প্রথম পাতা
ডেটলাইন শ্রীলঙ্কা
সিঙ্গাপুর নয় সোমালিয়া
ক্রিশান্ত নেলসন, (বাত্তিকালোয়া) শ্রীলঙ্কা
১২ মে ২০২২, বৃহস্পতিবারঅর্থনীতি, সাক্ষরতার হার এবং জীবনযাত্রার মানের দিক থেকে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এক সময় এগিয়ে ছিল শ্রীলঙ্কা। কিন্তু বর্তমানে, বিশ্বের সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ অর্থনীতির দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম এই দেশটি। দেশটির জনগণ বলছেন, প্রথমে সরকার গুঁড়োদুধ বন্ধ করে দেয়। তারপর জ্বালানি সরবরাহ সীমিত করে দেয়। আর এখন এই ধারা শুরু হয়েছে বিদ্যুতে। আমরা শান্তিতে ঘুমাতে পারি না। সকালে যখন ঘুম থেকে উঠি, শুনতে পাই জ্বালানির দাম বৃদ্ধির নতুন খবর।
যে দেশকে এক সময় বিশ্বাস করা হতো যে তারা সিঙ্গাপুর বা এশিয়ার বিস্ময় হয়ে উঠছে, তারা এখন ধীরে ধীরে দক্ষিণ সুদান বা সোমালিয়া হয়ে উঠছে। খাদ্য, জ্বালানি বা বিদ্যুৎ কিছুই নেই দেশটিতে। সাম্প্রতিক অর্থনৈতিক সংকট এই ছোট দ্বীপরাষ্ট্রকে বিধ্বস্ত করে দিয়েছে। তামিলদের বিরুদ্ধে গৃহযুদ্ধের সময়ের চেয়েও খারাপ অবস্থা এখন।
বাত্তিকালোয়ার একটি শীর্ষ স্থানীয় স্কুলের ৬ষ্ঠ গ্রেডের শিক্ষার্থী জোয়ানা বলেছেন- আমাদের টার্ম পরীক্ষার সময় এখন। জীবনে প্রথমবার আমি মোমবাতির আলো ব্যবহার করে পড়াশোনা করছি। কখনোই এভাবে পড়তে অভ্যস্ত নই। পড়তে বসে ঘামি। অন্যদিকে মশা কামড়ায়। ফলে পড়ালেখায় মনোযোগ দিতে পারছি না। ওদিকে এরই মধ্যে কাগজ ও কালির সংকটে প্রশ্নপত্র তৈরি করা যায়নি। ফলে বেশকিছু পরীক্ষা এ জন্য স্থগিত করা হয়েছে। এসব জিনিস বাইরে থেকে কেনার জন্য দেশে পর্যাপ্ত ডলার নেই। কাগজের সংকট শুধু শিক্ষা ক্ষেত্রকেই ক্ষতিগ্রস্ত করছে এমন নয়। এতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রিন্ট মিডিয়াও। ইংরেজি ভাষার দ্য আইল্যান্ড এবং এর সিংহলি সংস্করণ ডিভাইনা হলো শ্রীলঙ্কার দুটি বড় সংবাদপত্র। তারাও তাদের ছাপা সংস্করণ স্থগিত করেছে। অন্যরা কমিয়ে দিয়েছে পৃষ্ঠা সংখ্যা।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকটে ভুগছে শ্রীলঙ্কা। ফলে জ্বালানি, খাদ্য ও ওষুধের মতো প্রয়োজনীয় পণ্য আমদানি করতে পারছে না তারা। অপর্যাপ্ত জ্বালানির কারণে প্রতিদিন ১০ ঘণ্টা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকে দেশটি। এতে কেবল গৃহস্থালি নয়, দেশের অনেক শিল্পকেও ক্ষতিগ্রস্ত করছে। রয়টার্সের হিসাব অনুযায়ী, দুই বছরে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৭০ শতাংশ কমেছে শ্রীলঙ্কার। এর ফলে শ্রীলঙ্কার রুপির অবমূল্যায়ন ঘটেছে।
বাত্তিকালোয়ার একটি বেসরকারি হাসপাতালের সুপারভাইজার রবি। তিনি বলেন, ডিজেল পেতে আমাদের বহু ঘণ্টা লাইনে অপেক্ষা করতে হয়। কিন্তু তারা (বিতরণকারীরা) শুধু গাড়ির ট্যাঙ্কেই ডিজেল দেয়। আমাদের বৈদ্যুতিক জেনারেটর সচল রাখার জন্য এই ডিজেল প্রয়োজন। কিন্তু আমাদেরকে ডিজেল দেয়ার ক্ষেত্রে তারা হাসপাতাল থেকে ডিজেলের জন্য অনুরোধপত্র দেখাতে বলেন। এমন আবেদন করার পরেই শুধু তারা ক্যানে করে আমাদেরকে ডিজেল দেন। বিতরণ ব্যবস্থা তদারকির জন্য প্রতিটি ফিলিং স্টেশনে সশস্ত্র সেনাদের মোতায়েন করা হয়েছে।
সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন দিনমজুররা। চাহিদা মেটাতে তাদেরকে বহুবিধ কাজ করতে হচ্ছে। মোট দুই কোটি ২০ লাখ জনসংখ্যার মধ্যে শ্রীলঙ্কার কেন্দ্রীয় ব্যাংক ৫০ লাখ পরিবারকে নিম্ন আয়ের পরিবার হিসাবে চিহ্নিত করেছে। কোভিড-১৯ লকডাউনের সময়, প্রতি পরিবারের জন্য ৫০০০ টাকা সহায়তা দিয়েছে সরকার। জীবনযাত্রার খরচ বহন করতে না পেরে এরই মধ্যে মাছধরা বোটে করে উত্তর শ্রীলঙ্কার বহু মানুষ ভারতে প্রবেশ শুরু করেছে।
অর্থনৈতিক এই সংকট সমাধানের প্রচেষ্টা হিসেবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্থানীয় মুদ্রা রুপির নতুন নোট ছাপিয়েছে। এর ফলস্বরূপ ফেব্রুয়ারিতে আকাশছোঁয়া শতকরা ১৭.৫ ভাগ মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়। এটা শ্রীলঙ্কার অর্থনীতিকে আরও পঙ্গু করে দিয়েছে। শুধু বৈদেশিক ঋণ মোকাবিলা করার জন্য এ বছর ৭০০ কোটি ডলার প্রয়োজন। দেশের বর্তমান বৈদেশিক রিজার্ভ মাত্র ২৩০ কোটি ডলার। এই মুদ্রা সংকট থেকে উত্তরণের জন্য ভারত, আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক এবং আবার চীন ও বাংলাদেশের কাছ থেকে আরও ঋণ চাইছে শ্রীলঙ্কা।
ইতিমধ্যে চাল, আটা, ডাল, চিনি এবং ওষুধের মতো প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আমদানি করতে ১০০ কোটি ডলার ঋণ দিয়েছে ভারত। ভারতের কাছ থেকে আরও ১৫০ কোটি ডলার পাওয়া নিয়ে আলোচনা চলছে। সদ্য বিদায়ী অর্থমন্ত্রী বাসিল রাজাপাকসের সম্প্রতি নয়াদিল্লি সফর এই আলোচনা হয়েছে। আগের ১০০ কোটি ডলারের বাইরে চীনের কাছ থেকে আরও ১৫০ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার চেষ্টা করছে শ্রীলঙ্কা। বাংংলাদেশের কাছ থেকে ২৫ কোটি ডলার ঋণ পাওয়ার চেষ্টা করছে তারা। তবে বাংলাদেশ আগের ঋণ পরিশোধের সময় বাড়াতে রাজি হয়েছে। উদ্ধার পরিকল্পনার জন্য আইএমএফের সঙ্গে আলোচনা করার এবং দেশের অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের জন্য বিশ্বব্যাংকের সহায়তা চাওয়ার পরিকল্পনা করছে শ্রীলঙ্কা।
শক্তিশালী পর্যটনভিত্তি অর্থনীতি শ্রীলঙ্কার। এ খাত থেকে শত শত কোটি ডলার আয় হয়। দেশটি যখন তার যুদ্ধ-বিধ্বস্ত অর্থনীতি থেকে পুনরুদ্ধার করছিল, তখন ইস্টার সানডে বিস্ফোরণ পর্যটন খাতকে প্রভাবিত করে এবং এর অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছে। এ থেকে পুনরুদ্ধার করার সময় করোনা মহামারি আবার দেশটির অর্থনীতির মেরুদণ্ডে আঘাত করে ও তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে তেলের বাজার অস্থির হয়ে ওঠে। দাম বেড়ে যায়।
যদিও সরকার এই সমস্যার মূল কারণ হিসেবে বৈশ্বিক অনিশ্চয়তাকে দায়ী করে, তবে এটা স্পষ্ট যে এর প্রধান কারণ হল পূর্ববর্তী সরকারের দুর্বল পরিকল্পিত বিনিয়োগ ব্যবস্থা। এর আগে ক্ষমতায় প্রেসিডেন্ট হিসেবে ছিলেন মাহিন্দ রাজাপাকসে। তিনি হাম্বানটোটা বন্দর এবং মাত্তালা বিমানবন্দরে বিপুল পরিমাণ অর্থ বিনিয়োগ করেছিলেন। কিন্তু সেখান থেকে সুফল এসেছে খুবই কম, অথবা কিছুই অর্জিত হয়নি। তবে তিনি বিদ্যমান বন্দরগুলোতে বিনিয়োগ করলে তাতে ভালো সুফল পেতেন।
এখন যখন দেশ আগের সব ঋণের দায় কাঁধে বহন করছে, তখন আমরা নতুন ঋণের দিকে যাচ্ছি। এতে দেখা যাচ্ছে, শ্রীলঙ্কা কীভাবে ঋণের দুষ্টচক্রে আটকা পড়েছে।
(এই লেখাটি সম্প্রতি ন্যাশনাল হেরাল্ডে প্রথম প্রকাশিত হয়। সেখান থেকে অনুবাদ)