ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

শেষের পাতা

ব্যয় বাড়ে, আয় বাড়ে না চা শ্রমিকদের

ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে
১৫ আগস্ট ২০২২, সোমবার
mzamin

লাক্কাতুরা ক্লাব পাড়ার বাসিন্দা বিষ্ণু মুণ্ড। ৫ জনের সংসারে একা বাগানে চাকরি করেন। প্রতিদিন পান ১২০ টাকা। সপ্তাহে ৮৪০ টাকা। রেশন হিসেবে ৫ টাকা দিয়ে পান সাড়ে ৩ কেজি আটা। চাল, ডাল, পিয়াজসহ নিত্যপণ্য তাকে বাজার থেকেই কিনতে হয়। বিষ্ণু মুণ্ড জানালেন, ‘এই টাকা দিয়ে সংসার চলে না। দু’বেলা রুটি খেয়েও এক বেলা ভাত জোটে না। নতুন করে পণ্যমূল্য বেড়ে যাওয়ায় তার সংসার আর চলছেই না। বাধ্য হয়ে ছেলে পরিবহন শ্রমিক হিসেবে কাজ করছে।’ এদিকে, বিষ্ণু মুণ্ডর পুত্রবধূ পিয়াসী এখন ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা।

বিজ্ঞাপন
বাগানের ভেতরে যে মেডিকেল আছে সেটাতে কেবল প্যারাসিটামল ও এন্টাসিড মেলে। এর বাইরে প্রসূতির স্বাস্থ্যসেবা বলতে কিছুই নেই। পিয়াসী জানালেন, ‘সময় ঘনিয়ে এলে ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। হাতে টাকা নেই। যে টাকা রুজি হয় তাতে খাবারও জোটে না।’ একই এলাকার দেবাশীষ গোয়ালা জানালেন, ‘বাগানের হাসপাতালে কোনো স্বাস্থ্যসেবা মেলে না। এ কারণে অনেকেই হাসপাতালের দিকে যান না। শহর লাগোয়া বাগান হলেও এখানে উন্নত স্বাস্থ্যসেবা অনুপস্থিত। ফলে সব সময়ই অসুখ-বিসুখে ভোগেন চা শ্রমিকরা। 

পুষ্টিহীনতা চা শ্রমিকদের বড় সমস্যা।’ এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে চা শ্রমিকদের। জ্বালানির মূল্য বৃদ্ধির কারণে বাজারের উত্তাপ তাদের কাছে অমানিশার অন্ধকার। বাগানে কাজ করলে টাকা পান। নতুবা অভুক্তই থাকতে হয়। এই সত্য মেনে কাজ ছেড়ে এখন বাগানের চা শ্রমিকরা অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘটে নেমেছেন। মঙ্গলবার থেকেই তাদের এই আন্দোলন শুরু। আন্দোলন যতদিন থাকবে ততদিন তারা বাগান থেকে কোনো টাকা পাবেন না। এরপরও জীবন রক্ষার আন্দোলনে সবাই ঐক্যবদ্ধ। চা শ্রমিক নেতারা জানিয়েছেন, বাংলাদেশে প্রায় ২৪১টি চা বাগান রয়েছে। এতে স্থায়ী, অস্থায়ী মিলে প্রায় ১ লাখ ৩৫ হাজার শ্রমিক কাজ করছে। আগে তারা বেতন পেতেন ১০২ টাকা। ২০২০ সালে সরকারের সিদ্বান্ত অনুযায়ী ১৮ টাকা বাড়ানো হয়। এখন পান ১২০ টাকা। এই টাকা দিয়ে তাদের সংসার চলে না। গেল কয়েক মাস ধরে চা শ্রমিকরা বেতন বাড়ানোর জন্য মালিকদের কাছে দাবি জানিয়ে আসছিলেন। কিন্তু এতে সাড়া মেলে না। নতুন করে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে তারা আর বসে থাকেননি। নেমেছেন আন্দোলনে। এই আন্দোলনের পরিধিও দিন দিন বাড়ছে। গত ১লা আগস্ট চা শ্রমিক সংগঠনের হেড কোয়ার্টার শ্রীমঙ্গলে বৈঠক করেছিলেন শ্রমিক নেতারা। ওই বৈঠকে তারা বেতন বৃদ্ধির দাবি জানায়। এরপর বৈঠকের সিদ্বান্ত অনুযায়ী ৩রা আগস্ট দাবি উপস্থাপন করে শ্রম দপ্তরসহ প্রশাসনের সব দপ্তরে পত্র পাঠানো হয়। এতে সময় দেয়া হয় ৭ দিন।

 চা শ্রমিকরা জানিয়ে দেয়, এই সময়ের মধ্যে দাবি না মানলে তারা আন্দোলনে নামতে বাধ্য হবে। কিন্তু এই সময়ের মধ্যেও দাবি মেনে নেয়া হয়নি। এরফলে আন্দোলনে নামেন শ্রমিকরা। প্রথম ৪ দিন তারা দুই ঘণ্টা কর্মবিরতি পালন করেন। বলে আসছিলেন, শনিবারের মধ্যে দাবি আদায় না হলে তারা আন্দোলনে নামবেন। ওই সময়ের মধ্যে দাবি আদায় না হওয়ার কারণে শনিবার থেকে তারা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘটে নেমেছেন। জাতীয় শোক দিবস ও জাতির পিতার মৃত্যুবার্ষিকীর কারণে রবি ও সোমবার দু’দিন আন্দোলনে বিরতি দেয়া হয়েছে। মঙ্গলবার থেকে ফের তারা আন্দোলন শুরু করবে। এদিকে, সিলেট জেলায় রয়েছে ২৬টি চা বাগান। এছাড়া, মৌলভীবাজারে ৯২টি ও হবিগঞ্জে রয়েছে ২৬টি বাগান। সিলেটেই শ্রমিকের সংখ্যা প্রায় ১৫ হাজার। বাগানের কর্মচারীরা প্রতিদিন মিছিল সহকারে লাক্কাতুড়ার স্টেডিয়াম এলাকায় আসেন। সেখানে বসে তারা কর্মসূচি পালন করেন। শনিবার থেকে তারা অবস্থানের স্থান পরিবর্তন করেছে। দাবি আদায়ের স্থান হিসেবে তারা সিলেট কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার এলাকায় অবস্থান করছে। লাক্কাতুড়া বাগানের পঞ্চায়েত কমিটির কোষাধ্যক্ষ রিপন গোয়ালা মানবজমিনকে জানিয়েছেন, ‘আমরা আন্দোলন চাই না। প্রাপ্য মজুরি চাই। এখন দাবি তোলা হয়েছে ৩০০ টাকা মজুরি। কোনোভাবে এটি অগ্রহণযোগ্য দাবি নয়। 

চা শ্রমিকরাও মানুষ। সুতরাং খেয়ে বেঁচে থাকতে হলে টাকা লাগবে। এই মজুরি না দিলে চা শ্রমিকরা ঠিকে থাকায়ই দায় হবে। নতুন অন্য পেশায় যেতে হবে। আমরা নিজেদের পেশাকে ভালোবাসি। এ কারণে দেশের স্বার্থে অন্য পেশায় না গিয়ে বেতন বাড়ানোর আন্দোলন করছি।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের ৫টি মৌলিক চাহিদার মধ্যে সবগুলোই অনুপস্থিত। চা শ্রমিকদের সন্তানরা শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। স্যানিটেশন, বিশুদ্ধ পানির তীব্র সংকট চলছে।’ বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সিলেট ভ্যালীর কার্যকরী সভাপতি রাজু গোয়ালা জানিয়েছেন, ‘বাস্তবিক অর্থে সংসার চলে না। শ্রমিকদের দেয়ালে পিঠ ঠেকে গেছে। এ কারণে এবার শ্রমিকরাই আগ্রহী হয়ে আন্দোলনে নেমেছেন। আমরা শ্রমিক নেতা হিসেবে সুখে-দুখে তাদের পাশে রয়েছি। তবে, দাবি আদায় না হলে এবার শ্রমিকরা আর ঘরে ফিরবে না।’ এজন্য তিনি সরকারের উচ্চ মহলের সুদৃষ্টি কামনা করেন।’  চা শ্রমিক ইউনিয়নের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক নৃপেন পাল জানান, ‘আমাদের চা শ্রমিক ইউনিয়ন ও বাগান মালিকদের দ্বিপাক্ষিক চুক্তি অনুযায়ী দুই বছর পর পর মজুরি বৃদ্ধি করার কথা থাকলেও মালিকরা চুক্তির আইন ভঙ্গ করছেন। 

গত ২০ মাস আগে মজুরি বাড়লে শ্রমিক পরিবারগুলো কিছুটা স্বাচ্ছন্দে সংসার পরিচালনা করতে পারতেন।’ বাংলাদেশ চা সংসদের সিলেট ব্রাঞ্চ চেয়াম্যান গোলাম মোহাম্মদ শিবলী সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ‘সমঝোতা চুক্তির মধ্যে কর্মবিরতি ও আন্দোলনে যাওয়া সম্পূর্ণ অনৈতিক। ইতিমধ্যে তাদের বিষয়গুলো নিয়ে ১৩টি বৈঠক হয়েছে। ফলপ্রসূ আলোচনাও হয়েছে। তাদের বোনাস বৃদ্ধি, গামছা ও টুকরি বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন বিষয়ে আমরা একমত হয়েছি। বর্ধিত মজুরিরও একটি প্রস্তাবনা আমরা দিয়েছি। এই ইন্ডাস্ট্রিকেওতো টিকিয়ে রাখতে হবে। গত ১০ বছর ধরে চা পাতার মূল্য বৃদ্ধি পায়নি। কিন্তু ১০ বছরে চা শ্রমিকদের বেতন কয়েক দফা বৃদ্ধি করা হয়েছে।’ এ সময় তিনি আরও বলেন, ‘২ টাকা কেজি দরে শ্রমিকদের সাপ্তাহে একবার আটা দেয়া হয়, বাসস্থান, চিকিৎসা, শিক্ষা সবকিছুই আমরা দিচ্ছি। এই হিসেব করলে তাদের দৈনিক মজুরি দাঁড়ায় প্রায় সাড়ে ৩ শত টাকা।’ শ্রীমঙ্গলস্থ বিভাগীয় শ্রম দপ্তরের উপ-পরিচালক মোহাম্মদ নাহিদুল ইসলাম জানিয়েছেন, ‘আইন অনুযায়ী উভয় পক্ষের মধ্যে সমোজতা চুক্তি না হলে তারা শ্রম দপ্তরে লিখিতভাবে জানাবে। শ্রম দপ্তর তা আমলে নিয়ে ১০ কর্মদিবস থেকে ৩০ কর্মদিবসের মধ্যে তা সমাধানের ব্যবস্থা নিবেন।’ তিনি বলেন, ‘এ বিষয়ে মালিক-শ্রমিক কোনো পক্ষই তাদের অবগত করেনি। এরপরও তিনি নিজ উদ্যোগে বিষয়টি সুরাহার জন্য তিনি তার ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে অবগত করেছেন।’

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status