ঢাকা, ২৫ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১২ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৫ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

অর্থ-বাণিজ্য

চিনির কৃত্রিম সংকট নজরদারির নির্দেশ

অর্থনৈতিক রিপোর্টার
২৫ অক্টোবর ২০২২, মঙ্গলবার

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) এ এইচ এম সফিকুজ্জামান বলেছেন, ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন চিনির কোনো ঘাটতি নেই। পর্যাপ্ত মজুত আছে। কিন্তু গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের কারণে অপরিশোধিত চিনি পরিশোধন করা যাচ্ছে না। প্রতিদিন গড়ে দেশে চিনির চাহিদা ৫ হাজার টন। কিন্তু এখন উৎপাদন হচ্ছে সাড়ে ৩ হাজার টন। ফলে দিনে চিনির ঘাটতি হচ্ছে দেড় হাজার টন। তাই উৎপাদন ও চাহিদার ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। আর এতে সরবরাহ কম হওয়ায় চিনির দাম বেড়েছে। গতকাল অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে চিনির সরবরাহ এবং মূল‍্য স্থিতিশীল রাখার লক্ষে‍্য চিনির মিল মালিক, রিফাইনারি, পাইকারি এবং খুচরা ব‍্যবসায়ীদের সঙ্গে একটি মতবিনিময় সভায় সফিকুজ্জামান এ তথ্য জানান।
এদিকে কোনো অসাধু চক্র চিনি মজুত করছে কিনা, তা খতিয়ে দেখার জন্য গোয়েন্দা সংস্থাকে সুপারিশ করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানটি তাদের এক প্রতিবেদনে এই সুপারিশ করেছে। 
এ ছাড়া চিনির বাজার স্থিতিশীল করতে মিল মালিক, রিফাইনারি প্রতিষ্ঠান ও পাইকারদের কাছে মজুত চিনি বাজারে ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বিজ্ঞাপন
গতকাল চিনিসহ নিত্যপণ্যের বিষয়ে বৈঠকের সময় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস এ তথ্য জানান। অবশ্য মঙ্গলবার থেকে বাজারে চিনির সংকট কেটে যাবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বেসরকারি চিনি সরবরাহকারী মিল মালিক ও চিনি ব্যবসায়ীরা।
ওদিকে চিনি নিয়ে কারসাজি ও কৃত্রিম সংকটকারীদের ধরতে দেশব্যাপী বিশেষ অভিযানে বেশি দামে চিনি বিক্রি, মজুতের অপরাধে ২৭৮ প্রতিষ্ঠানকে ১৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা জরিমানা করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠকে ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, চিনির দাম বাড়ার পরই বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে সারা দেশের বাজারগুলোতে অভিযান পরিচালনা করা হয়। পাঁচটি বড় বড় রিফাইনারিতে আমরা অভিযান পরিচালনা করেছি। যেসব জায়গায় আমরা অনিয়ম পাচ্ছি তাদের আইন অনুযায়ী শাস্তিসহ জরিমানা করছি। সফিকুজ্জামান বলেন, ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন চিনির কোনো ঘাটতি নেই। এখন পর্যন্ত যে চিনি মজুত আছে তা দিয়ে অন্তত তিন মাস চলা যাবে। তবে সমস্যা হচ্ছে গ্যাস-বিদ্যুতের সংকটের কারণে অপরিশোধিত চিনি পরিশোধন করা যাচ্ছে না। তাই উৎপাদন ও চাহিদার ঘাটতি সৃষ্টি হয়েছে। আমরা আলোচনা করে সমস্যা চিহ্নিত করেছি। আশা করছি খুব শিগগিরই চিনি সরবরাহ স্বাভাবিক হবে।

হঠাৎ চিনির দাম বাড়িয়ে দেয়া এটা সমন্বয়হীনতা কিনা জানতে চাইলে ভোক্তার মহাপরিচালক জানান, এখানে সমন্বয়হীনতার কিছু নেই। কারণ আমরা চাইলেই সবকিছু করতে পারি না, আমাদের সক্ষমতা দেখতে হবে। সবকিছু আমাদের নিয়ন্ত্রণে নেই। বিশ্ববাজারে এখন পণ্যের দাম ব্যাপক ওঠানামা করছে, এটা আমরা ইচ্ছা করলেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারি না। এ ছাড়া বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা নিয়ে সরকার বেশ তৎপর আছে। জানা গেছে, চাহিদার তুলনায় সরবরাহে ঘাটতির অজুহাতে হঠাৎ অস্থিতিশীল হয়ে উঠেছে দেশের চিনির বাজার। সংকটের কথা বলে সরকারের বেঁধে দেয়া মূল্যের চেয়ে ১০ থেকে ১৫ টাকা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে চিনি। অনেক এলাকায় প্যাকেটের চিনি উধাও হয়ে গেছে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলছে চাহিদা অনুযায়ী দেশে পর্যাপ্ত চিনি আমদানি হয়েছে, সংকট হওয়ার কোনো কারণ নেই।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সংকটের কথা বলে সপ্তাহের ব্যবধানে কেজিতে খোলা চিনির দাম বেড়েছে ১০ থেকে ১৫ টাকা। আর প্যাকেটজাত চিনি অনেক এলাকায় পাওয়া যাচ্ছে না। ক্রেতারা বলছেন, জনগণকে জিম্মি করে ফেলেছেন ব্যবসায়ীরা। তারা সরকারের কোনো নিয়মনীতি মানছেন না। নিজেদের ইচ্ছেমতো দাম বাড়াচ্ছেন। আর ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, বিদ্যুৎ ও গ্যাস সংকটের কারণে চিনির উৎপাদন কমেছে। যে কারণে বাজারে ঘাটতি দেখা দিয়েছে। রাজধানীর বাজারে বেশির ভাগ দোকানে খোলা চিনি বিক্রি হচ্ছে ১১০ টাকা কেজিতে। এক সপ্তাহ কিংবা ৩ দিন আগের কেনা চিনি কিছু কিছু দোকানে বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ১০৫ টাকা কেজিতে। বাজার ও দোকানগুলোতে প্যাকেটজাত চিনি পাওয়া যাচ্ছে না। এই দোকানগুলোতে এক সপ্তাহ আগেও চিনি বিক্রি হয়েছে ৯০-৯৫ টাকা কেজিতে। আর প্যাকেটজাত চিনি ছিল ৯৫ টাকা কেজি। গত ৬ই অক্টোবর সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় খোলা চিনি ৯০ টাকা এবং প্যাকেটজাত চিনির দাম ৯৫ টাকা নির্ধারণ করে দেয়। কিন্তু তা বাস্তবে কার্যকর হয়নি। বরং এখন উল্টো দাম বাড়ছে। 

মজুত চিনি বাজারে ছাড়তে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ: চিনির বাজার স্থিতিশীল করতে মিল মালিক, রিফাইনারি প্রতিষ্ঠান ও পাইকারদের কাছে মজুত চিনি বাজারে ছাড়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গতকাল চিনিসহ নিত্যপণ্যের বিষয়ে বৈঠকের সময় প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমেদ কায়কাউস এ তথ্য জানান। বৈঠকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, প্রতিযোগিতা কমিশন, জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরসহ সরকারি কয়েকটি সংস্থার প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় প্রধানমন্ত্রীর বরাত দিয়ে জানানো হয়, বর্তমানে চিনির মিল, রিফাইনারি প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে যে এক লাখ টন পরিশোধিত চিনি মজুত রয়েছে, তা আগামী দুইদিনের মধ্যে বাজারে সরবরাহ করতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আমাদের সক্ষমতা অনুযায়ী পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে। আশা করছি খুব শিগগিরই বাজার সরবরাহ স্বাভাবিক হয়ে যাবে।

২৭৮ প্রতিষ্ঠানকে ১৪ লাখ টাকা জরিমানা: চিনি নিয়ে কারসাজি ও কৃত্রিম সংকটকারীদের ধরতে দেশব্যাপী বিশেষ অভিযানে নামে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এ সময় বেশি দামে চিনি বিক্রি, মজুতের অপরাধে ২৭৮ প্রতিষ্ঠানকে ১৪ লাখ ৭৫ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়েছে। গতকাল জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে। গত ২২ ও ২৩শে অক্টোবর সারা দেশে চিনির বাজারে ১০৩টি তদারকি ও অভিযান করে এ জরিমানা করা হয়।  
চিনির মজুত খুঁজতে গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি: চিনির সংকটের কারণ খুঁজতে দেশব্যাপী অভিযান চালিয়েছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। কোনো অসাধু চক্র চিনি মজুত করছে কিনা, তা খতিয়ে দেখার জন্য গোয়েন্দা সংস্থাকে সুপারিশ করেছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। প্রতিষ্ঠানটি তাদের তদন্ত প্রতিবেদনে এই সুপারিশ করে। তদন্ত প্রতিবেদনে মিল পর্যায়ে এবং খুচরা, পাইকারি ও ডিলার পর্যায়ে কিছু অসঙ্গতির কথা বলা হয়। চিনির মিলগুলোতে মজুতকৃত চিনি পাওয়া যায়নি, তবে সক্ষমতার চেয়ে কম উৎপাদন, সাপ্লাই অর্ডারে মূল্য না লেখাসহ কয়েকটি অসঙ্গতির বিষয় পাওয়া গেছে। মেঘনা সুগার রিফাইনারির ৩ হাজার টন সক্ষমতা থাকলেও ২০ অক্টোবর তারা ১ হাজার ৯৭৪ টন চিনি উৎপাদন করেছে। সিটি সুগার ইন্ডাস্ট্রিজ উৎপাদনের সক্ষমতার প্রায় ৫০ শতাংশ কম উৎপাদন করেছে বলে তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়। আব্দুল মোনেম সুগার রিফাইনারির সক্ষমতা ৭০০ টন সক্ষমতা হলেও ২২শে অক্টোবর ৬৮৫ টন উৎপাদন ও সরবরাহ করেছে। এস আলম সুগার রিফাইনারি প্রতিদিন ৮-৯শ’ টন চিনি উৎপাদন করছে। তাদের উৎপাদিত চিনির ৫০ কেজির বস্তায় ক্রয়মূল্য লেখা থাকলেও বাজারে তা পাওয়া যায়নি। বাজার তদারকি করে সংস্থাটি জানতে পারে, সরকার নির্ধারিত মূল্যে বাজারে চিনি বিক্রি হচ্ছে না, আর সরবরাহ তুলনামূলকভাবে কম। এ ছাড়া প্যাকেটজাত চিনির সরবরাহ কম এবং কোথাও কোথাও প্যাকেটজাত চিনি খুলে বিক্রি করা হচ্ছে বেশি দামে। 

চিনির বাজার অস্থিতিশীলে ৭টি কারণ: চিনির বাজার অস্থিতিশীল হওয়ার পেছনে ৭টি কারণ দেখছে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর। এরমধ্যে আছে উৎপাদন ও সরবরাহ কম, পাকা ভাউচার না দেয়া, এলসি খোলার জটিলতা, মিল গেটে ট্রাকে চিনি লোডের ক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় জটিলতা, ডলারের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব, শুল্কহারের সমন্বয়, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য বিপণন ও পরিবেশক নিয়োগ আদেশ-২০১১ এর ফরম ‘ঘ’ অনুযায়ী, সাপ্লাই অর্ডারে একক মূল্য উল্লেখ না করা।
মিলমালিকদের প্রতিশ্রুতি: মঙ্গলবার থেকেই বাজারে চিনির সংকট কেটে যাবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন বেসরকারি চিনি সরবরাহকারী মিল মালিক ও চিনি ব্যবসায়ীরা। গতকাল জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে ব্যবসায়ীদের মতবিনিময় সভায় তারা এ প্রতিশ্রুতি দেন। রিফাইনারি মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ সুগার রিফাইনার্স এসোসিয়েশনের মহাসচিব এবং দেশবন্ধু সুগার রিফাইনার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম রহমান বলেন, আমরা একে আপরের সঙ্গে ব্লেম গেইম খেলছি। আমরা যদি এটাকে বিশ্লেষণ করি, তাহলে সবাইকে দায়ভার নেয়া উচিত।

তিনি বলেন, আমাদের যেগুলো সমস্যা ছিল, সেটা এখন সমাধান হচ্ছে। রাত থেকে মিলগুলোর সাপ্লাই স্বাভাবিক হয়ে যাবে। তারপর যদি কেউ চিনি না পান তবে আমাদের বলবেন, আমরা ব্যবস্থা করে দেবো। যেখানে চিনি নেই বলবেন, সরকার নির্ধারিত দামে দিয়ে দেবো। সমস্যা আর হবে না। সিটি গ্রুপের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, আমরা চাই সবাই পর্যাপ্ত পণ্য পাক। সমস্যা হয়েছে, সেটা এখন কথা বলে সমাধান হচ্ছে। ডিউটি কমানো হলে সেটা আরও ভালো হবে। কারণ প্রতিটি ক্রেতাকে ৩২ টাকা চিনিতে ডিউটি দিতে হচ্ছে। এটা চিনির দাম অনেক বাড়িয়ে দিচ্ছে।

অর্থ-বাণিজ্য থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

অর্থ-বাণিজ্য সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status