ঢাকা, ২৯ মার্চ ২০২৪, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

চলতি পথে

‘হার্ডওয়্যার আছে সফটওয়্যার নাই’

শুভ কিবরিয়া
১৩ নভেম্বর ২০২২, রবিবার
mzamin

বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ঘুরে দেখুন নানান বিল্ডিং হচ্ছে, বহুতল বহুবিধ ভবন হচ্ছে। যথেষ্ট অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে। আমরা ব্যাপক হার্ডওয়্যার তৈরি করছি। কিন্তু আমাদের সফটওয়্যারের অবস্থা খুবই শোচনীয়। শিক্ষক নিয়োগের মান নিম্নগামী। সিলেবাস, পঠন-পাঠন অভ্যাস কোনোটাই আর আধুনিক নয়। শিক্ষকদের বড় অংশ বিদ্যানুরাগী নন, ছাত্ররাও সেই পথে চলছে। অনুকরণ করার মতো বিদ্যা উৎপাদনের সব সিস্টেম নষ্ট হয়ে গেছে। শুধু ইট-কাঠ-পাথর-বালি দিয়ে একটা বিশ্ববিদ্যালয় কী করবে যদি সেখানে মানসম্মত বিদ্যা তৈরি না হয়? বন্ধুটির বেদনা আমার বুকেও বাজলো। এই শহরের বুকশপগুলোও ছিল একসময়ের গৌরব।

বিজ্ঞাপন
হালে তাতেও চিড় ধরেছে। বাজারি বই এখন মননশীল, চিন্তাশীল বইকে দারুণভাবেই পেছনে ফেলেছে। এতবড় শহর, এত বিদ্যায়তন, এত মানুষ, এত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি-কিন্তু চিন্তাশীল বইয়ের পাঠক কমছে, সেটাও তো গভীর বেদনারই কারণ।

এবারের গন্তব্য দেশের উত্তরাঞ্চলের একটি বিভাগীয় শহর। শহরটি পুরনো। বহু বছর আগে এখানে জীবনের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ কাটিয়ে এসেছি। পুরনো জায়গায় বহু বছর পর নতুন করে যাবার একটা আনন্দও আছে। স্মৃতি বিধূরতার আনন্দ। দুঃখও থাকতে পারে। পুরনো সুখ স্মৃতিগুলো নতুন আবরণে বেদনাও জাগাতে পারে। কবির ভাষায় যদি বলি, ‘হৃদয় খুঁড়ে কে হায় বেদনা জাগাতে চায়! আমার অবশ্য অপশন নেই। যেতেই হচ্ছে, বিশেষ কাজে। এসব কথা আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন আমার এক বিশেষ বন্ধু। বহু বছর ধরে যার সঙ্গে আমার হৃদ্যিক সম্পর্ক। আমি বলি রক্তের সম্পর্কে অনাত্মীয় হয়েও আত্মার সম্পর্কে যিনি আত্মীয়। এক অর্থে আত্মার সঙ্গে যার মেলে সেই তো আত্মীয়। এটা দূরত্ব বোঝে না, রক্তের নৈকট্যও বোঝে না। হাজার হাজার মাইল দূরে থাকলেও যেখানে পরস্পরকে বুঝতে কোনো সমস্যা হয় না। অথচ এক ছাদের নিচে থেকেও একে অপরকে বোঝা হয় না। যাহোক আমার সেই আত্মার আত্মীয় পরামর্শ দিলেন, এবারের যাত্রায় যেন আমি ভালো করে নতুন সাজের পুরনোকে দেখে আসি। 

শীতের মিষ্টি আবেশ ঢাকা একরাতে পৌঁছলাম সেই শহরে। বাস থামলো যেখানে সেখান থেকে কাউন্টার বেশ দূরে। দীর্ঘক্ষণ বাসে বসে ছিলেন যাত্রীরা। তাই অনেকেরই বাথরুম ব্যবহারের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। যে বাসের যাত্রী ছিলাম, সবাই ছুটলাম সেই বাসের কাউন্টারে। অবাক ব্যাপার কাউন্টারের দরজার সামনে বসে আছেন যে নিরাপত্তা প্রহরী তিনি সবাইকে হাত দিয়ে থামালেন। কারণ ভেতরে তখন জামায়াতে এশার নামাজ পড়ছেন কাউন্টারে দায়িত্বরত সবাই। মজার ব্যাপার হলো বাথরুমটা সেই স্পেসের ভেতরেই। বাথরুমের পথের সামনের জায়গাটাও বন্ধ রাখা হয়েছে এ কারণেই। বাইরে তখন বেশ ক’জন নারী, শিশু, বৃদ্ধ মানুষ জরুরিভাবে বাথরুমের প্রয়োজন চেপে হাঁসফাঁস করছে। সেদিকে কারও ভ্রুক্ষেপ নেই। পুরো নামাজ শেষ হতে আধাঘণ্টা লাগলো। ততক্ষণে সবার অবস্থা অনুমেয়! অথচ বাথরুমের সামনের জায়গাটা খালি রেখেও এ আয়োজন করা যেতো। মানুষের গুরুতর প্রয়োজনের কথা বিবেচনা করেনি কেউ। সে কথা বলতেই হই হই করে উঠলেন সমস্বরে কাউন্টারের লোকজন। যিনি কথাটা তুলেছিলেন তিনিই বেকুব সেজে গেলেন। 

বুঝলাম, এই শহরে মানুষের বিবেচনা বোধে বেশ পরিবের্তন ঘটে গেছে। শহরে পা রাখতেই বুঝতে অসুবিধা হলো না, আর দশটা শহরের মতোই এ শহরেও এখন বিদ্যুৎচালিত আটোরিকশা চালকদের প্রাধান্য। বোঝাই যায়, কর্মের প্রয়োজনে অনেকেই এ পেশায় নেমেছেন। কিন্তু একটা শহরে যতটা প্রয়োজন তার চাইতে অনেক বেশি সংখ্যায় অটোরিকশা পুরো শহরের অভ্যন্তরীণ যানজটের অন্যতম কারণ। এখানে পরিকল্পনার বড় অভাব। দেখারও কেউ নেই। হয়তো যানজটের উৎপাত বাড়লে মাঝে মাঝে চলবে মোবাইল কোর্ট, ধরা হবে, জরিমানা করা হবে, বেচারা গরিব, অসহায় অটোরিকশা চালকদেরই!

রাতের এ শহর চোখ ধাঁধিয়ে দিলো। রাস্তাঘাট, রাতের আলো, বহুতল ভবন চোখে পড়ার মতো উন্নয়ন। এ শহরে থাকা এক বন্ধুকে ফোন করে সেকথা বলতেই বললো, কেবল হার্ডওয়্যার দেখছো। হার্ডওয়্যারে আমরা অনেকটা এগিয়েছি বটে! পরদিন ভোরে হাঁটতে বেরিয়ে একথা স্বীকার করতে বাধ্য হলাম, শহরের রাস্তাঘাট-ফুটপাথ বেশ গোছানো। রাস্তাগুলোও সুপরিসর। ভালোই লাগলো। মনে হলো দেশের যেকোনো জায়গার চাইতে এখানকার অবকাঠামোগত উন্নয়নে একটা সুপরিকল্পনার ছাপ আছে। অবকাঠামো উন্নয়নের পরে তার রক্ষাণাবেক্ষণেও যত্ন আছে। নগরপিতাকে মনে মনে ধন্যবাদও দিলাম।

ভোরবেলায় দিনের টাটকা পত্রিকা দরকার। বহুদিনের পুরনো অভ্যেস। দৈনিক পত্রিকার খোঁজে তাই হাঁটতে শুরু করলাম। সম্ভাব্য যেসব জায়গায় পত্রিকা পাওয়া সম্ভব খোঁজও করলাম। কিন্তু ঠিক মেলাতে পারলাম না। আমার ইচ্ছে ছিল জাতীয় পত্রিকার সঙ্গে সঙ্গে স্থানীয় দু-একটি পত্রিকাও সংগ্রহ করবো। কেমন হচ্ছে এখানকার স্থানীয় পত্রিকা সেটাও দেখা হবে। কিন্তু বিধি বাম! কোনো হকারের দেখা পেলাম না। পত্রিকার দোকানের দেখাও মিলল না। ভাবলাম একটা রেকি করি। হাঁটতে হাঁটতেই রেন্ডাম জনাবিশেক মানুষকে প্রশ্ন করলাম, পত্রিকা কোথায় পাওয়া যাবে? ১৯ জন আমাকে হতাশ করলেন। তারা কোনো খোঁজ দিতে পারলেন না। একজন অবশ্য যথাযথ উত্তর দিলেন। এ অভিজ্ঞতা দিয়ে কোনো সিদ্ধান্তে আসা উচিত হবে না ভেবে হোটেলের পথে পা বাড়ালাম। হোটেলে আসতেই দিনের পত্রিকার দেখা মিললো। পত্রিকাতে হাত বুলাতেই বন্ধুর ফোন। তাকে আমার তাজা অভিজ্ঞতার বয়ান দিলাম। এ বিষয়ে কোনো কথা না বলে এখানকার বিদ্যায়তনগুলোর শিক্ষামানের বিষয়ে খোঁজ নিতে বললেন। 

দেশের পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি এই শহরের গৌরব। সেখানকার এক শিক্ষককেই ফোন করলাম। হাল হকিকত জানতে চাইলাম। বিকালে ক্যাম্পাসেই তার আমন্ত্রণ মিললো। এক সময় ঢাকার কাগজে সাংবাদিকতা করা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বন্ধুটি নিজের বিষয় নিয়ে নানাবিধ গবেষণা আর লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছেন। আলাপে বুঝলাম, ক্যাম্পাসের বাইরে তার নিজস্ব আবাসটিতে একাকি জীবনে পড়াশোনাই তার সঙ্গী। বহু বছরের অভিজ্ঞতা থেকে জানি, বন্ধুটি সহসা কারও প্রশংসা করেন না। ফলে, তার মুখেও বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ জ্ঞানচর্চার বিষয়ে কোনো সুখবর মিললো না। আমি অন্যকে প্রশংসা করার ব্যাপারে তার পুরনো অভ্যেসের কথা মনে করিয়ে দিলাম। বন্ধুটি হাসতে হাসতে বললো, চলেন আপনাকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ক্লাবে নিয়ে যাই। আমিও রাজি হলাম। তিনি শর্ত দিলেন, ওখানে যেয়ে আপনি কোনো কথা বলবেন না, শুধু অন্যদের কথা শুনবেন। এক ঘণ্টা থাকবেন। এরপর বন্ধুটি সিরিয়াস হয়ে বললেন, চলেন একটা বাজি খেলি। ওখানে অবস্থানকালীন এক ঘণ্টায় কারও মুখে যদি বিদ্যাচর্চার কোনো কথা শোনেন, তাহলে আমি আপনাকে একহাজার টাকা নগদ দেবো। আর যদি না শোনেন, তাহলে আপনি আমাকে একহাজার টাকা দেবেন। আমি ভাবলাম, তিনি রসিকতা করছেন!

যাহোক সন্ধ্যে নাগাদ ক্লাবে হাজির হলাম। একটা সোফায় বসলাম দুজন। চারপাশে নানান টেবিলে বিভিন্ন বিভাগের নানা পদের শিক্ষকদের আড্ডা-কথা চলছে। মনোযোগ দিয়ে শিক্ষকদের কথা শোনার চেষ্টা করলাম, চুপিসারে। খেয়াল করলাম অধিকাংশ আলাপের বিষয়, কয়েকজন মিলে জমি কিনে ফ্ল্যাট বানানো সংক্রান্ত বিষয়ে কিছু আলাপ, কিছু আলাপ চাকুরির প্রমোশন সংক্রান্ত, কিছু আলাপ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের পক্ষ ও বিপক্ষ নানাবিধ বিষয় নিয়ে। জ্ঞানচর্চা সংক্রান্ত কোনো আলাপ হচ্ছে সেটা ঠাওর করতে পারলাম না। দূরে এক সোফায় দেখি একজন প্রবীণ শিক্ষক বসে আছেন। শুনলাম মফস্বল জেলার এক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষমতাধর ভিসি তিনি। একাই বসে মোবাইল ফোন ঘাটছেন। আমার বন্ধুটি কয়েকজন শিক্ষককে রসিকতা করেই অনুরোধ করলেন তাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য। প্রত্যুত্তরে তারা এমন মন্তব্য করলেন, যেটা লেখার যোগ্য নয়। বুঝলাম আমার বন্ধুটিসহ ওই শিক্ষকরা একই রাজনৈতিক দলের অনুসারী হওয়া সত্ত্বেও এই ভিসি স্যারকে দারুণ অপছন্দ করেন। সম্ভবত এসব পছন্দ-অপছন্দের সঙ্গে বিদ্যাগত কোনো যোগ নেই। মনটা খারাপ হয়ে গেল। এসব যখন ভাবছি, তখন বন্ধুটি আমাকে স্মরণ করিয়ে দিলেন, আমাদের একঘণ্টা সময় পেরিয়ে গেছে। চলুন বেরিয়ে পড়ি।

বাজিতে জিতে গেলেও আমার বন্ধুটি বিষন্ন। বললেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাস ঘুরে দেখুন নানান বিল্ডিং হচ্ছে, বহুতল বহুবিধ ভবন হচ্ছে। যথেষ্ট অবকাঠামো তৈরি হচ্ছে। আমরা ব্যাপক হার্ডওয়ার তৈরি করছি। কিন্তু আমাদের সফটওয়ারের অবস্থা খুবই শোচনীয়। শিক্ষক নিয়োগের মান নিম্নগামী। সিলেবাস, পঠন-পাঠন অভ্যাস কোনোটাই আর আধুনিক নয়। শিক্ষকদের বড় অংশ বিদ্যানুরাগী নন, ছাত্ররাও সেই পথে চলছে। অনুকরণ করার মতো বিদ্যা উৎপাদনের সব সিস্টেম নষ্ট হয়ে গেছে। শুধু ইট-কাঠ-পাথর-বালি দিয়ে একটা বিশ্ববিদ্যালয় কী করবে যদি সেখানে মানসম্মত বিদ্যা তৈরি না হয়? বন্ধুটির বেদনা আমার বুকেও বাজলো।

এই শহরের বুকশপগুলোও ছিল একসময়ের গৌরব। হালে তাতেও চিড় ধরেছে। বাজারি বই এখন মননশীল, চিন্তাশীল বইকে দারুণভাবেই পেছনে ফেলেছে। এতবড় শহর, এত বিদ্যায়তন, এত মানুষ, এত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি-কিন্তু চিন্তাশীল বইয়ের পাঠক কমছে, সেটাও তো গভীর বেদনারই কারণ।
এরপর দেশের নানান প্রান্তে অবস্থিত বেশ ক’টি নতুন বিশ্ববিদ্যালয়ে যাবার সুযোগ মিললো। সর্বত্রই ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন হচ্ছে। কিন্তু বিদ্যাচর্চার অবস্থা সঙ্গীণ। শুধু তাই নয়, এসব বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো নির্মাণে যে অপরিকল্পনা, অসামঞ্জস্য, অদূরদর্শিতা, সৌন্দর্যহীনতা খালি চোখে দেখা পড়লো, তা-ও বেদনা বাড়ায়। 

ব্যাপক অর্থযোগ ঘটিয়ে, ব্যাপক শিক্ষক নিয়োগ দিয়ে, বহুরকম নতুন নতুন বিষয়ে পাঠদান শুরু করিয়ে-যেসব উচ্চতর বিদ্যায়তন আমরা চালু করলাম- সেখানে বিদ্যাচর্চার মান যদি আশানুরূপ নাই হয়, সেই দায় কে নেবে? মানসম্মত সফটওয়ার তৈরি না করতে পারলে, চোখ ধাঁধানো হার্ডওয়্যার আমাদের কি কাজে লাগবে?

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

 

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status