ঢাকা, ২৮ মার্চ ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১৪ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৭ রমজান ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

বেহুদা প্যাঁচাল

রাজনীতির খেলা কোন রংয়ের?

শামীমুল হক
১০ নভেম্বর ২০২২, বৃহস্পতিবার
mzamin

কতো মানুষ যে কুলাতে না পেরে জীবনমানে পরিবর্তন এনেছে। কাটছাঁট করেছে খাবারে। সন্তানের প্রাইভেট টিউটর বাদ দিয়েছে অর্থের অভাবে। এসব করেও যারা পারছেন না তারা পরিবার পাঠিয়ে দিচ্ছেন গ্রামে। এ অবস্থায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি যদি বেসামাল হয়ে উঠে তাহলে পরিস্থিতি হবে আরও ভয়াবহ। একদিকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি অন্যদিকে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি দিন দিন পরিবেশকে দূষিত করে তুলছে। যদিও নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য বিশ্ব পরিস্থিতিকে দায়ী করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং নিষেধাজ্ঞাকে দায়ী করা হচ্ছে। এর ঢেউ শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বে লেগেছে। দুনিয়ার দেশে দেশে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে।

বিজ্ঞাপন
এ বিষয়টি বৈশ্বিক হলেও দেশের রাজনৈতিক ইস্যুতো রাজনীতিবিদদের হাতে। এক্ষেত্রে মাঠের খেলায় কোনো দলকে এক বা একাধিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে না খেলে সরাসরি দুই পক্ষই এর মীমাংসা দিতে পারেন

 

মাঠে যদি প্রতিপক্ষ থাকে দুটি তাহলে খেলায় জয় আনা অসাধ্য। যত চেষ্টাই করা  হোক পরাজয়ের গ্লানি নিয়ে ফিরতে হবে মাঠ থেকে। এ সত্য অবধারিত। সম্প্রতি টি- টোয়েন্টি বিশ্বকাপে এ চরম সত্যটি আবারো বিশ্বকে জানান দিয়েছে।  বাংলাদেশের পরপর দুটি খেলায় এমন দৃশ্য দেখা গেছে। বিশেষ করে সাকিবের বিতর্কিত আউট নিয়ে আলোচনা হয়েছে দেশ- বিদেশে। আবার একটি ম্যাচে দেখা গেছে, বাংলাদেশ দল জয়ী হওয়ার পর মাঠ থেকে উঠে যায়। কিন্তু আউট দেয়া ভুল ছিল বলে ফের মাঠে ডেকে এনে এক বল খেলিয়ে নেয়। তার মানে হলো- বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ মাঠে দুটি। একটি হলো সরাসরি ম্যাচের প্রতিপক্ষ। আরেকটি হলো আম্পায়ার। অথচ আম্পায়ার থাকবেন সকল প্রীতির ঊর্ধ্বে। খেলায় হার-জিত থাকবেই। যেকোনো একদলকে পরাজয় নিয়ে মাঠ ছাড়তে হবে। এটা জেনেই দুই দল মাঠে নামে। কিন্তু রাজনীতির মাঠে এ পরাজয় মেনে খেলায় কেউ নামতে রাজি নন। সবাইকে জয়ী হতে হবে। এ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়েই রাজনৈতিক দলগুলো মাঠে নামে। বর্তমান সময়ের রাজনীতি দেখে অন্তত তাই মনে হচ্ছে। বিশেষ করে সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও মাঠের বিরোধী দল বিএনপি দুই দলই এখন খেলাকে সামনে আনছে। তাদের শীর্ষ নেতাদের মুখ থেকে ভেসে আসছে খেলার ঘোষণা। খেলা হবে-এ ঘোষণায় অবশ্য দেশের আমজনতার কপালে চিন্তার ভাঁজ। তাতে কি? রাজনীতিকদের এতে কি আসে যায়। সংসদে দাঁড়িয়েও সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী, আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের খেলা হবে ঘোষণা দিয়েছেন। অবশ্য তিনি এর ব্যাখ্যায় বলেছেন, খেলা হবে ভোট চুরির বিরুদ্ধে। খেলা হবে দুর্নীতির বিরুদ্ধে। খেলা হবে এক কোটি বিশ লাখ ভুয়া ভোটারের বিরুদ্ধে। বিএনপি নেতারাও বলছেন, খেলা হবে ভোট ডাকাতের বিরুদ্ধে। খেলা হবে অনিয়ম, দুর্নীতির বিরুদ্ধে। খেলা হবে হাজার হাজার কোটি টাকা লুটপাটের বিরুদ্ধে। খেলা হবে গুম, খুনের বিরুদ্ধে। দুই দলেরই খেলার বিষয়বস্তু একই। যদি একই হয় তাহলে প্রতিপক্ষ কেন? তারা তো এক টেবিলে বসেই খেলা হবে ঘোষণা দিতে পারেন। যেহেতু এটা হচ্ছে না তাহলে মুখে যাই বলুক আসলে এ খেলা অন্য খেলা। 

 যে খেলায় দুই পক্ষই জয়ী হতে চায়। কিন্তু একপক্ষকে তো হারতে হবেই। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মতো এ দুটি রাজনৈতিক দলের মধ্যে বিএনপিকে খেলতে হচ্ছে একাধিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে। সরকার, আওয়ামী লীগ, পুলিশ ও সিভিল প্রশাসনের বিরুদ্ধে। আর আওয়ামী লীগকে খেলতে হচ্ছে মাঠের বিরোধী দলগুলোর সঙ্গে। যদিও পুলিশ কিংবা সিভিল প্রশাসনকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করার কথা। কিন্তু দেশের আইন তাদের এই নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনে বড় বাধা। নির্বাচনকে ঘিরেই যেহেতু বর্তমান আন্দোলন, সেহেতু বর্তমান সরকার ব্যবস্থা যতদিন এমন থাকবে ততদিন পুলিশ কিংবা সিভিল প্রশাসনকে নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করার আশা করা বৃথা। বর্তমান আইনে সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগে নির্বাচন হবে। সরকারে থাকবে বর্তমান সরকারই। তবে মন্ত্রিসভা ছোট করে অন্তর্বর্তীকালীন বলা হবে। একটি সংসদ চলাকালে আরেকটি সংসদ নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচনী মাঠে বর্তমান সংসদ সদস্যরা যাবেন প্রটোকল নিয়ে। আর অন্যদলের প্রার্থীরা যাবেন সাধারণ হয়ে। একেবারে উল্টোচিত্র। এ অবস্থায় প্রশাসন তো দৌড়াবে সংসদ সদস্যের পেছনে। সুযোগ- সুবিধাও পাবেন তারাই। সরকারে থেকে নির্বাচন করে প্রশাসনকে নিরপেক্ষ থাকার কথা বলা মানে প্রলাপ ছাড়া কিছুই নয়। কোনো প্রশাসনই চাইবে না সরকারের মত নেই এমন কোনো কাজ করতে। কারণ তাদেরও তো চাকরি যাওয়ার ভয় আছে। শাস্তির ভয় আছে। আর এখানেই আপত্তি বিরোধীদলগুলোর। এ জন্যই তারা দাবি তুলেছে সংসদ ভেঙে দেয়ার। দাবি তুলেছে যে নামেই হোক নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দেয়ার। এখানেও অবশ্য সরকারের ব্যাখ্যা আছে। সরকারের কথা-নির্বাচন তো করে নির্বাচন কমিশন। সরকার শুধুমাত্র নির্বাচন কমিশনের চাহিদা বাস্তবায়ন করে। আর নির্বাচনকালীন সময়ে তো প্রশাসন থাকে নির্বাচন কমিশনের অধীনে। এখানে তো সরকারের করার কিছু নেই। এ কথার কতোটুকু বাস্তবায়ন হয় তার নজির অতি সম্প্রতি গাইবান্ধা-৫ আসনের উপনির্বাচনই আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে। এ নির্বাচনে সিসিটিভি ফুটেজ দেখে নির্বাচন কমিশন থেকে বার বার মাঠ পর্যায়ে নির্দেশনা দেয়া হলেও কোনো নির্দেশনাই বাস্তবায়ন হয়নি। বরং কেন্দ্রের প্রিজাইডিং অফিসাররা বলেছেন, আমাদের এখানে সুষ্ঠু ও সুন্দর ভোট হচ্ছে। এই যখন অবস্থা তখন সরকারের অধীনে নির্বাচন যে কতোটুকু স্বচ্ছ হবে তা দেশের মানুষ এতদিনে বুঝে গেছেন।  এই সিস্টেমের বিরুদ্ধে একদিন আওয়ামী লীগ মাঠে লড়াই করেছে। জনতার মঞ্চ করে দিনের পর দিন আন্দোলন করেছে। হরতাল, অবরোধে অচল ছিল দেশ। এরই প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয় তৎকালীন খালেদা জিয়ার সরকার। কিন্তু ২০০৮ সালে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগ সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা তুলে দেয়। সেখানে সংসদ বহাল রেখে জাতীয় নির্বাচন করার ব্যবস্থা রাখে। বর্তমান আন্দোলন এর বিরুদ্ধে। বিএনপি বিভাগীয় সমাবেশগুলোতে এসব দাবিই জোরালোভাবে তুলে ধরছে সরকারের কাছে। 

 

 

এসব সমাবেশে ধারণার অতীত লোকজন জড়ো হচ্ছে। অপরদিকে সরকারি দল আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দেয়া হচ্ছে বিভিন্ন বাধা- বিপত্তি। হচ্ছে হামলা, মামলা। চলছে গ্রেপ্তারও। ইতিমধ্যে সিলেট বিভাগীয় সমাবেশ নিয়ে উত্তেজনা চরমে। এ সমাবেশ হতে দেয়া হবে না বলে ঘোষণা দিয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ। এরপরও রয়েছে ফরিদপুর, কুমিল্লা, রাজশাহী ও ঢাকার সমাবেশ। ডিসেম্বরের ১০ তারিখে ঢাকার সমাবেশ নিয়ে উত্তেজনার পারদ ভারী হচ্ছে প্রতিদিনই। আঁচ করা যাচ্ছে এ নিয়েও জল ঘোলা হবে। কীভাবে ঘোলা হবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। ওদিকে বিএনপি’র সঙ্গে যুগপৎ আন্দোলনের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে সমমনা দলগুলো। মনে হচ্ছে ডিসেম্বরের পর যুগপৎ আন্দোলনের দিকে যাবে মাঠের বিরোধী দলগুলো। অবশ্যই সরকার ও সরকারি দল আওয়ামী লীগও বসে থাকবে না। ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের নেতারা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। বলেছেন, সহিংসতা রোধে তারা মাঠে থাকবেন। কাউকে ছাড় দেয়া হবে না। এ অবস্থায় আগামী দিনগুলো যে একেবারে মসৃণ যাবে তা কিন্তু নয়। এমনিতেই দেশের মধ্যবিত্ত, নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্তদের অবস্থা কাহিল। নিত্যপণ্যের দামের কষাঘাতে তারা জর্জরিত। অসহায় মুখগুলো চেয়ে আছে কখন নিত্যপণ্যের দাম আবার আগের মতো হবে। কতো মানুষ যে কুলাতে না পেরে জীবনমানে পরিবর্তন এনেছে। কাটছাঁট করেছে খাবারে। সন্তানের প্রাইভেট টিউটর বাদ দিয়েছে অর্থের অভাবে।

 এসব করেও যারা পারছেন না তারা পরিবার পাঠিয়ে দিচ্ছেন গ্রামে। এ অবস্থায় রাজনৈতিক পরিস্থিতি যদি বেসামাল হয়ে উঠে তাহলে পরিস্থিতি হবে আরও ভয়াবহ। একদিকে রাজনৈতিক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি অন্যদিকে নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতি দিন দিন পরিবেশকে দূষিত করে তুলছে। যদিও নিত্যপণ্যের ঊর্ধ্বগতির জন্য বিশ্ব পরিস্থিতিকে দায়ী করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং নিষেধাজ্ঞাকে দায়ী করা হচ্ছে। এর ঢেউ শুধু বাংলাদেশ নয়, গোটা বিশ্বে লেগেছে। দুনিয়ার দেশে দেশে অর্থনৈতিক মন্দা চলছে। এ বিষয়টি বৈশ্বিক হলেও দেশের রাজনৈতিক ইস্যুতো রাজনীতিবিদদের হাতে। এক্ষেত্রে মাঠের খেলায় কোনো দলকে এক বা একাধিক প্রতিপক্ষের সঙ্গে না খেলে সরাসরি দুই পক্ষই এর মীমাংসা দিতে পারেন। এর জন্য প্রয়োজন সদিচ্ছা। এ সদিচ্ছা কি দেশের রাজনীতিকদের হবে? এটা হওয়া যে জরুরি। আর এটা না হলে পরিস্থিতি দিন দিন অবনতি হবে। এটা চোখ বুজে যে কেউ বলে দিতে পারে। এমনিতেই আগামী বছর দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা করা হচ্ছে। আবার যদি রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে হয়, তখন চারদিকে গাঢ় অন্ধকার নেমে আসতে বাধ্য। এ থেকে মুক্তি দিতে পারেন কেবলমাত্র রাজনীতিবিদরাই।  শেষ কথা হলো- সংলাপ ও সংযোগ যেকোনো দূরত্বকে একেবারে কাছে এনে দিতে পারে। যেকোনো সমস্যার সমাধান দিতে পারে। যেকোনো বৈরিতা উপড়ে ফেলতে পারে। যেকোনো অবস্থায় সংলাপ এবং সংযোগই হলো উত্তম পন্থা। যে পন্থা দরজা খুলে দেয় সকল ভেদাভেদের। এমনটা হলে আর খেলার প্রয়োজন হয় না।

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status