মত-মতান্তর
রাজনীতিতে পারস্পরিক বিষোদাগার ও ব্যক্তিগত আক্রমণ কেন?
ড. মাহফুজ পারভেজ
(১ বছর আগে) ৩১ অক্টোবর ২০২২, সোমবার, ৯:৪৫ পূর্বাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৪:৪০ অপরাহ্ন
বিরূপ মন্তব্য, বিদ্বেষ ছড়ানো, ব্যক্তিগত আক্রমণ সুষ্ঠু গণতন্ত্রে কখনই কাম্য নয়। কিন্তু রাজনৈতিক আন্দোলন ও আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে যে ভাবে রাজনৈতিক দল বা নেতারা একে অপরের দিকে কাদা ছোড়াছুড়ি করছেন, তা দুঃখজনক। নানা কৌশলে রাজনীতির মাঠে খেলা হতেই পারে। কিন্তু রাজনীতিতে পারস্পরিক বিষোদাগার ও ব্যক্তিগত আক্রমণ কেন? আশ্চর্যজনক বিষয় হলো, এ নিয়ে দল বা দলের বাইরের সুধীমহলে কেউ সামান্যতম উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন না। মনের আনন্দে সবাই রাজনীতির নামে অকথা-কুকথা উপভোগ করছেন!
সাম্প্রতিক সময়ে আন্দোলনের গতিবেগ বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলছে বিরূপ মন্তব্যের ঢল। লাগামহীন ভাবে একে অপরকে পাল্লা দিতে গিয়ে নেতা-নেত্রীরা রাজনৈতিক বক্তব্যের চেয়ে ব্যক্তিগত কুৎসা করছেন বেশি। মানুষের মধ্যে বিদ্বেষে ছড়িয়ে দিলে সরকার ও বিরোধীদের রাজনীতিতে তার কুপ্রভাব পড়বে এবং সামনের নির্বাচনের লড়াইও অস্বাস্থ্যকর হয়ে যেতে পারে। একে অপরকে ব্যক্তিগত ভাবে আক্রমণ করা উচিত নয়, এটা রাজনীতির একটি প্রাথমিক শিক্ষা। এই শিক্ষা থেকে বিচ্যুত হলে তা সুষ্ঠু রাজনীতি ও সৌহার্দপূর্ণ গণতন্ত্রের পক্ষে মোটেই ভাল নয়। বরং এসবের পরিবর্তে, তর্ক-বিতর্ক এবং জনস্বার্থের বিষয় নিয়ে আলোচনাকেই রাজনৈতিক পরিসরে স্থান দেওয়া ভাল। দুঃখজনকভাবে এমনটি দৃষ্টিগোচর হচ্ছে না।
ব্যক্তিগত আক্রমণের বাহুল্য বিগত দিনগুলোতে প্রত্যক্ষ করে আসন্ন পরিস্থিতি সম্পর্কে আশার বদলে হতাশা বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সত্য কবুল করলে বলতে হয়, ব্যক্তিগত আক্রমণের প্রবণতা বাংলাদেশের রাজনীতির একটি বহুচর্চিত পুরনো পথ। বর্তমানের মতো অতীতেও বিভিন্ন দলের নেতরা কটুকাটব্য করে আলোচিত-সমালোচিত হয়েছেন। কটূক্তি ও বক্রোক্তি অনেক সময়েই শালীনতা, ভদ্রতা ও ভব্যতার সীমা অতিক্রম করেছে। রাজনীতিকে জনস্বার্থের বদলে পরিণত করা হয়েছে ব্যক্তিগত হিংসা, ক্ষোভ ও জিঘাংসা চরিতার্থ করার চারণভূমিতে।
রাজনীতিতে যখন সারবস্তু বা মৌলিক কিছু না থাকে, তখন ব্যক্তিগত বিষয়াবলি সামনে চলে আসে বা সামনে নিয়ে আসা হয়। নীতিগত প্রশ্নে জোরালোভাবে অবস্থান করতে না পেরে অনেকে ব্যক্তিগত বিষয় নিয়ে চটক, চমক ও উত্তেজনার সঞ্চার করেন। ফলে রাজনৈতিক রণনীতি ছেড়ে ব্যক্তিগত আক্রমণকে হাতিয়ার করা হয়, যা রাজনৈতিকভাবে সবলতা নয়, দুর্বলতার লক্ষণ।
রাজনৈতিক বিরোধের গণ্ডি অতিক্রম করে প্রতিপক্ষকে ব্যক্তিগত পরিসরে কোনও প্রকৃত বা কাল্পনিক দুর্বলতা বা খামতি নিয়ে আক্রমণ করার কারণ একটু তলিয়ে দেখলেই স্পষ্ট দেখা যায়। এর একটি প্রধান কারণ এই যে, বাংলাদেশে কিছু ব্যতিক্রম বাদ দিলে রাজনীতিতে ব্যক্তিই মুখ্য। দলও কখনো কখনো ব্যক্তির ছায়ায় ম্লান হয়ে পড়ে। 'ব্যক্তির চেয়ে দল বড়' কথাটা শুনতে ভালো হলেও কাজের বেলায় অকেজো। ফলে দল বা রাজনীতির বদলে ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ বন্দনা ও নিন্দার কেন্দ্রস্থলে চলে আসেন।
দলের ঊর্ধে ব্যক্তির অবস্থান শুধু বাংলাদেশেই নয়, উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রায়-সর্বত্রই বিরাজমান। যেমন ভারতে ক্ষমতাসীন বিজেপি প্রকৃত প্রস্তাবে নরেন্দ্র মোদী এবং তাঁর দলে পরিণত হয়েছে। সত্তরের দশকে ক্ষমতাসীন কংগ্রেসও ইন্দিরা গান্ধির দল ভিন্ন অন্য কিছুই ছিল না। পশ্চিমবঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, তামিলনাড়ুতে জয়ললিতা, উত্তরপ্রদেশে মায়াবতী বা মুলায়ম সিংহ যাদবকে সরিয়ে দিলে তাঁদের দলগুলোর কয় সহস্রাংশ অবশিষ্ট থাকে, সেটাই বড় প্রশ্ন। বস্তুত, অনেক ক্ষেত্রেই দল এবং নেতার মধ্যে বিভেদরেখাটি ক্ষীণ হতে হতে প্রায় মিলিয়ে গিয়েছে। কাজেই, প্রতিপক্ষ যখন আক্রমণ শানায়, তার নিশানায় দলের তুলনায় নেতা বেশি আসেন, এটাই স্বাভাবিক।
পাশাপাশি, হাল আমলের নেতাদের ব্যক্তিগত জীবনে আড়ম্বরহীনতা ও ‘সাধারণ’ জীবনযাপন বলতে কিছুই অবশিষ্ট নেই। তাঁদের রাজনৈতিক পরিচয়ের সহায়ক হয়েছে ব্যক্তিগত এমন বহু বিষয়, যার মধ্যে দুর্নীতি, অনিয়ম, স্বজনপ্রীতি, লুটপাট, অর্থ পাচার, দখল ও কেলেঙ্কারির মতো মারাত্মক বিষয়ও রয়েছে। ফলে রাজনীতির কারণের চেয়ে ব্যক্তিগত কারণে তাঁরা অধিকতর আলোচিত হয়ে থাকেন। এভাবেও রাজনীতির জায়গা দখল করে রাজনীতিবিদগণের ব্যক্তিগত বিষয়সমূহ। আর তা নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে চলতে থাকে তীব্র বাহাস, যা অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শিষ্টতা ও শ্লীলতার সীমা অতিক্রম করে।
এমতাবস্থায়, রাজনীতিতে ব্যক্তিগত এবং সামাজিক, এই দুইটি পরিচয়কে পৃথক করা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। অতএব, যে রাজনীতিতে ব্যক্তিই মুখ্য এবং যে ব্যক্তির ব্যক্তিগত এবং সামাজিক পরিচয়ের মধ্যে বিভাজন রেখা নির্মাণ প্রায়-অসম্ভব, সেই রাজনীতিতে ব্যক্তি আক্রমণ নিতান্ত স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়।
তবে, একবার ব্যক্তিগত আক্রমণকে ‘স্বাভাবিক’ বলে মেনে নিলে তাকে নিয়ন্ত্রণ করাও দুষ্কর। তখন এসব বিষয় শিষ্টাচারের সমস্ত গণ্ডি অতিক্রম করে এক অকল্পনীয় অতলে গিয়ে পৌঁছায়। ফলস্বরূপ, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিসর হতে শিষ্টাচার কার্যত বিদায় গ্রহণ করে। সভ্য মানুষের গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক জীবনে সৌজন্য একটি অপরিহার্য বিষয়, এই সত্যটিও তখন কার্যক্ষেত্রে স্বীকার করা হয় না।
বিরূপ মন্তব্য, বিদ্বেষ ছড়ানো, ব্যক্তিগত আক্রমণ সুষ্ঠু গণতন্ত্রে ও সুশীল রাজনীতিতে বৃদ্ধি পায় সৌজন্য ও বিবেচনা বোধের অভাবের কারণে। তখন রাজনীতির ভাষা কদর্য ও নিম্নগামী হয়। নেতা-নেত্রীর রাজনৈতিক মূল্যবোধ সম্পর্কে গুরুতর প্রশ্নও উঠে তখন। নেতাদের অর্গলহীন কথাবার্তা শালীনতার সীমা ছাড়িয়ে অত্যন্ত কুরুচিকর আক্রমণের বিষয়ে পরিণত হয়। ফলে সাধারণ কর্মী-সমর্থকরাও আরো বেশি উস্কানি পেয়ে চরমভাবে বেপরোয়া হয়। আন্দোলন ও নির্বাচনের পরিবেশ তখন উত্তপ্ত ও হিংস্র রূপ পরিগ্রহ করে। রাজনীতির খেলাও তখন ব্যক্তিগত আক্রমণ আর প্রতি-আক্রমণের ক্ষেত্রে রূপান্তিত হয়।
দলগুলোর আন্দোলনকে সংলাপ ও সমঝোতার মাধ্যমে যুক্তিযুক্তভাবে মীমাংসা করে সুষ্ঠু নির্বাচনের পথে নিয়ে যাওয়াই যখন সরকার ও বিরোধীদলের সামনে প্রধান অগ্রাধিকারের বিষয়, তখন রাজনৈতিক দল বা নেতাদের একে অপরের দিকে কাদা ছোড়াছুড়ি, পারস্পরিক বিষোদাগার ও ব্যক্তিগত আক্রমণ গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য শুভবার্তা বহন করে না।
ড. মাহফুজ পারভেজ, অধ্যাপক-বিশ্লেষক।