ঢাকা, ২৯ মার্চ ২০২৪, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

ডিম-ফার্মের মুরগির পর তেলাপিয়া, পাঙ্গাশও নাগাল ছাড়া কম আয়ের মানুষ খাবে কি?

নাভিশ্বাস

মো. আল আমিন, নাজমুল হুদা ও নাইম হাসান
১৭ আগস্ট ২০২২, বুধবার
mzamin

শ্যামলীর একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে গাড়ি চালিয়ে মাসে ১২ হাজার টাকা বেতন পান আজগর হোসেন। অন্যান্য আয় মিলিয়ে মাসে তার হাতে আসে প্রায় ১৮ হাজার টাকা। গত পাঁচ বছরে বাজারদরে দফায় দফায় উল্লম্ফন ঘটলেও আজগরের আয় একই রয়ে গেছে। ফলে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হচ্ছে তাকে। মাছ ও মাংস খাওয়া তার জন্য বর্তমানে স্বপ্নের মতো। মাস টানেন কিছুটা কম দামের তেলাপিয়া, পাঙ্গাশ মাছ দিয়ে। তবে গত কিছুদিন ধরে তেলাপিয়া-পাঙ্গাশও তার নাগালের বাইরে চলে গেছে। আজগর বলেন, পাঁচ বছর ধরে ঢাকা শহরে গাড়ি চালাচ্ছি। আয় এক টাকাও বাড়েনি। তবে খরচ বেড়েছে অনেক।

বিজ্ঞাপন
এতদিন পাঙ্গাশ-তেলাপিয়া দিয়ে মাছের চাহিদা মিটিয়েছি। বর্তমানে এসব মাছও আমাদের নাগালে নেই। এখন কেজিতে তেলাপিয়া-পাঙ্গাশ মাছের দাম ৬০ থেকে ৭০ টাকা  বেড়েছে। এভাবে সব কিছুর দামই বাড়তে থাকলে মানুষ খাবেটা কি?  বাজার ঘুরে দেখা গেছে, পাঙ্গাশ মাছ বিক্রি হচ্ছে ১৮০ টাকা কেজিতে। এ ছাড়া তুলনামূলক বড় ও তাজা পাঙ্গাশ ২০০ টাকা কেজিতে বিক্রি হচ্ছে। অন্যদিকে মাঝারি সাইজের তেলাপিয়া প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২২০ টাকায়। চাষের কই মাছ প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ২৪০ টাকায়। রাজধানীর বিএনপি বাজারে তেলাপিয়া মাছের দোকানের সামনে হাতে ব্যাগ নিয়ে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলেন আমিরুল ইসলাম। কিছুক্ষণ দরদামের পর শূন্যহাতে ফিরে যাচ্ছিলেন তিনি। বলেন, মাছ কিনতে চেয়েছিলাম। 

তবে মাছের দাম অনেক বেড়েছে। এত টাকা দিয়ে মাছ কিনতে গেলে চাল, ডাল, তেল কিনতে পারবো না।  তালতলা বাজারে মাছ কিনতে আসা গার্মেন্টস কর্মী শহিদুল ইসলাম বলেন, এতদিন কিছুটা কম দামে পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া, কই মাছ কিনতে পেরেছি। এখন কোনো মাছই আমাদের সাধ্যের মধ্যে নাই। পাঙ্গাশ কয়েক দিন আগেও ১২০ টাকা কেজিতে কিনে খেতে পারতাম কিন্তু এখন সেই মাছের দাম ১৮০ টাকা। তেলাপিয়ার কেজি কিছুদিন আগে ১৬০ টাকা ছিল। সেই মাছ এখন ২২০ টাকা। বিএনপি বাজারে মাছ কিনতে আসা রিনা বেগম বলেন, ২৫০ গ্রাম ওজনের একটি তেলাপিয়া মাছ ৬০ টাকা দিয়ে কিনেছি। এক কেজি তেলাপিয়া মাছ ২৪০ টাকা দিয়ে কেনার সাধ্য আমাদের নেই। পোলাপানকে আর কতোবার শাক-সবজি খাওয়ায়ে রাখবো। মানুষের বাড়িতে কাজ করে সংসার চালাই। স্বামী রিকশা চালায়। পাঁচ জনের পেট চালাতে দুই জনের আয়ে হিমশিম খেতে হয়। আগে থেকে বাজারের তালিকা কমিয়ে এনেছি। কয়েকদিন আগেও পাঙ্গাশ মাছ ১২০ টাকা কেজিতে কিনে খেতে পারতাম। এখন সেই মাছের দাম ১৮০ টাকা। তেলাপিয়ার কেজি ছিল ১৬০ থেকে ১৮০ টাকা। সেই মাছ এখন ২৪০ টাকায় কিনতে হচ্ছে। শ্যামলী কাজী অফিস বাজারে মাছ কিনতে এসেছিলেন বেসরকারি চাকরিজীবী নাজমুস সাকিব। 

বাজারের ঊর্ধ্বগতির কারণে তিনি চলে যান তেলাপিয়া ও পাঙ্গাশ  মাছের দোকানে। জানতে চাইলে তিনি বলেন, বর্তমান বাজারে ভালো মাছ কেনার সাধ্য আমাদের মতো মানুষের নেই। আমাদের জন্য কিছুটা কম দামের তেলাপিয়া, পাঙ্গাশ মাছ ছিল। বর্তমান বাজারে এসব মাছও আমাদের নাগালে নেই। কয়েক দিন আগেও এসব মাছের দাম কম ছিল। এখন কেজিতে এসব মাছের দাম বেড়েছে ৬০ থেকে ৭০ টাকা। এসব মাছের দাম হঠাৎ কেন এত বেড়ে গেল? এমন প্রশ্নের জবাবে বিএনপি বাজারের মাছ ব্যবসায়ী জাহিদুর রহমান বলেন, হঠাৎ করে নয়, বেশ কিছু দিন হলো এসব মাছের দাম বাড়ছে। মূলত মাছের ফিডের (খাওয়ার) দাম অনেক বেড়ে গেছে। ফলে মাছ চাষিদের খরচ বেড়ে গেছে। তাছাড়া এসব মাছ দূর-দূরান্ত থেকে ঢাকায় আসে। ট্রাকের খরচও আগের চেয়ে অনেক বেড়ে গেছে ডিজেলের দাম বাড়ার কারণে। আমাদেরও পাইকারি আড়ত থেকে আগের চেয়ে বেশি দামে মাছ কিনতে হচ্ছে। তাই খুচরা বাজারে আমাদেরকেও বেশি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে। কাজী অফিস বাজারের মাছ বিক্রেতা কবির হোসেন বলেন, অন্য সব ধরনের মাছের দাম বাড়তি হওয়ার কারণে অনেকে পাঙ্গাশ, তেলাপিয়া, চাষের মাছ কেনেন। কিন্তু বর্তমান বাজারে এসব মাছের দামও অনেক বাড়তি। ৫০ থেকে ৮০ টাকা প্রতি কেজিতে বেড়েছে। তিনি বলেন, এখানে আমাদের কোনো হাত নেই। পাইকারি বাজারে আমাদের কেনা দাম বেশি পড়ছে, সেটার প্রভাব পড়েছে স্থানীয় বাজারগুলোতে। 

 কিছু দিন আগেও তেলাপিয়া মাছ বিক্রি করেছি ১৬০ টাকায় এখন এটার দাম ২২০ টাকা। কই মাছ ১৬০ থেকে ১৮০ টাকায় বিক্রি করেছি, বর্তমান বাজারে দাম ২৪০ টাকা। এ ছাড়া কিছুদিন আগে পাঙ্গাশ মাছ ১২০ টাকাতেও বিক্রি করেছি, এখন সেটা ১৮০ টাকা কেজি। কম আয়ের অনেক মানুষের খাদ্য তালিকায় ডিম ছিল প্রোটিনের বড় উৎস। এই ডিমের ডজন এখন ১৬০ থেকে ১৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এত দামে ডিম কেনার সাধ্য হারিয়েছেন অনেকে।  এ ছাড়া ব্রয়লার মুরগির দামও অনেক দিন থেকে চড়া। কম আয়ের অনেকে সপ্তাহে বা মাসে বাজারের তালিকায় রাখতেন ব্রয়লার মুরগি। দাম বাড়ায় তাও কিনতে পারছেন না কম আয়ের মানুষ। দেড়শ’ টাকা কেজির ব্রয়লার মুরগির দাম এখন ২০০ টাকায় ঠেকেছে।  এ বিষয়ে কনজ্যুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট হুমায়ুন কবির মানবজমিনকে বলেন, জ্বালানি তেলের কারণ দেখিয়ে নিত্যপণ্যের দাম অনেক বাড়ানো হয়েছে। একটি ডিম ১৫ থেকে ১৬ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ফার্মের মুরগির দামও ৫০ থেকে ৬০ টাকা বেড়েছে। কোনো কিছুই সাধারণ মানুষের নাগালের মধ্যে নেই। তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার কারণে পরিবহন খরচ বেড়েছে মাত্র ৫০ পয়সা। অনেকে বলছে মুরগি ও মাছের খাবারের দাম বেড়েছে, এজন্য এসব জিনিসের দাম বেড়েছে। কিন্তু তবুও কি এত টাকা বাড়ার কথা না। অসাধু ও সুযোগ সন্ধানী ব্যবসায়ীরা এমন করছে। এক্ষেত্রে সরকারি তদারকি সংস্থাগুলো যথাযথ ভূমিকা পালন করছে না।  

পুষ্টিকর খাদ্য ক্রয় এখন ‘দুঃসাধ্য’: ‘বাচ্চাকে শুধু সুজি খাওয়াই। সুজিতে কি পুষ্টি আছে? বাচ্চা আমার রোগা হইয়া যাইতাছে। ডাক্তার বলছে ফলের রস, মুরগির স্যুপ খাওয়াইতে। আধা সেদ্ধ ডিম খাওয়াইতে। আমি তা খাওয়াইতে পারতাছি না।’ করুণ স্বরে কথাগুলো বলেছিলেন আট মাসের শিশু সোয়াদের মা ইমা আক্তার। সোমবার স্বামী সোহেল মিয়াকে নিয়ে রাজধানীর মাদারটেক বাজারে এসেছিলেন তিনি। প্রায় ৩০ মিনিট বিভিন্ন দোকান ঘুরে শুধু এককেজি আলু, অধাকেজি কাকরোল আর পটল কিনেছিলেন তারা। রুই মাছের দরদাম করলেও তা কেনার মতো টাকা না থাকায় মাছ না কিনেই বাড়ি ফিরেছেন তারা।  সোহেল মিয়ার মাসে আয় ১৫ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে তার সংসার চালানো সম্ভব হয় না। শুধু বাড়িভাড়ার জন্যই তার মাসে ৯ হাজার টাকা খরচ হয়। প্রতিমাসে ৪-৫ হাজার টাকা ঋণ করে বাকি ব্যয় মেটাতে হয়। এরমধ্যে পুষ্টিকর খাবারও কিনতে পারেন না তিনি। 

নতুন করে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার পর জিনিসপত্রের দাম আরও বেড়েছে। এতে তার খাবার তালিকায় আরও কাটছাঁট হয়েছে। আগে সন্তানদের জন্য নিয়মিত ফল কিনতেন। দুই মাস ধরে তা কিনছেন না। তবে প্রতিদিন দুধ-ডিম খাওয়াতেন। কিন্তু নতুন করে সবকিছুর দাম বৃদ্ধিতে এখন তা খাওয়াতে পারেন না। সপ্তাহে একবার মাংস আর মাঝেমধ্যে মাছ কিনতেন। এখন বাজারে গেলে শুধু আলু আর কম দামি সবজি কিনেন। এতেই কোনোরকম দিন চালিয়ে দিচ্ছেন তারা। মাছের বাজারে ছোট চিংড়ি দরদাম করেছেন হাছিনা বেগম। এক ভাগ চিংড়ি ২০ টাকা। সেখানে গুনে গুনে ১০টি চিংড়ি রাখা। পরে হাছিনা আর চিংড়ি কিনলেন না। পাঙ্গাশ মাছ দরদাম করেও নিলেন না। হাছিনা জানালেন, তিনি ১০০ টাকা নিয়ে বাজারে এসেছেন। আধাকেজি আলু কিনবেন। আর ২৫০ গ্রাম ডাল কিনবেন। দুপুরে আলুভর্তা দিয়ে ভাত খাবেন। ক’দিন আগে ৫ কেজি চাল কিনেছেন তা এখনো আছে। ডিম, মাছ-মাংস খাওয়া হয় কিনা জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমি একলা মানুষ। মাছ-মাংস খাওয়া লাগে না। কোনোরকম ডাইল-মরিচ হইলেই খাওয়া হইয়া যায়।

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status