শেষের পাতা
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কান্না (৩)
নানা বৈষম্যের শিকার ডিগ্রি পাসের শিক্ষার্থীরা
পিয়াস সরকার
১৯ আগস্ট ২০২২, শুক্রবারআমি ডিগ্রি পড়া অবস্থায় কয়েকটা চাকরির জন্য আবেদন করি। কিন্তু অধিকাংশ সময় দেখতাম আমাদের চাকরির জন্য ডাকা হয় না। একবার বেসরকারি একটি টেলিকম কোম্পানির মাসব্যাপী প্রচারণার ক্যাম্পেইনের জন্য আবেদন করি সেখানেও ভাইভাতে ডাকা হয়নি। এক পরিচিত ভাইয়ের মাধ্যমে জানতে পারি তাদের চাহিদা ছিল ১২০ জন শিক্ষার্থী। কিন্তু জীবন বৃত্তান্ত জমা পড়েছিল হাজার খানেক। এরপর ডিগ্রি পাস কোর্স পড়ুয়া যারা তাদের কোনো বিচার- বিবেচনা ছাড়াই বাতিল করা হয়। তারা চেয়েছিল এইচএসসি পাস ও বর্তমানে উচ্চ শিক্ষায় অধ্যয়নরত কিন্তু আমরা ভাইভাতেও ডাক পাইনা, এভাবেই বলছিলেন রাজধানীর তেজগাঁও কলেজের ডিগ্রির শিক্ষার্থী আলমগীর হোসেন রাজ। তিনি বলেন, যেখানে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের মূল্য সীমিত সেখানে ডিগ্রি পড়ুয়াদের অবস্থান কোথায়? বর্তমানে দেশে ডিগ্রি পর্যায়ে অধ্যয়নরত আছেন ১৬ লাখ ৬১ হাজার ৩৭৭ জন। যার মধ্যে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আওতাধীন শিক্ষার্থীর সংখ্যা ১২ লাখ ৭৩ হাজার ৪২৯ জন। সরকার থেকে একাধিকবার বলা হয়েছে, দেশের বেসরকারি কলেজগুলো থেকে উঠিয়ে দেয়া হবে অনার্স ও মাস্টার্স কোর্স।
যাতে থাকে বিজ্ঞানের একটি বিভাগ। মানবিক ও ব্যবসায় প্রশাসনের দু’টি করে বিভাগ। রংপুর সরকারি কলেজের ডিগ্রি তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী সাজিয়া আফরিন বলেন, আমাদের সংস্কৃতিটাই হয়ে গেছে ক্লাস না করার। প্রথমে ভর্তি হওয়ার পর কিছুদিন ক্লাস হয়। এরপর যেন সব শেষ। অসংখ্য শিক্ষার্থী আছেন যারা একদিন ক্লাসও না করে ফাইনাল পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছেন। আমি বলবো না স্যাররা ক্লাস নেন না। আমরা নিজেরাই যাই না অধিকাংশ সময়। সরকারি আযিযুল হক কলেজের শিক্ষার্থী ইয়ামিন মোল্লা বলেন, আমরা যারা ডিগ্রিতে (পাস) বিজ্ঞানে ভর্তি হই আমাদের মতো অসহায় যেন আর কেউ নাই। আমরা পড়তে আসছি নামকাওয়াস্তে। পড়ে যে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল তাও না। তারপর আমাদের বিজ্ঞানের বিষয়গুলো আয়ত্ত করতে হয়। পড়তে হয় প্রাইভেট। সাধারণত কোনোরকম এইচএসসি পাস করা শিক্ষার্থীরা আসে ডিগ্রিতে। বিজ্ঞান নিয়ে পড়ে লাভটা কি? এই বিষয় নিয়ে পড়ে চাকরিতে কোনো সুবিধা পাবো তাওতো না। তিনি আরও বলেন, আমার অধিকাংশ সময় প্র্যাকটিক্যাল বিষয়গুলোর ন্যূনতম ধারণাও নাই। আমরা মুখস্থ বিদ্যায় পারদর্শী আর টাকা দিয়ে প্র্যাকটিক্যাল পাস করা শিক্ষার্থী।
প্র্যাকটিক্যাল যে করবো প্রথমত: শিডিউল সমস্যা। দ্বিতীয়ত: শিক্ষকদের উদাসীনতা আর তৃতীয়ত প্র্যাকটিক্যাল ক্লাসে উপস্থিতি যদি চার পাঁচজন হয় সেখানে আগ্রহ এমনিতেই কমে যায়। ডিগ্রি পাস কোর্স পড়ুয়া একাধিক শিক্ষার্থীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায় ক্লাস না করলেও উপস্থিতির ২০ নম্বর নিয়ে কোনো সমস্যা হয় না তাদের। ইনকোর্স পরীক্ষার সময় বিভিন্ন কলেজে ২০০ থেকে ৫০০ টাকা দিলেই মিলে যায় ১৭ থেকে ১৮ নম্বর। আবার প্র্যাকটিক্যাল নম্বরের ক্ষেত্রেও গুনতে হয় অর্থ। এসব শিক্ষার্থী তিন বছরের ডিগ্রি পাসের পর দুই বছরব্যাপী মাস্টার্স পড়তে হয়। এরপর তারা অনার্স সমমানের যোগ্যতা অর্জন করেন। ডিগ্রিতে তিন বছরে তারা ২১০০ নম্বরের পরীক্ষা দেন। আর মাস্টার্সে ৭০০ নম্বরের। যেখানে অনার্সের শিক্ষার্থীরা চার বছরেই ২৮০০ নম্বরের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী আরেফিন সিদ্দিক বলেন, আমরা যে কলেজের শিক্ষার্থী এটা হয়তো মনেই থাকে না। আমাদের যোগাযোগ শুধুমাত্র পরীক্ষার সময়কেন্দ্রিক। ডিগ্রি পড়ুয়া শিক্ষার্থীরা শুধুমাত্র একটা সার্টিফিকেট প্রয়োজন তাই পড়তে আসে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যে হৃদ্যতা, বন্ধুত্ব, পরিবেশ এসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো আমাদের কাছে গৌণ। কারণ আমরা তিনবছরের জন্য আসি একটা সার্টিফিকেট নিতে। তিনি আরও বলেন, এই ডিগ্রি পড়ুয়া শিক্ষার্থীদের কেউ চাকরিতে গুরুত্ব দেয় না। আমরা সকল বিষয়ে প্রাথমিক ধারণা নিয়ে পাস করছি। এমনভাবে এই সিলেবাস সাজানো যে শুধু আমরা প্রাথমিক ধারণা পাচ্ছি। টিউশনিতেও আমাদের ভ্যালু থাকে না। কারণ অভিভাবকরা চান বিষয়ভিত্তিক জ্ঞানে অভিজ্ঞ লোক।