্য। কিন্তু এখানে যে বৈধ হওয়ার প্রক্রিয়া সেই প্রক্রিয়ায় তিনি বৈধ হতে পারেননি। 

তারপর শরণাপন্ন হন একটি মেয়েকে বিয়ে করে বৈধ হবেন। কিছুদিন পর সেই মেয়েটির সাথে সম্পর্ক ঠিক থাকলেও একটা সময় ভেঙে যায়। এতে করে তার বৈধ হওয়ার স্বপ্ন ভেঙে খান খান হয়ে যায়। শেষমেশ অনেক কষ্ট করে কিছু টাকা জোগাড় করেছেন। এখন পর্তুগালে গিয়ে বৈধ হওয়ার জন্য চেষ্টা করবেন। ফ্রান্স, গ্রিস, ইতালি, পোল্যান্ড, পর্তুগালে অনেক তরুণ যুবক আছে যারা স্বপ্ন নিয়ে এসেছে কিন্তু এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে তাদের প্রতিনিয়ত যুদ্ধ করতে হয়। যুদ্ধ করে যখন সফলতার দ্বারপ্রান্তে পৌঁছে তখন তাদের বাংলাদেশি একটা পাসপোর্টের প্রয়োজন হয়। কিন্তু সেই পাসপোর্টটি সময়মতো না পাওয়ায় আবারো তাদের  বৈধ  হওয়ার স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়েছে। 

অবৈধ অভিবাসনপ্রত্যাশীদের রুখতে হবে
স্বপ্ন মানুষকে বাঁচতে শেখায়। এগিয়ে নেয়। সুন্দর জীবন গড়তে অনুপ্রাণিত করে। কিন্তু কখনো কখনো সেই স্বপ্ন দুঃস্বপ্নে পরিণত হয়। ধ্বংসের দিকে নিয়ে যায়। শুধু তা-ই নয়; একটি জীবনের নির্মম পরিণতি গোটা পরিবারকে বয়ে বেড়াতে হয়। তার পরও লোভের বৃত্ত থেকে বেরিয়ে আসতে পারছেন না তরুণ-যুবকরা। বারবার নানা ঘাত-প্রতিঘাত ও মূল্যবান জীবনহানির পরও তাদের বোধোদয় হচ্ছে না। পশ্চিমা জগতের তথাকথিত উন্নত জীবন তাদের প্রলুব্ধ করছে। ছাড়ছে পরিবার-পরিজন ও দেশের মায়া। অকাতরে হারাচ্ছে জীবন। সঙ্গে বিপুল অর্থ। যা দিয়ে দেশেই নিজেকে গড়ে তুলতে পারতেন। হতে পারতেন একজন সফল উদ্যোক্তা। তা না করে দুর্গম পথ পাড়ি দিয়ে তারা যেভাবে বিদেশ যাওয়ার চেষ্টা করছেন, এতে জীবন যেমন বিপন্ন হচ্ছে, তেমনি সম্ভ্রমহানি হচ্ছে দেশের। অথচ উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃত আমাদের দেশ এখন উন্নয়নশীল দেশের কাতারে।

বলা সঙ্গত, অনেকে অসাধুদের খপ্পরে পড়ে বিপজ্জনক পথে পা বাড়ান। মানুষের সরল স্বপ্নকে পুঁজি করেই নিজেদের স্বার্থে অন্ধ হয়ে উঠে দালাল ও পাচারকারীরা। স্বপ্ন পূরণের প্রলোভন দেখিয়ে হত্যাকারীর মতো মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়। এ রকম কত মানুষ প্রাণ হারাচ্ছেন তার সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য নেই। অবৈধভাবে ইউরোপ, আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে পাড়ি জমাতে গিয়ে সাগরে নৌকাডুবিতে মৃত্যু কিংবা সাগরে দিনের পর দিন ভেসে বেড়ানোর খবর প্রায়ই গণমাধ্যমে আসে। তাদের অনেকেই বাংলাদেশি। খাবার আর নিরাপদ পানির অভাবে তাদের সাগর কিংবা বিদেশের জঙ্গলে অবর্ণনীয় কষ্টে দিন কাটানোর খবরও পাওয়া যায়। কারো ঠাঁই হয় বিদেশের অভিবাসী কেন্দ্র বা কারাগারে।

অনলাইন থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

অনলাইন সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status