ঢাকা, ২০ এপ্রিল ২০২৪, শনিবার, ৭ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১০ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

শরীর ও মন

বৃহদান্ত্রের ক্যান্সার বা অন্ত্রের ক্যান্সার কেন হয় কি কি চিকিৎসা রয়েছে

ডা. মোহাম্মদ তানভীর জালাল
১৩ নভেম্বর ২০২২, রবিবার

মলাশয়ের ক্যান্সার হচ্ছে এক ধরনের ক্যান্সার যা দেহের মলাশয়, মলনালি (বৃহদান্ত্রের অংশ) বা অ্যাপেন্ডিক্সে অনিয়ন্ত্রিত কোষবৃদ্ধির কারণে সৃষ্টি হয়। এটি কোলন ক্যান্সার (colon cancer), বৃহদান্ত্রের ক্যান্সার বা অন্ত্রের ক্যান্সার (bowel cancer) নামেও পরিচিত। সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশের এ ক্যান্সারে আক্রান্তের হার বৃদ্ধি পাচ্ছে। কেবল সচেতনতা, সঠিক সময়ে চিকিৎসা নিতে পারলে এ ক্যান্সার থেকে আরোগ্য লাভ করা যায়। সময়ক্ষেপণে মৃত্যুও হতে পারে।

কেন হয় বৃহদান্ত্র ক্যান্সার
হওয়ার সহজ কারণসমূহ হলো- (১) বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বাড়ে বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের ঝুঁকি। ৫০ বছর বা তার বেশি বয়সের মানুষের মাঝে এই রোগের হার বেশি। (২) পরিবারের কারও বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের ইতিহাস থাকলে তাও ঝুঁঁকির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। বিশেষ করে বাবা-মা, সন্তান কিংবা ভাইবোনের বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের ইতিহাস থাকলে আশঙ্কা তুলনামূলক বৃদ্ধি পায়। (৩) যারা বেশি বেশি গরু, খাসি ও ভেড়ার মাংস বা লাল মাংস খান বা চর্বি জাতীয় খাবার তাদের বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও বেশি থাকে। দেখা গেছে, রেডমিট বা লাল মাংস শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর একটি উপাদান।

বিজ্ঞাপন
এটি শুধু বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারই নয় বরং ওজন বৃদ্ধি, লিভার ক্যান্সারসহ আরও বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার কারণ। (৪) শারীরিক পরিশ্রম না করলে বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ে। (৫) ডায়াবেটিস আক্রান্ত রোগীদের মাঝে বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার প্রবণতা বেশি লক্ষণীয়। ডায়াবেটিস কতোখানি নিয়ন্ত্রণে রয়েছে সেটাও এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। (৬) অধিক ওজনসম্পন্ন কিংবা স্থূলকায় ব্যক্তিদের বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা খুবই বেশি। (৭) ব্যক্তির খাদ্যনালির পলিপ বা কোলনের কোনো সমস্যার পূর্বতন ইতিহাস থাকলে তা বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়ায়। (৮) শুধুমাত্র ফুসফুসের ক্যান্সারই নয়, বরং ধূমপানে বাড়ে বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের মতো ভয়াবহ রোগের ঝুঁকিও। (৯) নিয়মিত খাদ্যতালিকায় প্রক্রিয়াজাতকৃত খাবার, তেল, চর্বি ও ভাজাপোড়া খাবারের আধিক্য এবং আঁশজাতীয় খাবার কম থাকলে তা খাদ্যের সঠিক হজম ও পরিপাকে সমস্যা ঘটায়। (১০) অনেক সময় রেডিয়েশন থেরাপি বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের ঝুঁকি বাড়িয়ে তুলে।

লক্ষণসমূহ
বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের প্রথমদিকে তেমন কোনো লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা যায় না। তাই প্রাথমিক অবস্থায় এই রোগ নির্ণয় করা খুবই কঠিন। তবুও কিছু কিছু ক্ষেত্রে খুব সাধারণ যে লক্ষণগুলো দেখা যায় তা হলো- (১) পেটে ব্যথা ও গ্যাস পলিপজনিত সমস্যা কিংবা কলোরেক্টাল ক্যান্সারজনিত জটিলতায় প্রাথমিক অবস্থায় পেটে ব্যথা ও গ্যাস দেখা দিতে পারে। কখনো এই ব্যথা ও গ্যাসের মাত্রা অসহনীয় পর্যায়েও চলে যেতে পারে। (২) মলত্যাগের অভ্যাসে পরিবর্তন ও কোষ্ঠকাঠিন্য মলত্যাগের অভ্যাসেও আসতে পারে পরিবর্তন। কখনো কখনো মলের ধরন ও রঙে পরিবর্তনসহ দেখা দিতে পারে কোষ্ঠকাঠিন্য। (৩) রক্তমিশ্রিত মল বয়স চল্লিশোর্ধ্ব হলে যদি নিয়মিত রক্তমিশ্রিত মল দেখা যায় তবে দেরি না করে অবশ্যই স্ক্রিনিং করানো উচিত। রক্তমিশ্রিত মল বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের অন্যতম প্রধান লক্ষণ। (৪) অবসন্নতা বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের আরেকটি উপসর্গ হলো অবসন্নতা। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় রোগী অতি সহজেই ক্লান্ত ও পরিশ্রান্ত হয়ে যান। (৫) মলদ্বার থেকে রক্তক্ষরণ পলিপজনিত প্রদাহ মারাত্মক আকার ধারণ করলে মলদ্বার থেকে রক্তক্ষরণ হতে পারে, যা বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারেরও একটি লক্ষণ। (৬) ওজন কমা ও রক্তশূন্যতা বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারে আক্রান্ত ব্যক্তির মাঝে ওজন হ্রাস ও রক্তশূন্যতা দেখা দিতে পারে। (৭) ডায়রিয়া অনেক ক্ষেত্রে রোগীকে ঘন ঘন ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হতে দেখা যায়। (৮) ঘন ঘন মলত্যাগের ইচ্ছা অনুভূত হওয়া বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীর ঘন ঘন মলত্যাগের ইচ্ছা অনুভূত হতে দেখা যায়। এ ছাড়াও ডায়াবেটিস বৃদ্ধি, কাশির সঙ্গে রক্ত, দীর্ঘ স্থায়ী ডায়রিয়া কিংবা কোষ্ঠকাঠিন্যসহ নানা ধরনের উপসর্গ বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারে আক্রান্ত রোগীদের মাঝে লক্ষণীয়।

চিকিৎসা
কেবল অপারেশনই বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের প্রধান চিকিৎসা বলে মনে করা হয়। সেটা যে ধাপেই হোক না কেন। পলিপ কিংবা টিউমার থাকলে তা অপারেশনের মাধ্যমে অপসারণ করে ফেলাই উত্তম। এ ছাড়াও কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেমোথেরাপিও দেয়া হয়। বৃহদান্ত্রের ক্যান্সার থেকে বাঁচার সবচেয়ে উত্তম ও কার্যকর উপায় হলো প্রতিরোধ।

নিম্নে প্রতিরোধের উপায়গুলো দেয়া হলো-
(১) ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখা (২) পশুর মাংস বা লাল বহুলাংশে এড়িয়ে চলাই উত্তম। (৩) প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় আঁশযুক্ত খাবার রাখুন। আঁশসমৃদ্ধ খাবার হজম ও পরিপাককে সুষ্ঠু করে ফলে বৃহদান্ত্র ও সুস্থ থাকে। (৪) চর্বিযুক্ত ও ভাজাপোড়া খাবার যতদূর সম্ভব এড়িয়ে চলাই ভালো (৫) নিয়মিত হালকা শারীরিক পরিশ্রম কিংবা অনুশীলন বৃহদান্ত্রের ক্যান্সার (৬) অ্যালকোহল এবং ধূমপান উভয়ই শরীরের জন্য ক্ষতিকর। অভ্যাস থাকলে পরিত্যাগ করতে হবে। (৭) খাদ্য তালিকায় ক্যালসিয়াম, ফলিক অ্যাসিড এবং ভিটামিন বি বৃহদান্ত্রের ক্যান্সারের ঝুঁকি হ্রাসে সাহায্য করে। এ ছাড়াও খাদ্য তালিকায় রাখতে পারেন রসুন, মাছ, মৌসুমী ফল ও শাক-সবজির মতো খাবারগুলো। (৮) নিয়মিত স্ক্রিনিং এর কোনো বিকল্প নেই। এর মাধ্যমে কোনো কোনো ক্ষেত্রে লক্ষণ প্রকাশের আগেই রোগ নির্ণয় সম্ভব। এতে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে ক্যান্সার সম্পূর্ণরূপে নিরাময় সম্ভব। এ ছাড়াও মলের সঙ্গে অদৃশ্য রক্ত পরীক্ষা বা Fecal Occult Blood Test (FOBT)-এর মাধ্যমে বৃহদান্ত্রের জটিলতা নির্ণয় করা সম্ভব। ৪৫ বা ৫০ বছরের বেশি বয়স্ক সব মানুষের এক বছর পর পর এই পরীক্ষাটি করা উচিত। এ ছাড়াও কলোনস্কপির মাধ্যমে বৃহদান্ত্রের সব অংশকে দেখা যায় এবং পলিপসহ যেকোনো ধরনের জটিলতা নির্ণয় করা যায়। ৪৫ বা তার ঊর্ধ্ব বয়সী সবার কমপক্ষে প্রতি ৫ বছর অন্তর একবার কলোনস্কপি করা উচিত। কলোরেক্টাল ক্যান্সার বা বৃহদান্ত্রের একধরনের নীরব ঘাতক। তবে সচেতনতা এই ঘাতকের হাত থেকে বাঁচার প্রধান উপায়।

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, কোলোরেক্টাল সার্জারি বিভাগ কোলোরেক্টাল, ল্যাপারোস্কপিক ও জেনারেল সার্জন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। চেম্বার : ১৯ গ্রীন রোড, এ.কে. কমপ্লেক্স, লিফট-৪, ঢাকা। যোগাযোগ : ০১৭১২৯৬৫০০৯
 

শরীর ও মন থেকে আরও পড়ুন

   

শরীর ও মন সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status