ঢাকা, ২৩ এপ্রিল ২০২৪, মঙ্গলবার, ১০ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৩ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক দূত আসছেন আজ

মিজানুর রহমান
১৪ আগস্ট ২০২২, রবিবার
mzamin

তাৎপর্যপূর্ণ এক সফরে আজ ঢাকা আসছেন  বৈশ্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত জাতিসংঘের সর্বোচ্চ কর্মকর্তা মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল বাশেলেট। চারদিনের সফরে ভোরে তিনি বাংলাদেশে পৌঁছাচ্ছেন। জাতিসংঘের শীর্ষ ওই কর্মকর্তা এমন এক সময় আসছেন যখন মানবাধিকার লঙ্ঘনের গুরুতর অভিযোগে বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র‌্যাব এবং এর উচ্চ পর্যায়ের সাবেক ও বর্তমান ৭ কর্মকর্তার ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। যে নিষেধাজ্ঞার খড়গ থেকে মুক্তি পেতে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের নেতৃত্বাধীন প্রশাসনের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকার আট মাস ধরে দেন-দরবার করছে। ওয়াশিংটনের তরফে বরাবরের মতো বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির অগ্রগতি দৃশ্যমান করার তাগিদ পুনর্ব্যক্ত করা হচ্ছে। অবশ্য সেগুনবাগিচার দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা মনে করেন, বিদ্যমান নিষেধাজ্ঞার প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘ দূতের সফরটি ইতিবাচক ফল দিতে পারে। তাদের মতে, ডিসেম্বরে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা জারির সময় যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে তা নিরসন তথা দেশের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নয়নে সরকার ইতিমধ্যে বেশকিছু পদক্ষেপ নিয়েছে, যা ওই সফরে তুলে ধরার সুযোগ পাবে ঢাকা। 

বাশেলেটের সফরে ইতিবাচক কোনো স্টেটমেন্ট আদায় করা গেলে তা কেবল বহুপক্ষীয় ফোরামই নয় বরং যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় সহায়ক টুল হতে পারে। যথোপযুক্ত প্রটোকল এবং সর্বোচ্চ শুরুত্বের সঙ্গে অত্যাসন্ন সফরটি বাস্তবায়নের তাগিদ দিয়ে সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে পাঠানো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নোটেও এমন আশাবাদী কথাবার্তার উল্লেখ রয়েছে। নোটের ব্যাকগ্রাউন্ড চ্যাপ্টারে বলা হয়েছে, সিভিল অ্যান্ড পলিটিক্যাল রাইটস বিশেষত অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকারসহ বাংলাদেশের মানুষের সর্বজনীন মানবাধিকার নিশ্চিতে সরকারের বহুমুখী পদক্ষেপ এবং দৃশ্যমান অর্জন রয়েছে। বিশেষ করে ২০১৩ সালে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির উন্নতির তাগিদ দিয়ে জাতিসংঘ যে ১৭৮ দফা সুপারিশ করেছিল তার বেশির ভাগই বাস্তবায়ন করেছে সরকার।

বিজ্ঞাপন
কিন্তু তা সত্ত্বেও ‘রাষ্ট্র এবং সরকার বিরোধী গোষ্ঠী’ মানবাধিকারের উন্নতির প্রশ্নে সরকারকে কম সফল বলে দুনিয়ার সামনে উপস্থাপনের প্রচেষ্টায় রত। জাতিসংঘ দূত মিশেলের সফরকে সামনে রেখেও তারা তাদের টার্গেটেড ক্যাম্পেইন শুরু করেছে। যা বাশেলেটের সাম্প্রতিক চীন সফরের পর আরও জোরালো হয়েছে।

 ‘বিরোধী গোষ্ঠী’ পশ্চিমাদের সঙ্গে সুর মিলিয়ে বাশেলেটকে চাপে রাখছেন দাবি করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নোটে বলা হয়, এটা সম্ভবত এজন্য যে, যেন বাশেলেট এর ঢাকা সফরের সমাপনীতে বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতির কড়া সমালোচনা করে একটি বিবৃতি আদায় করা যায়! বিরোধীদের পদক্ষেপ এবং রিস্ক ফ্যাক্টর সত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘ দূত বাশেলেটকে স্বাগত জানানো এবং যথাযথ গুরুত্ব দিয়ে তার সফর বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে নোটে উল্লেখ করা হয়। চিলির সাবেক প্রেসিডেন্ট মিশেল বাশেলেট এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জীবন ও রাজনৈতিক উত্থানের পেছনে সমান বিয়োগান্তুক গল্প রয়েছে, তাদের পরস্পরের মধ্যে যোগাযোগ এবং ঘনিষ্ঠতাও আছে বলে দাবি করে সরকারের দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা গতকাল মানবজমিনকে বলেন, জাতিসংঘ দূত হিসেবে এটাই হবে তার প্রথম এবং শেষ বাংলাদেশ সফর। কারণ তিনি ওই পদে দ্বিতীয় মেয়াদে না থাকার ঘোষণা দিয়েছেন। ফলে জাতিসংঘ যেভাবে চেয়েছে সেভাবেই তার সফরটি অনুষ্ঠিত হচ্ছে।

 তার সফর মানবাধিকার পরিস্থিতির অগ্রগতির একটি খণ্ডচিত্র তুলে ধরার সুযোগ হিসেবে বাংলাদেশ গ্রহণ করেছে বলেও জানানো হয়। উল্লেখ্য, সফরের প্রথম দিনেই (আজ) পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল, আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এবং শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মনির সঙ্গে বৈঠক করবেন। কাল যাবেন কক্সবাজারে। সেখানে বাংলাদেশের মানবিক আশ্রয়ে থাকা মিয়ানমার থেকে বলপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের অবস্থা দেখা ছাড়াও শরণার্থী, ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনারের সঙ্গে বৈঠক করবেন তিনি। কক্সবাজার থেকে ফিরে আগামী ১৭ই আগস্ট প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করবেন। একই দিনে রাজধানীর ইস্কাটনস্থ বিস মিলনায়নে একটি সেমিনারে বক্তৃতা করার পাশাপাশি ঢাকার জাতিসংঘ অফিসের আয়োজনে বাংলাদেশে থাকা পশ্চিমা কূটনীতিক, আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধি, মানবাধিকার কর্মী ও এনজিও প্রতিনিধি দলের সঙ্গে পৃথক পৃথক রুদ্ধদ্বার বৈঠক করবেন। কূটনৈতিক সূত্রের ধারণা মিশেল বাশেলেটের সফরে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যাসহ মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো নিয়ে আলোচনা হতে পারে। 

স্মরণ করা যায়, বহু বছর ধরে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার এবং তার দপ্তর ‘অফিস অব দ্য ইউনাইটেড ন্যাশন্স হাইকমিশনার ফর হিউম্যান রাইটস’ (ওএইচসিএইচআর)-এর র‌্যাপোর্টিয়াররা বাংলাদেশ সফরের আগ্রহ দেখিয়ে আসছেন। কিন্তু শিডিউল জটিলতা এবং অন্য সীমাবদ্ধতায় তা হয়ে ওঠেনি। 

মিশেল বাশেলেটের সফর: পররাষ্ট্র সচিব যা বললেন- এদিকে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল বাশেলেটের সফর বিষয়ে পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন গণমাধ্যমকে বলেন, এই প্রথমবার কোনো মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার বাংলাদেশ সফর করছেন। আমরা তাকে স্বাগত জানাই। এ সফরে আমরাও সুযোগ পাবো আমাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করার এবং আমরা কী করেছি সেটি বলার। একদিকে যেমন কী কী হয়নি সেটির অভিযোগ তিনি জানবেন, অন্যদিকে অনেক কিছু হয়েছে সেটিও বলার সুযোগ তৈরি হয়। দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন বিষয়ে অনেক ধরনের অভিযোগ পাওয়া যায় উল্লেখ করে পররাষ্ট্র সচিব বলেন, এর কিছু অভিযোগ খতিয়ে দেখার মতো, আবার অনেকগুলোর কোনো ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। পত্রিকায় যা প্রকাশ হয়, সেখানে যে সবকিছু বলা হয় সেটাও নয়। 

অনেক সময় হয়তো, অভিযোগকারীর কথা বেশি বলা হয়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে সেটির খবর প্রকাশ হয় না বলেও দাবি করেন তিনি। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, অনেক সময়ে সংবাদপত্রে কোনো অভিযোগ প্রকাশ হওয়ার পরে অনুসন্ধান করে তেমন কিছু খুঁজে পাওয়া যায় না। কিন্তু এটি যেহেতু ছাপা হয়েছে সেটি অভিযোগের তালিকার মধ্যে ঢুকে যায়। অনেক এনজিও যেমন অধিকার এমন সব খবর দেয় যেগুলোর বাস্তবে কোনো ভিত্তি খুঁজে পাওয়া যায় না। ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ নিয়ে এ ধরনের ভিত্তিহীন কিছু রিপোর্ট হয়েছিল। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘন, ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের অপব্যবহারসহ বিভিন্ন অভিযোগ রয়েছে সরকারের বিরুদ্ধে। এ বিষয়ে সচিব বলেন, সামপ্রতিক যে ইস্যুগুলো আছে যেমন ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন সেটি নিয়ে অনেক ভুল ধারণা আছে এবং অভিযোগ আছে। এ নিয়ে কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বা আইন বা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক হবে; সেখানে আমরা বোঝানোর চেষ্টা করবো যে, কোনো আইনই শতভাগ সঠিক নয়। এর বাস্তবায়নের সময়ে অনেক ক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটে। এজন্য আমরা কী ব্যবস্থা গ্রহণ করছি, সেটি বলা যাবে। সব অধিকারের বিষয়ে বাংলাদেশ শ্রদ্ধাশীল জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের সংবিধানে অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থানের কথা যেমন বলা আছে; তেমনি মত প্রকাশের এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার কথাও বলা হয়েছে। সরকার সবার সঙ্গে গঠনমূলক আলোচনা করতে চায় এবং এর মাধ্যমে সমাজব্যবস্থা তথা রাষ্ট্রের জন্য মঙ্গলকর বিষয়গুলো নিশ্চিত করতে চায়। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, সরকারের সংশ্লিষ্ট এজেন্সি, জাতীয় মানবাধিকার সংস্থা, এনজিও, একাডেমিয়া, সুশীল সমাজ, গবেষণা প্রতিষ্ঠানসহ অন্যরা এই ধরনের সফরে আলোচনায় অংশগ্রহণ করতে পারে।

 এর ফলে বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের কাছ থেকে তিনি বিষয়টি সরাসরি শুনতে পাবেন। সচিব বলেন, ফলে বাস্তব অবস্থা বিশেষ করে স্বরাষ্ট্র বা আইন মন্ত্রণালয় নিজেদের অবস্থান ব্যাখ্যা করার সুযোগ পায়। এ ধরনের গঠনমূলক আলোচনা যে কোনো সমাজব্যবস্থা বা রাষ্ট্রের জন্য ভালো। মানবাধিকার কাউন্সিল প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরে প্রায় প্রতিটি কার্য নির্বাহী কমিটিতে বাংলাদেশ সদস্য ছিল। ২০২৩-২৪ মেয়াদের কার্য নির্বাহী কমিটিতে নির্বাচন করছে বাংলাদেশ। এ কারণে এই সফরকে বাড়তি গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। মাসুদ বিন মোমেন বলেন, আমরা মানবাধিকার কাউন্সিলের নির্বাহী সদস্য হওয়ার জন্য প্রার্থিতা ঘোষণা করেছি এবং সেজন্য আমাদের বাড়তি কিছু করার প্রয়োজন আছে। আমাদের দিক থেকে আগ্রহ আছে। জেনেভাতে বিভিন্ন র‌্যাপোর্টিয়ার আছে এবং হাইকমিশনার নিজে বিভিন্ন দেশে সফর করে সরজমিন মানবাধিকার পরিস্থিতি দেখেন এবং কোনো ত্রুটি থাকলে সংশ্লিষ্ট দেশের সঙ্গে আলোচনা করেন বলেও জানান পররাষ্ট্র সচিব। তিনি বলেন, বাংলাদেশ অনেক সময় তাদের আমন্ত্রণ জানায় অথবা তারা আসার আগ্রহ ব্যক্ত করলে আমরা স্বাগত জানাই। কিন্তু কোভিডের জন্য ওই সফর কিছুদিন বন্ধ ছিল। সম্ভবত হাইকমিশনার হিসেবে এটি তার শেষ সফর। এরপর মানবাধিকার কাউন্সিলের যে সেশন আছে সেখানে তিনি দায়িত্ব হস্তান্তর করবেন বলে জানান তিনি। হাইকমিশনার কক্সবাজারে রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করবেন। পররাষ্ট্র সচিব বলেন, তিনি কক্সবাজারে যাবেন, সেখানকার সুবিধা-অসুবিধা দেখবেন। রোহিঙ্গা শিবিরে আমাদের পক্ষে যতটুকু করা সম্ভব সবটুকু আমরা করছি। 

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status