শেষের পাতা
হাতিরঝিলে চক্রাকার বাস, উঠলেই ২০ টাকা ভাড়া
নূরে আলম জিকু
১৬ আগস্ট ২০২২, মঙ্গলবাররাজধানীর হাতিরঝিল। জলাশয়ের চারপাশের সাড়ে ৭ কিলোমিটার এলাকাজুড়ে চলে চক্রাকার বাস। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত প্রতিদিন এই রুটে যাতায়াত করেন কম বেশি অর্ধলক্ষাধিক যাত্রী। এসব যাত্রীদের জিম্মি করে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করে আসছে এইচআর ট্রান্সপোর্ট নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। যার ইজারা দিয়েছে সরকারি সংস্থা রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। সরকারি নিয়ম-নীতির কোনো তোয়াক্কা না করে নিজস্ব নীতি কিংবা আইনে হাতিরঝিলে চক্রাকার বাস পরিচালনা করে আসছে রাজউক। সম্প্রতি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে ভাড়া নির্ধারণ করে দিলেও সেই আইন মানছেন না তারা। উল্টো ভাড়া বাড়িয়েছে কয়েকগুণ। হাতিরঝিলের চক্রাকার বাসে উঠলেই যাত্রীদের গুনতে হচ্ছে ২০ টাকা।
এছাড়া বিভিন্ন স্টপেজ হিসেবে প্রতি কিলোমিটার ভাড়া নিচ্ছে ৫ থেকে ৭ টাকা হারে। সর্বনিম্ন হাফ কিলোমিটার এলাকায় ভাড়াও ১৫ টাকা করে আদায় করছে।
পরিবহন মালিক শ্রমিকদের কাছে সাধারণ যাত্রীরা জিম্মি হয়ে পড়েছেন। সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে দ্বিগুণ কিংবা তারও বেশি ভাড়া আদায় করা হচ্ছে। তবে পরিবহন সংশ্লিষ্টদের দাবি হাতিরঝিল পর্যটন এলাকা ও চক্রাকার সার্ভিসটি ট্যুরিস্ট বাস হিসেবে যাত্রীসেবা দিচ্ছে। এখানে বিআরটিএ’র কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। সবকিছু চলে রাজউকের তত্ত্বাবধানে। যদিও যাত্রী ও স্থানীয়দের দাবি, চক্রাকার বাস সার্ভিসে বেশিরভাগ যাত্রীই কর্মক্ষেত্রে যাতায়াত হিসেবে ব্যবহার করছেন। অল্প সময়ে একপ্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে যাতায়াতে চক্রাকার বাসে ওঠেন তারা। বিভিন্ন এলাকা থেকে হাতিরঝিল ঘুরতে আসলেও বাসে ওঠা পর্যটকের সংখ্যা খুবই কম। মানুষ দৈনন্দিন কাজের জন্যই চক্রাকার বাসে উঠছেন। আগে বাসে এসি থাকলেও গত ২ বছর ধরে এসি বন্ধ করে রাখছেন সংশ্লিষ্টরা। বাসে ঠাসাঠাসি ও দাঁড়িয়ে যাত্রী পারাপারও করছেন।
সরজমিন দেখা যায়, হাতিরঝিল জলাধারের চারপাশে প্রায় সাড়ে ৭ কিলোমিটার সড়কে চলে হাতিরঝিল চক্রাকার বাস। গুলশান, রামপুরা, কাওরান বাজার ও মগবাজার এলাকা হয়ে মানুষ পৌঁছে যাচ্ছেন নির্দিষ্ট গন্তেব্যে। এই পথে যাতায়াতে মানুষের ভরসা হাতিরঝিল চক্রাকার বাস ও জলাধারে ওয়াটার বাস। এফডিসি মোড় সংলগ্ন রয়েছে হাতিরঝিল চক্রাকার বাস সার্ভিসের কাউন্টার। সেখানে টানিয়ে রাখা হয়েছে নতুন ভাড়ার তালিকা। তালিকায় বিআরটিএ কিংবা রাজউক’র কারও স্বাক্ষর নেই। গত ৯ই আগস্ট সেই ভাড়ার তালিকা টানানো হয়। টিকিট কাউন্টারে সড়ক পরিবহন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ’র নির্ধারণ করে দেয়া হারের আড়াইগুণের বেশিও ভাড়া আদায় করছে রাজউকের ইজারাদার প্রতিষ্ঠানটি। বিআরটিএ সর্বনিম্ন যে ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে সেখানেও নেয়া হচ্ছে তার দ্বিগুণ। ঢাকা মহানগরীতে চলাচলকারী বাসে বিআরটিএ’র নির্ধারিত ভাড়া হচ্ছে প্রতি কিলোমিটার যাত্রী প্রতি ভাড়া ২ টাকা ৫০ পয়সা ও সর্বনিম্ন ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১০ টাকা।
কাউন্টারে টানানো তালিকা থেকে দেখা যায়, এফডিসি মোড় থেকে সাড়ে ৭ কিলোমিটার ঘুরে আবার এফডিসি মোড়ে আসতে ভাড়া নিচ্ছে ৪০ টাকা। প্রতি কিলোমিটার ভাড়া পড়ছে ৫ টাকার বেশি। এফডিসি মোড় থেকে বউবাজার/ শুটিং ক্লাব ২০ টাকা। এই পথের দূরত্ব ৩ কিলোমিটার, সে হিসেবে প্রতি কিলোমিটার ভাড়া পড়ছে সাড়ে ৬ টাকার বেশি। এফডিসি মোড় থেকে বাড্ডা ৩ দশমিক ৯ কিলোমিটারে ভাড়া নেয়া হচ্ছে ২৫ টাকা। বউবাজার থেকে শুটিং ক্লাব ১ দশমিক ৯ কিলোমিটার ভাড়া নিচ্ছে ২০ টাকা। যেখানে সরকার নির্ধারিত সর্বনিম্ন ভাড়া নেয়ার কথা ১০ টাকা। বউ বাজার থেকে রামপুরা ৩ কিলোমিটারে নেয়া হচ্ছে ২৫ টাকা। শুটিং ক্লাব থেকে বাড্ডা পর্যন্ত ৯০০ মিটারের ভাড়া রাখা হচ্ছে ২০ টাকা। বাড্ডা থেকে রামপুরা ২৩০ মিটার চক্রাকার বাসের ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে ১৫ টাকা। শুটিং ক্লাব থেকে মহানগর পর্যন্ত রাখা হচ্ছে ২৫ টাকা। একই ভাড়া রাখা হচ্ছে এফডিসি মোড় পর্যন্ত। রামপুরা থেকে এফডিসি পর্যন্ত ৩ দশমিক ৩ কিলোমিটার ২৫ টাকা। মহানগর থেকে মধুবাগ ৬৫০ মিটার ২০ টাকা। যদিও ভাড়ার চার্টে কারও স্বাক্ষর নেই।
শুক্রবার দুপুরে এফডিসি মোড়ের ১ নম্বর কাউন্টারে টিকিট কাটতে এসে বিপাকে পড়েন মো. সেলিম মিয়া। বউ বাজারের টিকিটের জন্য ১৫ টাকা কাউন্টারে জমা দেন। কাউন্টার থেকে টাকা ফেরত দিয়ে ২০ টাকা দাবি করা হয়। সেলিম মিয়া ২০ টাকা দিতে অস্বীকার করলে কাউন্টারে থাকা ব্যক্তি বলেন, বাহিরে ভাড়ার তালিকা দেয়া আছে। সেটা দেখে ভাড়া দেন। ঢাকা শহরে নতুন আসছেন নাকি? ভাড়া বেড়েছে জানেন না? বাসে উঠলেই ২০ টাকা লাগে। সেলিম মিয়া মানবজমিনকে বলেন, এফডিসি মোড় থেকে বউ বাজারের দূরত্ব এক কিলোমিটারের চেয়েও কম। এই পথের ভাড়া কীভাবে ২০ টাকা হয়। সরকার নতুন যে ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে তাতে ভাড়া হবে ১০ টাকা। এখন ২০ টাকা নিচ্ছে। মানুষকে জিম্মি করে ফেলছে হাতিরঝিলের চক্রাকার বাস সার্ভিসটি। এই পথে অন্য কোনো বাস ও বিআরটিএ’র কার্যক্রম না থাকায় মানুষের পকেট কেটে ভাড়া নিচ্ছে। ভয়ে কেউ প্রতিবাদ করার সাহস পাচ্ছেন না। যারা ইজারা নিয়েছে তারা প্রভাবশালী ব্যক্তি।
শুটিং ক্লাব এলাকায় বাস থেকে নামছেন সোনিয়া সিকদার নামের এক নারী। কথা হলে তিনি বলেন, নামে ট্যুরিস্ট বাস হলেও চলে লোকাল বাসের মতো। দাঁড়িয়ে যাত্রী পারাপার করছে। অনেক সময় নারী যাত্রীদেরকেও দাঁড়িয়ে যাতায়াত করতে হয়। কখনো কখনো যাত্রী কম থাকলে যেতে চায় না। যাত্রীরা কিছু বললেই তাদের সঙ্গে স্টাফরা খারাপ ব্যবহার করে। আগে অভিযোগ দেয়ার বক্স থাকলেও এখন তাও নেই। এক কিলোমিটার পথ কীভাবে ১৫ থেকে ২০ টাকা ভাড়া হয়।
ইস্ট ওয়েষ্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শিপন আহমেদ। দীর্ঘদিন পর হাতিরঝিল হয়ে মধুবাগ যাবেন। বাড্ডা কাউন্টারে টিকিট কাটতে ২০ টাকার নোট দেন। কাউন্টার টিকিট মাস্টার জানতে চাইলেন, কোথায় যাবেন? শিপন মধুবাগ জানালে, ভিতর থেকে বলে আরও ৫ টাকা দেন। শিপনের কাছে বাড়তি টাকা না থাকায় চক্রাকার বাসে আর যাওয়া হয়নি তার। তিনি বলেন, আগে জানতাম ১৫ টাকা ভাড়া। গত বছর শেষের দিকে ৫ টাকা বাড়িয়েছে। এখন আবার ৫ টাকা বাড়িয়েছে। এভাবে ভাড়া বাড়তে থাকলেও কেউ নিয়ন্ত্রণ করছে না। ঢাকা শহরে প্রকাশ্যে কীভাবে সরকারের নিয়মকানুন না মেনে বাড়তি ভাড়া আদায় করছে। এটার যৌক্তিকতা কতটুকু। রাজউক কী সেবা দিবে নাকি টাকার পাহাড় বানাবে?
নাম প্রকাশ না করেই হাতিরঝিল চক্রাকার বাস সার্ভিসের এক সুপারভাইজার বলেন, বাড়তি ভাড়া নেয়ার বিষয়টি রাজউক অবগত রয়েছেন। বিআরটিএ’র সঙ্গে এখানকার বাস ভাড়ার পার্থক্যের বিষয়টি রাজউকই বলতে পারবে। কোনো প্রশ্ন থাকলে রাজউককে করুন। রামপুরা কাউন্টারের আরেক লাইনম্যান বলেন, হাতিরঝিল প্রজেক্টে সরকারের নিময়মানুন চলে না। এখানে পুরোটাই ভিন্ন জগৎ। বাসগুলো ট্যুরিস্ট বাস হিসেবে চলে। ট্যুরিস্ট বাস হিসেবে বরাদ্দ নিয়ে গত ৭ বছর ধরে চলছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে এইচআর ট্রান্সপোর্টের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা কথা বলতে রাজি হননি। তবে লাইনম্যানরা বলছেন, রাজউক’র অনুমতিতেই ভাড়া বাড়ানো হয়েছে। জানা যায়, ২০১৬ সালে হাতিরঝিলের চারপাশে যাত্রী পরিবহনে ১০টি মিনিবাস চালু হয়। বর্তমানে ২০টি বাস চলছে। প্রতিদিন সকাল ৭টা থেকে রাত ১১টা পর্যন্ত নিয়মিত চলাচল করছে সেগুলো।
এদিকে রাজউক থেকে হাতিরঝিলে ওয়াটার ট্যাক্সিসহ ৪টি রেস্টুরেন্ট ইজারা নিয়েছে করিম গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ‘হাতিরঝিল হসপিটালিটিস’। বিগত কয়েক বছর ধরেই পানিপথে চলছে এই সার্ভিস। গত বছর জ্বালানি তেলের দাম বাড়ার প্রেক্ষাপটে ভাড়া বাড়িয়েছিল ওয়াটার ট্যাক্সি। সম্প্রতি জ্বালানি তেলের মুল্যবৃদ্ধির পর নতুন করে আবারো ভাড়া বাড়িয়েছে তারা। এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করছেন যাত্রীরা। গত ৮ই আগস্ট ‘হাতিরঝিল হসপিটালিটিস’র এডমিন তৌফিক রহমান স্বাক্ষরিত নতুন ভাড়ার তালিকায় দেখা যায়, পূর্বের তালিকা থেকে নতুন করে ভাড়া বেড়েছে ৫ থেকে ১০ টাকা। এফডিসি থেকে গুলশান ভাড়া নেয়া হচ্ছে ৪০ টাকা, পুলিশ প্লাজা ও রামপুরা পর্যন্ত ২৫ টাকা। রামপুরা থেকে গুলশান ২৫ টাকা। রামপুরা থেকে পুলিশ প্লাজা ২০ টাকা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, জ্বালানি তেলের মুল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে কোম্পানি নিজেদের মতো করেই ভাড়া সমন্বয় করে নিয়েছেন।
এদিকে হাতিরঝিলে চক্রাকার বাস সার্ভিস নিয়ে কথা বলতে রাজি হয়নি রাজউক’র ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে রাজউক’র এক কর্মকর্তা বলেন, এইচআর ট্রান্সপোট বাড়তি ভাড়ার বিষয়ে রাজউক’র কাছে আবেদন করেছে। রাজউক এখনো অনুমোদন দেয়নি। সম্প্রতি জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে হাতিরঝিলের চক্রাকার বাসে ভাড়তি ভাড়া আদায়ের বিষয়টি রাজউক’র চেয়ারম্যানসহ সংশ্লিষ্টরা অবগত আছেন। যদিও এ বিষয়ে কিছুই জানেন না বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কর্মকর্তারা।