দেশ বিদেশ
হৃদরোগ প্রতিরোধে জনস্বাস্থ্যবান্ধব নীতি প্রণয়ন জরুরি
অধ্যাপক সোহেল রেজা চৌধুরী
(১ বছর আগে) ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২২, বুধবার, ৬:২২ অপরাহ্ন
সর্বশেষ আপডেট: ৬:২৬ অপরাহ্ন
২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২, বিশ্ব হার্ট দিবস। এবছর দিবসটির প্রতিপাদ্য করা হয়েছে—হৃদয় দিয়ে হৃদয়কে ভালোবাসুন, প্রকৃতি ও পরিবেশকে রক্ষা করুন। অর্থাৎ, হৃদরোগের সাথে আমাদের প্রকৃতি ও পরিবেশের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। বর্তমানে বিশ্বজুড়ে সবচেয়ে বড় ঘাতক ব্যাধি হচ্ছে হৃদরোগ। এই রোগে প্রতিবছর বিশ্বে ১ কোটি ৮৬ লক্ষের বেশি মানুষ মৃত্যুবরণ করে। এনসিডি কান্ট্রি প্রোফাইল ২০১৮ অনুসারে, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় পৌনে দুই লক্ষ মানুষ হৃদরোগে মারা যান, যা দেশের মোট মৃত্যুর ৩০ ভাগ।
হৃদরোগের পিছনে অনেকগুলো ঝুঁকি কাজ করে, যার মধ্যে অনেকগুলো আমাদের জীবনাচরণজনিত, যেমন : তামাক ব্যবহার, কায়িক শ্রমের অভাব, সুষম খাদ্য গ্রহণে অসেচতনতা, অতিরিক্ত লবণ ও চিনিজাতীয় খাবার গ্রহণ ইত্যাদি। এর পাশাপাশি পরিবেশ, বিশেষ করে বায়ুদূষণ হৃদরোগের অন্যতম কারণ। বিশ্বজুড়ে হৃদরোগে মোট মৃত্যুর ২৫ ভাগের পিছনে দায়ী বায়ুদূষণ। তাই হৃদরোগ প্রতিরোধে পরিবেশ দূষণ বিশেষ করে বায়ুদূষণ কমাতে উদ্যোগ নিতে হবে।
হৃদরোগীদের বড় একটি অংশ অকালমৃত্যুর শিকার হন, যা আমরা চাইলে সহজেই প্রতিরোধ করতে পারি। আমাদের মনে রাখা দরকার, হৃদরোগের মতো যেকোনো অসংক্রামক রোগের চিকিৎসার চাইতে তা প্রতিরোধ করা বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
হৃদরোগসহ বিভিন্ন অসংক্রামক রোগের পিছনে অন্যতম প্রধান কারণ তামাক ব্যবহার। এমনকি পরিবেশ দূষণের পিছনেও বড় রকমের দায় রয়েছে তামাকের। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভে (গ্যাটস) ২০১৭ অনুসারে, বাংলাদেশে প্রায় ৩৫.৩% (৩ কোটি ৭৮ লক্ষ) প্রাপ্তবয়স্ক (১৫ বছর বা তার বেশি) কোনো না কোনো প্রকার তামাক ব্যবহার করে। তামাক ব্যবহারের প্রবণতা শহরাঞ্চলের তুলনায় (২৯.৯%) গ্রামাঞ্চলে বেশি (৩৭.১%)। তামাকমুক্ত বাংলাদেশ অর্জন করতে হলে এই বিপুল সংখ্যক মানুষকে তামাক ছাড়াতে হবে। এজন্য সবচেয়ে জরুরি জাতীয়ভাবে তামাক নিবৃত্তকরণ সেবা ব্যবস্থা গড়ে তোলা।
পাশাপাশি নতুন করে তামাক ব্যবহার থেকে মানুষকে বিরত রাখতে শক্তিশালী তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন প্রণয়ন করাটাও জরুরি। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় সম্প্রতি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। আইনটি যতোদ্রুত সম্ভব সংশোধন করা গেলে তা নতুন প্রজন্মকে তামাক ব্যবহার শুরু করা থেকে বিরত রাখতে সহায়ক হবে।
তামাক নিয়ন্ত্রণের সাথে সাথে প্রক্রিয়াজাত খাবারে লবণের পরিমাণ নির্ধারণ করে দেওয়া জরুরি। অতিরিক্ত লবণ উচ্চ রক্তচাপের কারণ, যা থেকে পরবর্তীতে হৃদরোগ হওয়ার ঝুঁকি অনেক বেড়ে যায়। ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন অব বাংলাদেশের একটি গবেষণায় দেখা গেছে, বাজারে বহুল প্রচলিত প্রক্রিয়াজাত প্যাকেট খাবার যেমন : চিপস, বিস্কুট, চানাচুর ইত্যাদির ৬১ শতাংশে নিরাপদ মাত্রার চেয়ে বেশি, ক্ষেত্রবিশেষে দ্বিগুণ লবণ রয়েছে, যা জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি। তাই যতোদ্রুত সম্ভব এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় নীতিমালা প্রণয়ন করা দরকার। এর পাশাপাশি ট্রান্সফ্যাট নিয়ন্ত্রণ প্রবিধানমালা বাস্তবায়ন, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণের মতো কাজগুলোতেও নজর দেওয়া জরুরি।
সবশেষে এটা বলা যায় যে, ব্যক্তি পর্যায়ে সুষম ও পুষ্টিকর খাদ্যাভ্যাস যেমন জরুরি, একইভাবে জনস্বাস্থ্যবান্ধব নীতিমালাও তেমন গুরুত্বপূর্ণ। হৃদরোগ প্রতিরোধে ব্যক্তির নিজের সচেতন হতে হবে—নিয়মিত ব্যায়াম, তামাক বর্জন, অতিরিক্ত চিনি ও লবণ পরিহার, দুশ্চিন্তা না করা, নিয়মিত শাক-সবজি খেতে হবে। অন্যদিকে সরকারের উচিৎ স্বাস্থ্য সহায়ক নীতি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা।
লেখক: বিভাগীয় প্রধান, রোগতত্ত্ব ও গবেষণা বিভাগ ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল ও রিসার্চ ইনস্টিটিউট।