ঢাকা, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার, ৪ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

শেষের পাতা

লোডশেডিং ও জ্বালানির কারণে সংকটে পোল্ট্রি খাত

এম এম মাসুদ
১৯ আগস্ট ২০২২, শুক্রবার
mzamin

চলমান বৈশ্বিক সংকটে বিশ্ববাজারে পোল্ট্রি শিল্পের কাঁচামালের নানা উপকরণের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। এ ছাড়া এখনো পুরোপুরিভাবে করোনা মহামারির ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারেনি খাতটি। এরমধ্যে বর্তমান লোডশেডিং এবং জ্বালানির রেকর্ড পরিমাণে মূল্যবৃদ্ধিতে সংকট আরও চরম আকার ধারণ করেছে। প্রতিদিন ৮-১০ ঘণ্টার লোডশেডিংয়ের কারণে পোল্ট্রি বাচ্চা, মাংস ও ডিমের উৎপাদন ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। উৎপাদন কমে যাওয়ায় তৈরি হয়েছে সরবরাহ ঘাটতি। এ ছাড়া জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধিতে বাড়তি উৎপাদন খরচ ও পরিবহন ব্যয় যুক্ত হয়ে হু হু করে বাড়ছে মুরগি ও ডিমের দাম। ফলে উৎপাদন ব্যয় নিয়ন্ত্রণে রাখতে হিমশিম খাচ্ছেন উদ্যোক্তারা। এ পরিস্থিতিতে পোল্ট্রি শিল্পের কাঁচামাল, খাদ্য ও পরিবহনে ভর্তুকি সুবিধা চান বাংলাদেশ পোল্ট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ সেন্ট্রাল কাউন্সিল (বিপিআইসিসি)।  ঢাকার বাজারে বর্তমানে এক কেজি ব্রয়লার মুরগি কিনতে খরচ করতে হচ্ছে ১৯০-২০০ টাকা। বেড়েছে ডিমের দামও।

বিজ্ঞাপন
এক হালি মুরগির ডিম বিক্রি হয়েছে ৫৫ টাকার উপরে। অর্থাৎ একটি ডিমে ভোক্তাকে গুনতে হয়েছে ১৪ টাকা। তবে কিছুটা কমতে শুরু করেছে ডিমের দাম। এদিকে চাহিদা কমে যাওয়ায় হ্যাচারিতে বাচ্চা উৎপাদন কমেছে প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ। লোডশেডিংয়ে জেনারেটর খরচ বেড়েছে। পরিবহন খরচ বেড়েছে ২৫-৩০ শতাংশ।  বিপিআইসিসির সভাপতি মসিউর রহমান বলেন, এ খাতের উদ্যোক্তাদের সরকারি প্রণোদনাসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দিতে হবে। 

খাদ্যের কাঁচামাল আমদানিতে শুল্ক কর কমাতে হবে। তা না হলে সস্তায় ভোক্তাকে ডিম বা মুরগি দেয়া সম্ভব হবে না। তিনি বলেন, এ খাতের পুরোনো এবং নতুন উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের জন্য যন্ত্রপাতি আমদানির ক্ষেত্রে শূন্য শুল্ক সুবিধা দিতে হবে।  পোল্ট্রি খাতের উদ্যোক্তারা জানান, ডিম থেকে বাচ্চা তৈরিতে ইনকিউবেটরসহ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রিত কক্ষে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুতের প্রয়োজন হয়। চলমান লোডশেডিংয়ের কারণে ব্রয়লারের বাচ্চা উৎপাদন বিঘ্নিত হচ্ছে। জেনারেটর চালিয়ে উৎপাদন অব্যাহত রাখলেও, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় উৎপাদন ব্যয়ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে খামারিরা মুরগির বাচ্চা কিনতে ভয় পাচ্ছে। কারণ একটি খামারে বিদ্যুতের নিরবিচ্ছিন্ন সরবরাহ দরকার। ৮-১০ ঘণ্টার লোডশেডিংয়ের প্রভাব মোকাবিলায় ছোট খামারিরা জেনারেটর ব্যবহার করতে পারছেন না। ফলে অতিরিক্ত গরমের কারণে অনেকের মুরগি মারা যাচ্ছে। খরচ বহন করতে না পেরে অনেকেই উৎপাদন বন্ধ করে দিচ্ছে। যে কারণে সরবরাহে সংকট তৈরি হয়েছে।  খামারি আরমানুর রহমান বলেন, এলাকার ছোট ও মাঝারি যত খামারি আছে অনেকেই বিদ্যুতের সমস্যার কারণে উৎপাদন বন্ধ করে দিচ্ছে। কারণ উচ্চ দামের জ্বালানি দিয়ে জেনারেটর চালিয়ে খরচ কুলাতে পারছে না। এই গরমে জেনারেটর ছাড়া যারাই মুরগি উৎপাদন করছে তাদেরই মুরগি মারা যাচ্ছে। 

 অন্যদিকে যেসব হ্যাচারি, ব্রিডার্স ফার্মে মুরগির বাচ্চা উৎপাদন হচ্ছে সেখানেও লোডশেডিংয়ের কারণে অতিরিক্ত সময় জেনারেটর ব্যবহার করতে হচ্ছে। অন্যদিকে বেড়েছে উৎপাদন খরচ। ১৫ দিন আগেও যেসব মুরগির বাচ্চা বিক্রি হয়েছে ১৫ টাকার আশপাশে। সেগুলো এখন বিক্রি হচ্ছে ২৫-৩০ টাকায়।  ব্রিডার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (বিএবি) সাধারণ সম্পাদক মাহাবুবুর রহমান বলেন, আমার ব্রিডিং ফার্মে প্রতিদিন ৮-১০ ঘণ্টা করে লোডশেডিং হচ্ছে। বাধ্যতামূলকভাবে জেনারেটরের উপর নির্ভর করতে হচ্ছে। এর মধ্যে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় সংকট আরও বেড়েছে। একদিকে বাচ্চার উৎপাদন খরচ বাড়ছে, অন্যদিকে চাহিদা কমে গেছে। তাপমাত্রা হেরফের হওয়ায় ডিম নষ্ট হচ্ছে, বাচ্চা অপুষ্ট হচ্ছে।  উদ্যোক্তাদের হিসাবে, কেজিতে মুরগি উৎপাদনে ব্যয় ১০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এর সঙ্গে পরিবহন, মার্র্কেটিংসহ অন্য খরচ মিলিয়ে ঢাকার আড়তে বিক্রি হচ্ছে ১৭০ টাকায়, যা খুচরা বাজারে ১৯০-২০০ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে ভোক্তাকে। ব্রয়লার মুরগির পাইকারি বিক্রেতা মাসুম জানান, আগে যেখানে গাড়িভাড়া ছিল ২০-২২ হাজার টাকা, সেটা এখন ২৫-২৭ হাজার টাকা হয়ে গেছে। কিন্তু মুরগির সরবরাহ কম। সব মিলিয়ে দাম বেড়েছে।  আফতাব বহুমুখী ফার্মস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফজলে রহিম খান বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে মুরগির উৎপাদন খরচ অন্তত ৩০ শতাংশ বেড়ে গেছে। খামারিরা এত খরচ দিয়ে মুরগি পালন করে পোষাতে পারছেন না। স্বাভাবিক সময়ে সারা দেশের হ্যাচারি ও ব্রিডিং ফার্মগুলো প্রতি সপ্তাহে প্রায় ২ কোটি পিস বাচ্চা উৎপাদন করে। 

এখন সেটা নেমে এসেছে ১ কোটি ৩০ লাখে। অর্থাৎ মুরগির বাচ্চার চাহিদা কমে গেছে। আর প্রতিটি বাচ্চা উৎপাদনেই এখন ৩ টাকা পর্যন্ত খরচ বেড়েছে।  আফতাব বহুমুখী ফার্মস লিমিটেডে একেকটি বাচ্চার শুধুমাত্র উৎপাদন খরচ ৩৯.৫ টাকা। অন্যান্য খরচ মিলিয়ে এর বিক্রয়মূল্য ৪৫ টাকা। কিন্তু বাজারে বাচ্চা বিক্রি করতে হচ্ছে ২৭-৩০ টাকার মধ্যে। এখানেও লোকসান গুনতে হচ্ছে। আরেক উদ্যোক্তা রাকিবুর রহমান বলেন, চলমান পরিস্থিতিতে পোল্ট্রি শিল্প ঠিকিয়ে রাখতে হলে এখনই নীতি ঠিক করা না হলে ইন্ডাস্ট্রি ধ্বংস হয়ে যাবে। স্বল্প মূল্যের মাংস ও ডিমের যোগান দেয়া কঠিন হয়ে পড়বে।  ফিড ইন্ডাস্ট্রিজ এসোসিয়েশন বাংলাদেশের সভাপতি শামসুল আরেফিন খালেদ জানান, লোকসান থেকে বেরিয়ে আসতে হলে গত সময়ে পোল্ট্রি শিল্পে যে কর সুবিধা দেয়া হয়েছিল, তা ফের দিতে হবে। এটি করা না হলে আগামী দিনে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে সমস্যা সৃষ্টি হবে।  পোল্ট্রি খামার রক্ষা জাতীয় পরিষদের সাধারণ সম্পাদক খন্দকার মহসিন বলেন, করোনার ধাক্কায় অনেক খামারি তাদের খামার বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়েছেন। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সঙ্গে তাদের সংগঠনের যৌথভাবে করা একটি সমীক্ষার তথ্য তুলে ধরে বলেন, ২০১০ সালে দেশে খামারের সংখ্যা ছিল ১ লাখ ১৪ হাজার ৭৬৩টি। কিন্তু এখন খামারের সংখ্যা কমতে কমতে ৮০ হাজারে দাঁড়িয়েছে। 

এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে দেশে ভুট্টা আমদানি কমেছে। এতে দাম প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। ১৭ টাকা কেজির ভুট্টা এখন ৩৫ থেকে ৩৬ টাকা। আর সয়াবিন মিলের সয়ামিল ৩২ টাকা কেজি থেকে বেড়ে হয়েছে ৬০ টাকা।  পোল্ট্রি শিল্পের উদ্যোক্তাদের বিপিআইসিসি তথ্য বলছে, স্বাভাবিক সময়ে পোল্ট্রি সেক্টরে দিনে ৪ কোটি পিসের বেশি ডিম উৎপাদন হয়েছে।  কন্‌জুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, সরকারকে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে বাজারে সাপ্লাই চেইন উন্নত করতে হবে। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি করা এই সময় ঠিক হয়নি।

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status