শরীর ও মন
বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস
ডা. ইফতিখার মাহমুদ
(১ বছর আগে) ১০ অক্টোবর ২০২২, সোমবার, ৮:৫৪ অপরাহ্ন
পৃথিবীর প্রতিটি মানুষের সুস্বাস্থ্য উপভোগ করার অধিকার আছে, কিন্তু সুস্থ্য মন ছাড়া সুস্বাস্থ্য উপভোগ করা সম্ভব না। আজ ১০ই অক্টোবর, বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবস। এই বছর, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, অন্যান্য বেশ কয়েকটা বৈশ্বিক মানসিক স্বাস্থ্য সংস্থার সাথে সমন্বয় করে সার্বিক প্রচারণা চালাচ্ছে, যার মুল স্লোগান হলো- “Move for mental health, let us invest” অর্থাৎ চলুন আমরা মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য বিনিয়োগ করি।
মানসিক স্বাস্থ্য আমাদের সুস্থতার একটি অবিচ্ছেদ্য অংগ। মানসিক স্বাস্থ্য ভাল না থাকলে সমাজে পূর্ণ সক্ষমতায় অবদান রাখা অসম্ভব। মানসিক অসুস্থতা বিভিন্ন রকমের হতে পারে, যেমন হতাশা, বিষন্নতা, মানসিক অস্থিরতা, মস্তিষ্ক বিকৃতি এমনকি অত্নহত্যার প্রবনতা। একজন ব্যক্তির দুর্বল মানসিক স্বাস্থ্য সমাজে এবং পরিবারে বিশাল ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। মানসিক রোগের শিকার সমাজের যে কেউ হতে পারে, তবে যারা দরিদ্র্য, সহিংসতা ও বৈষম্যসহ বিভিন্ন প্রতিকুল পরিস্থিতির সন্মুখীন হন তারা বিভিন্ন মানসিক সমস্যার উচ্চ ঝুঁকিতে থাকেন। বিশেষ করে শিশু বয়সের বিকাশ কালীন সময়ে যে সব বাচ্চা বৈরী পরিবেশের শিকার তারা গভীর মানসিক ক্ষতির সন্মুখীন হতে পারে। সৌভাগ্যবশত; বেশিরভাগ মানুষের জীবনের বিভিন্ন পর্যায়ে ইতিবাচক পরিবেশের কারণে তারা প্রতিকূল পরিবেশ কাটিয়ে উঠেন এবং সুস্থ জীবন উপভোগ করতে সক্ষম হন।
২০১৯ সালের শেষে বিশ্বব্যাপী কোভিড মহামারীর আবির্ভাবের কারণে সারাবিশ্ব একটি প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে অতিবাহিত করেছে যা লাখ লাখ মানুষের প্রাণহানি ঘটায় এবং অসুস্থতা নিয়ে আসে। এই মহামারীর আঘাতে সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন যারা দরিদ্র, প্রতিবন্ধী, অথবা বিভিন্ন শারীরিক স্বাস্থ্য জটিলতায় আক্রান্ত।
সমাজে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার অর্থনৈতিক পরিণতি খুবই ক্ষতিকারক, বিশেষ করে রোগাক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা ব্যয়, কর্মক্ষমতা হ্রাস ইত্যাদি হিসেব করা হলে। দুর্ভাগ্যবশতঃ, নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি, তথ্যের অভাব, গবেষণার স্বল্পতা ইত্যাদির কারণে আমাদের সমাজে মানসিক রোগীকে উপেক্ষা করা হয়। প্রায়শঃ মানসিক রোগের তুলনায় অন্যান্য শারীরিক রোগকে অধিকতর গুরুত্বের সাথে দেখা হয়। বিশ্বব্যাপী মানসিক চিকিৎসা বিশেষজ্ঞের প্রচণ্ড স্বল্পতা বিদ্যমান, বিশেষ করে অনুন্নত এবং স্বল্পোন্নত দেশে মনো চিকিৎসকের সংখ্যা উদ্বেকজনকভাবে কম। উদাহরণ স্বরূপ, বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের জন্য রয়েছে মাত্র ২৭০ জন বিশেষজ্ঞ মনোরোগ চিকিৎসক।
সমাজে মানসিক রোগীদের বৈষম্যের কারণে অনেকেই নীরবে রোগ নিয়ে বেঁচে থাকেন, চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন না। বিশ্বখ্যাত বৃটিশ জার্নাল Lancet এর সাম্প্রতিক একটা নিবন্ধে বলা হয়েছে যে বর্তমানে বিশ্বব্যাপী ১০০ কোটি মানুষ বিভিন্ন মাত্রার মানসিক রোগে ভুগছেন, তার মানে প্রতি ৮ জন মানুষের মাঝে ১ জন মানুষ মানসিক সমস্যার শিকার। এটার নেতিবাচক প্রভাব বৈশ্বিক অর্থনীতিতে প্রবল। উদাহরণ স্বরূপ, শুধুমাত্র ২ টি রোগ, বিষণ্ণতা ও উদ্বেগ, বিশ্ব অর্থনীতির এক ট্রিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিমাণ ক্ষতি করে। বিশেষজ্ঞদের মতে সব মানসিক রোগের কারণে ২০৩০ সাল নাগাদ বিশ্ব প্রতিবছর ৬ ট্রিলিয়ন ডলার লোকসানের সন্মূখীন হবে। তাই মানসিক স্বাস্থ্যে বিনিয়োগ বিশ্বকে বিরাট অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে রক্ষা করতে পারে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার একটি প্রতিবেদন অনুসারে, মানসিক স্বাস্থ্যে বিনিয়োগের তিনটি অন্যতম কারন হলো – জনস্বাস্থ্যের উন্নতি নিশ্চিত করা, মানবাধিকার সমুন্নত রাখা এবং আর্থসামাজিক উন্নয়ন। মানসিক রোগীরা বিশ্বব্যাপী বঞ্চনার শিকার হন, যেমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বৈষম্য, কর্মসংস্থানের অভাব, সামাজিক নিগ্রহ ইত্যাদি। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মানসম্মত সেবা বাস্তবায়নের মাধ্যমে রোগী এবং তার পরিবারের উপর একটি ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করা সম্ভব।
মানুষ যখন মানসিকভাবে সুস্থ্য থাকে এবং একটি সহায়ক পরিবেশে বাস করতে পারে তখন তার কর্মক্ষমতা সমাজের অর্থনৈতিক ও সার্বিক উন্নয়নে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। গবেষণায় দেখা গেছে, মানসিক স্বাস্থ্যে অর্থনৈতিক বিনিয়োগ সমাজে উৎপাদনশীলতা বহুগুণে বৃদ্ধি করে এবং সার্বিক গুণগত প্রবৃদ্ধি আনতে সক্ষম হয়। ২০১৮ সালে প্রকাশিত Lancet Commission এর সুপারিশ মতে, দেশের উচ্চ শিক্ষার প্রতিষ্ঠানসমূহ, জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থাগুলো, উন্নয়ন সহযোগী ব্যাংকসমূহ, বেসরকারি খাত ও সুশিল সমাজ একত্র হয়ে কাজ করলে মানসিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার প্রভুত উন্নতি হবে। তাই সবাইকে অংশীদারিত্বের মাধ্যমে যৌথভাবে কাজ করার আহ্বান জানানো হয়েছে।
যে কোন দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে শক্তিশালী করার ক্ষেত্রে সরকারের নীতি নির্ধারকদের ভূমিকা সবচেয়ে বেশি, এটি দেশের সব মানুষের জন্য একটি শক্ত ভিত্তি স্থাপনের জন্য অপরিহার্য। উপযুক্ত নীতি নির্ধারণ, নেতৃত্ব, প্রয়োজনীয় অর্থলগ্নি, জনসচেতনতা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে সরকারী কাঠামোর সহযোগিতার কোন বিকল্প নাই। মানসিক স্বাস্থ্য পরিচর্যার জন্য সরকারকে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ করতে হবে। বর্তমানে বিশ্বব্যাপী মানসিক স্বাস্থ্যের বরাদ্দ অত্যন্ত অপ্রতুল। এটি সমস্ত স্বাস্থ্যবাজেটের ২ শতাংশেরও কম। অনুন্নত দেশগুলোতে বরাদ্দের পরিমাণ নগণ্য।
যেহেতু বিশ্বব্যাপী মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের একটি প্রচণ্ড ঘাটতি রয়েছে, তাই প্রয়োজন অনুপাতে আরও প্রশিক্ষণের ক্ষমতা বাড়ানোর চেষ্টা করা আবশ্যক। কিন্তু খরচ ও অন্যান্য সীমাবদ্ধতার কারণে এটা একটা কঠিন চ্যালেঞ্জ হতে পারে। অনেক বিশেষজ্ঞদের মতে, এই সমস্যার একটি সহজতম সমাধান হলো দেশব্যাপী প্রাথমিক চিকিৎসা ব্যবস্থার সাথে সস্পৃক্ত সকল শ্রেণীর চিকিৎসক, নার্স, মিডওয়াইফ এবং সকল প্রকার স্বাস্থ্য কর্মীদের বিভিন্ন মেয়াদি স্বীকৃত প্রশিক্ষণের আওতায় নিয়ে আসা। তাহলে সমাজের সর্বস্তরের জনগণের কাছে প্রাথমিক মানসিক স্বাস্থ্যসেবা সহজেই পৌছানো সম্ভব হবে। দেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার সাথে মানসিক স্বাস্থ্যকে অন্তর্ভুক্ত করে সমাজের সবাইকে সেবার আওতায় আনার ব্যাপারে বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা জোরালো সুপারিশ করেছে।
মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে আমাদের সমাজে যে নেতিবাচক দৃষ্টিভংগী রয়েছে তার পরিবর্তন অত্যন্ত প্রয়োজন। এই ব্যাপারে পাবলিক-প্রাইভেট অংশীদারিত্বের মাধ্যমে সমাজের সর্বস্তরে জোরালো প্রচারের কাজ করে যেতে হবে যাতে করে মানসিক রোগী সমাজে বৈষম্যের স্বীকার না হয়। সমাজকে মানসিক স্বাস্থ্যের ধরণ সম্পর্কে অবহিত করতে হবে। এটা শুধুমাত্র উদ্বেগ বা বিষন্নতার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়, মাদকাসক্তি, আত্বহত্যার মতো অত্যন্ত মারাত্বক বিষয়গুলোও মানসিক রোগের প্রকাশ।
শৈশব ও কৈশোর মানসিক সুস্থ্যতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ সময়। যত্নশীল লালন-পালন, সহায়ক পরিবেশ ভবিষ্যতের মানসিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত সুরক্ষামূলক হতে পারে। এছাড়াও কর্মক্ষেত্রে সবার মানসিক স্বাস্থ্যের সুরক্ষার জন্য আইন ও নীতিমালা তৈরি করা এবং বস্তবায়ন করা সরকারী ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর বড় দায়িত্ব।
সবশেষে বলতে হয়, সবার মানসিক স্বাস্থ্য নিশ্চিত করা দেশের সকল সাধারণ নাগরিকের দায়িত্ব। অসহায় মানুষের সাথে সদয় এবং সহানুভূতিশীল আচরণ করতে হবে, তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। সমাজের সুবিধা বঞ্চিত মানুষগুলোর ব্যাপারে আমাদের নিজেদেরকে সংবেদনশীল করতে হবে, পাশাপাশি আমাদের পরিবারের সদস্যদেরকে বিশেষ করে সন্তানদেরকে সহনশীলতা শেখাতে হবে। যদি আমরা আমাদের বঞ্চিত মানুষের পাশে না দাড়াই তবে ঔষধ বা উন্নত স্বাস্থ্য সেবা, কোনটাই তাদের বাঁচাতে পারবে না এবং এটা আমাদের সমাজের জন্য ক্ষতির কারন হবে। আসুন আমরা সবাই আমাদের সমাজের সবার প্রতি সহমর্মিতা দেখাই, এবং একটি সুস্থ্য, সুখী, সমৃদ্ধিশালী সমাজ গড়ে তুলি। সবাইকে বিশ্ব মানসিক স্বাস্থ্য দিবসের শুভেচ্ছা। সবাই সুস্থ থাকুন।
লেখক: শিশুস্বাস্থ্য ও জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ। প্রতিষ্ঠাতা, হোপ ফাউন্ডেশন।