নির্বাচিত কলাম
সময় অসময়
দ্রব্যসামগ্রীর অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, সব দায় কী ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের?
রেজানুর রহমান
২ নভেম্বর ২০২২, বুধবাররাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে দেশে অনেক জিনিসের দাম বেড়েছে। এটা সত্য। তবে এই সুযোগে অনেক মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে ফেলেছি আমরা। অসহায় মানুষকে আরও বেশি অসহায় করে তুলছি। কিছু একটা হলেই দোষ চাপাচ্ছি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের উপর। এটা ঠিক, যুদ্ধ কখনই মঙ্গল বয়ে আনে না। যুদ্ধ মানুষের ক্ষতি করে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই সুযোগে অনেকেই প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়িয়ে চলেছেন। যে জিনিসের দাম বাড়ার কথা নয়, সেই জিনিসের দামও বাড়িয়ে দিচ্ছেন।
এখানেই আসে সততা নীতি-নৈতিকতার প্রশ্ন। চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী এটাই সত্য। এই চোরদের থামাতে না পারলে সামনের ভবিষ্যৎ সুখের হবে বলে মনে হয় না। এদিকে দেশে রাজনীতির হাওয়া বদলে গেছে। দেশ গিলে খাওয়ার বক্তৃতা-বাহাস শুরু হয়েছে। একই সময়ে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণ দেখিয়ে চতুর ব্যবসায়ীরা, সুযোগ সন্ধানী দুষ্টু মানুষেরা দেশটাকে শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে যায় সেটাই বড় আশঙ্কারবিজ্ঞাপন
একটা গল্প বলি। ছোট গল্প। ডাক্তারের অনুপস্থিতিতে একজন কম্পাউন্ডার প্রায়শই রোগীদের কাছে ডাক্তার সাজেন। দেখতে দেখতেই ডাক্তারি শিখে ফেলেছেন। অনুমানের ভিত্তিতে রোগীর চিকিৎসা করেন। একটা ঘটনার পর থেকে তিনি রোগীদের কাছে ফেমাস হয়ে গেছেন। ঘটনাটা বলি। রোগী দেখতে গেছেন। রোগীর জ্বর বেড়ে গেছে। জ্বরে কাহিল হয়ে গেছেন রোগী। পরিবারের লোকজন বিশেষ করে রোগীর স্ত্রী হাউমাউ করে কান্নাজুড়ে দিলেন- ডাক্তার সাহেব, আপনি আমার ধর্মের বাপ। আমার স্বামীকে ভালো করে দেন। কম্পাউন্ডার সাহেব একটু বিপাকে পড়ে গেলেন। আগের দিন একটা ধারণার উপর ওষুধ লিখে দিয়েছেন। আজ কী করবেন ভেবে পাচ্ছেন না। কোনো ধারণাই কাজে দিচ্ছে না। হঠাৎ তিনি রোগীর পরিবারের সদস্যদের প্রতি চোটপাট শুরু করে দিলেন- আপনারা এই ভুলটা করলেন কীভাবে? রোগীর স্ত্রী কান্না থামিয়ে অবাক কণ্ঠে বললেন, ভুল? আপনি কোন ভুলের কথা বলছেন ডাক্তার? কম্পাউন্ডার আগের চেয়ে আরও বেশি উচ্চকিত। বিরক্ত কণ্ঠে রোগীর স্ত্রীকে জিজ্ঞেস করলেন- আপনারা ভুল করেন নাই? না, মানে আপনি কোন ভুলের কথা বলছেন? এখনো বোঝেন নাই কোন ভুলের কথা বলছি? না। একটু বুঝিয়ে বলবেন? কম্পাউন্ডার আরও বেশি উচ্চকিত। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, আপনাদেরকে বুঝিয়ে বললেও তো কোনো কাজ হবে না। আপনারা ডাক্তারের কথা শুনবেন না। রোগী ভালো হবে কি করে? ডাক্তারের কথা তো শুনতে হবে। কথা বলতে বলতে কম্পাউন্ডার এমন ভাব দেখালেন, রোগীর চিকিৎসা করবেন না। এক্ষুণি চলে যাবেন।
রোগীর স্ত্রী হাত জোড় করে ডাক্তারের সামনে দাঁড়ালেন। বললেন, আমাদের ভুল হয়েছে। এইবারের মতো মাফ করে দেন। বলেন আমরা কী ভুল করেছি? কম্পাউন্ডার এবার রেগে বললেন, আপনাদেরকে রোগীর ব্যাপারে কী কী বলেছিলাম মনে আছে? রোগীর পরিবারের কেউ কোনো কথা বললেন না। রোগীর স্ত্রী ইতস্তত করে বললেন- আপনি যা যা বলেছেন আমরা সব কিছুই ফলো করেছি। প্রতিবাদ করলেন কম্পাউন্ডার- না, আপনারা আমার সব কথা ফলো করেন নাই। আমি বলেছিলাম রোগীকে ভাত দেয়া যাবে না। অথচ আপনারা তাকে ভাত খাইয়েছেন। এই কাজটা আপনারা কেন করেছেন? না, না আমি আপনাদের রোগীর চিকিৎসা করবো না। ডাক্তারের কথা না শুনলে তো কাজ হবে না। কম্পাউন্ডারের কথা শুনে সবাই অবাক। কেউ কেউ ডাক্তাররুপী কম্পাউন্ডারকে ফেরেশতা ভাবতে শুরু করলেন। দেখেছেন, কী ভালো ডাক্তার। রোগীকে ভাত খেতে দেয়া হয়েছে সেটা না দেখেও বুঝে ফেলেছেন। বলাবাহুল্য, ওই কম্পাউন্ডার সাহেব আসল ডাক্তারের চেয়েও এখন বেশ জনপ্রিয়। আসল ডাক্তারকে না খুঁজে অধিকাংশ রোগী এখন তাকেই খোঁজে। প্রিয় পাঠক, নিশ্চয়ই আপনাদের মনে একটা প্রশ্ন জেগেছে এই গল্পের মাজেজা কী? হ্যাঁ, একটা মাজেজা আছে। তার আগে গল্পের ধাঁধাটা পরিষ্কার করি। আপনারা কি ধরতে পেরেছেন, রোগীকে ভাত খেতে দেয়া হয়েছিল সেটা কম্পাউন্ডার বুঝলেন কী করে? এটাই হলো একটা রহস্য।
এ ধরনের রহস্যময় গল্প বানাতে হলে একটু চতুর হতে হয়। চোখ কান খোলা রাখতে হয়। একটু অভিনয়ও জানতে হয়। মিথ্যাকে সত্য প্রমাণ করার অভিনয়। বলাবাহুল্য, আমাদের দেশে মিথ্যাকে সত্য বানানোর ক্ষেত্রে অনেকেই দক্ষ অভিনেতা হয়ে উঠেছেন। সবার মুখে একটাই গল্প- রাশিয়া বনাম ইউক্রেন যুদ্ধ। যখনই কোনো অন্যায়, অনিয়ম দুর্নীতি অনাচার হচ্ছে তার জন্য ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধকে কারণ হিসেবে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। এই লেখায় উল্লেখ করা গল্পের মতো। রোগীকে ভাত খেতে দেয়া হয়েছিল সেটা কম্পাউন্ডার সাহেব বুঝলেন কী করে? কম্পাউন্ডার সাহেব একটি ধারণাকে কাজে লাগিয়েছেন। রোগীর পাশে বসে তিনি কোন প্রক্রিয়ায় ডাক্তারি চালাবেন সেটাই ভাবছিলেন। হঠাৎ দেখলেন রোগীর বিছানার নিচে ছিটানো ভাত পড়ে আছে। এর থেকেই বুঝে নেন রোগী ভাত খেয়েছে। যদিও জ্বরের কারণ ভাত নয়। কিন্তু চতুর কম্পাউন্ডার তার বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়েছেন। একটা ধারণাকে ভিত্তি করে ছক্কা মেরেছেন। সাম্প্রতিক সময়ে আমরাও অনেকে ধারণার বশবর্তী হয়ে মিথ্যাকে সত্য বানাচ্ছি। যত দোষ নন্দ ঘোষের। তেমনই যত দোষ ইউক্রেন ও রাশিয়া যুদ্ধের। বাজারে চিনি পাওয়া যাচ্ছে না, দোষ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের। অথচ রাশিয়া অথবা ইউক্রেন কোনো দেশ থেকেই আমরা চিনি আমদানি করি না। একটি পত্রিকায় পড়লাম দেশে যথেষ্ট পরিমাণ চিনি মজুত আছে। চিনি নিয়ে হাহাকার করার কোনোই যৌক্তিকতা নাই। অথচ হাহাকার হচ্ছে।
বাস্তবতা হলো একটি চক্র ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের বাস্তবতাকে কাজে লাগিয়ে চরম মিথ্যাকে সত্য বানিয়েছে। ডিমের দাম নিয়ে এখনো চলছে শুভঙ্করের ফাঁকি। বলা হচ্ছে মুরগির খাদ্য ইউক্রেন-রাশিয়া থেকে আমদানি করতে হয়। যুদ্ধের কারণে মুরগির খাদ্যের দাম বেড়েছে। তাই ডিমের দামও বেড়েছে। অথচ এটাই প্রকৃত সত্য নয়। ডিমের দাম বাড়ানোর একটা উপলক্ষ তৈরি করেছে ডিম বিষয়ক সিন্ডিকেট চক্র। কাঁচামরিচ তো আর রাশিয়া অথবা ইউক্রেন থেকে আসে না। হঠাৎ বাজারে কাঁচামরিচের দাম বেড়ে গেল। বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলাম- ভাই মরিচের দাম বাড়ার কারণ কী? তোতা পাখিকে শেখানো বুলি আওড়ালেন বিক্রেতা- দাম বাড়ার কারণ জানেন না? না। কেন বাড়লো? বিক্রেতার উত্তর- ঐ যে যুদ্ধ... যুদ্ধের কারণে দাম বেড়েছে। চাল বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করলাম- ভাই চালের দাম বাড়লো কেন? তারও ওই একই কথা। চালের দাম বেড়েছে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে। মাছের রাজা ইলিশ। দাম সাধারণের নাগালের বাইরে। কাওরান বাজারের আড়তে এক মাছ ব্যবসায়ীকে জিজ্ঞেস করলাম- ইলিশের এত দাম কেন? তারও ওই একই উত্তর- এইটা কি প্রশ্ন করলেন ভাই? যুদ্ধ চলতেছে জানেন না? যুদ্ধের সময় জিনিসপত্রের দাম তো বাড়বেই। কী চতুর স্বীকারোক্তি। যুদ্ধ চলছে রাশিয়া ও ইউক্রেনে। সে জন্য বাংলাদেশে ইলিশের বাজার চড়া। আমরা সেটা মেনেও নিচ্ছি।
দেশে এমন কোনো জিনিস নাই যার দাম বাড়েনি। চাল, ডাল, তেল, লবণ, মাছ, মাংস, শিশুখাদ্য, ডিম, ভোজ্য তেল, পরিবহন ভাড়া সেই সঙ্গে বাড়ি ভাড়াও বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। এটা সত্য, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে দেশে কিছু কিছু জিনিসের দাম বেড়েছে। তবে যৌক্তিকতার প্রশ্নে যার দাম হয়তো ৫ টাকা বাড়ালেই চলতো সেখানে দাম বাড়ানো হয়েছে আরও ৫ থেকে ১০ টাকা। চতুর ব্যবসায়ীরা ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবকে সচতুর ভাবে কাজে লাগাচ্ছেন। দাম বাড়লো কেন? উত্তর একটাই- ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। দাম এত বেশি বাড়লো কেন? এই প্রশ্নের উত্তরও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ। মোট কথা, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ বাংলাদেশের চতুর ব্যবসায়ীদের জন্য অনেক আনন্দের, অনেক ভরসার উপলক্ষ হয়ে উঠেছে। চতুর ব্যবসায়ীরা তৈরি করেছেন সিন্ডিকেট। ইচ্ছে মতো বিভিন্ন দ্রব্যের দাম বাড়িয়ে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধকেই ঢাল হিসেবে চালিয়ে দিচ্ছেন।
আবারো বলি, রাশিয়া ও ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে দেশে অনেক জিনিসের দাম বেড়েছে। এটা সত্য। তবে এই সুযোগে অনেক মিথ্যাকে সত্য বানিয়ে ফেলেছি আমরা। অসহায় মানুষকে আরও বেশি অসহায় করে তুলছি। কিছু একটা হলেই দোষ চাপাচ্ছি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের উপর। এটা ঠিক, যুদ্ধ কখনই মঙ্গল বয়ে আনে না। যুদ্ধ মানুষের ক্ষতি করে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশও নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই সুযোগে অনেকেই প্রতারণার আশ্রয় নিয়ে দ্রব্যমূল্যের দাম বাড়িয়ে চলেছেন। যে জিনিসের দাম বাড়ার কথা নয়, সেই জিনিসের দামও বাড়িয়ে দিচ্ছেন। এখানেই আসে সততা নীতি-নৈতিকতার প্রশ্ন। চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী এটাই সত্য। এই চোরদের থামাতে না পারলে সামনের ভবিষ্যৎ সুখের হবে বলে মনে হয় না। এদিকে দেশে রাজনীতির হাওয়া বদলে গেছে। দেশ গিলে খাওয়ার বক্তৃতা-বাহাস শুরু হয়েছে। একই সময়ে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণ দেখিয়ে চতুর ব্যবসায়ীরা, সুযোগ সন্ধানী দুষ্টু মানুষেরা দেশটাকে শেষ পর্যন্ত কোথায় নিয়ে যায় সেটাই বড় আশঙ্কার। লেখক: কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, সম্পাদক আনন্দ আলো