ঢাকা, ১৪ মে ২০২৫, বুধবার, ৩১ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৫ জিলক্বদ ১৪৪৬ হিঃ

দেশ বিদেশ

ছাত্র আন্দোলনে নিহত হাফেজ সাদিক এখন শুধুই স্মৃতি

ঘাটাইল (টাঙ্গাইল) প্রতিনিধি
১৪ মে ২০২৫, বুধবার
mzamin

মো. সাদিক। একজন পূর্ণাঙ্গ হাফেজ। তার মধুর কণ্ঠের তিলাওয়াত শুনে সহপাঠীরা অনুকরণ করতেন তাকে। স্বপ্ন ছিল বড় হয়ে মাওলানা হয়ে মায়ের দুঃখ-কষ্ট দূর করে পরিবারের আর্থিক সচ্ছলতা আনবে। সে স্বপ্ন বুকে নিয়ে টাঙ্গাইলের প্রত্যন্ত পাহাড়ি জনপদের তরুণ সাদিক পাড়ি জমিয়েছিল ঢাকা শহরে কেবল পড়াশোনা করতে নয়, একজন আলোকিত মানুষ হতে। কিন্তু স্বপ্ন পূরণের পথে বুকভরা আশা নিয়ে তার এই পথচলা থেমে গেল অকালেই, ঢাকা শহরে পা রাখার কয়েক বছরের মধ্যেই ইতি ঘটলো তার যাবতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষা ও চাওয়া-পাওয়ার। জীবনের সমস্ত স্বপ্ন-সাধ, সম্ভাবনা আর মায়ের মুখে হাসি ফোটানোর অতৃপ্ত বাসনা পেছনে ফেলে সে এখন শুধুই একটি স্মৃতি। ‘শহীদ’ নামের এক ভারী পরিচয়ে ঢাকা পড়েছে হাফেজ সাদিকের, সমস্ত অপূর্ণ স্বপ্ন, অপরিমেয় সম্ভাবনা আর লালিত বাসনা।
উচ্চশিক্ষা নিয়ে স্বপ্ন পূরণের আগেই মাত্র ২২ বছর বয়সে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের উত্তাল সময়ে পুলিশের গুলিতে নিহত হয়ে শহীদের তালিকায় নাম লিখিয়েছে সাদিক। পারিবারিক সূত্রে জানা যায়, গণ-অভ্যুত্থানের সেই উত্তাল সময় ২৬শে জুলাই শুক্রবার ২০২৪ ঢাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ব্যাপকভাবে রাজপথে ছড়িয়ে পড়েছিল। সেদিন জুমার নামাজ শেষে সহপাঠী বন্ধুদের সঙ্গে রাজপথে বিক্ষোভ মিছিলে যোগ দেন সাদিক। এ সময় পুলিশ মিছিলে গুলিবর্ষণ করলে একটি গুলি সাদিকের পিঠ ভেদ করে নাভির পাশে আটকে যায়। নিভে যায় দুখিনী মায়ের স্বপ্ন। 
পরিবারের লোকজন সেদিন অনেক খোঁজাখুঁজি করেও খবর পাননি। পরদিন ২৭শে জুলাই শনিবার উত্তরা আধুনিক মেডিকেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ একটি গুলিবিদ্ধ লাশের পরিচয় না পেয়ে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফনের প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
লাশের শরীরে ইসলামী পোশাক ও চেহারা-সুরত দেখে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আশপাশের মাদ্রাসাগুলোতে খবর দেয়। খবর পেয়ে আবদুল্লাহপুর উত্তরা জামিয়া দীনিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার সুপার গিয়ে সাদিকের লাশ শনাক্ত করেন। পরে উত্তরা আধুনিক মেডিকেল হাসপাতাল থেকে তার লাশ টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার ফুলবাড়ীয়া করিমগঞ্জ ঘোনা পাড়া এলাকায়  পৌঁছে দেয়া হয়।
সাদিকের বাড়ি টাঙ্গাইলের ঘাটাইল উপজেলার সাগরদীঘি ইউনিয়নের ফুলবাড়ীয়া করিমগঞ্জ ঘোনাপাড়া গ্রামে। সরজমিন কথা হয় সাদিকের মা শাহনাজ বেগমের সঙ্গে। তার মুখে ছড়িয়ে রয়েছে বিষণ্নতার ছাপ। সাংবাদিক এসেছেন শুনে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। দীর্ঘ সময় কথা হয় প্রতিবেদকের সঙ্গে। শাহনাজ বেগম (৫৫) জানান, সাদিকের বাবা লুৎফর রহমান লেবু একজন কুয়েতপ্রবাসী। তিন ছেলের মধ্যে সাদিক ছিল দ্বিতীয়। বড় ছেলে শামীম সিঙ্গাপুরপ্রবাসী এবং ছোট ছেলে শাহেদ ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়াশোনা করছে। সাদিক সখিপুরের আড়াইপাড়া মাদ্রাসা থেকে হাফেজী শেষ করে ঢাকার আবদুল্লাহপুর জামিয়া দীনিয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসায় হাদিস বিষয়ে ভর্তি হয়ে পড়াশোনা করছিল।
সাদিকের মা মানবজমিনকে বলেন, ‘সাদিক প্রায়ই বলতো, ‘মা, তুমি সংসারের জন্য এত কষ্ট করো, সেটা দেখতে আমার আর ভালো লাগে না। আমি বড় মাওলানা হলে তখন আর তোমাকে কোনো পরিশ্রম করতে দেবো না। বাড়িতে টিনের ঘরটা আমি বিল্ডিং বানিয়ে দেবো। তুমি শুধু নামাজ পড়বে আর ঠিকমতো খাওয়া-দাওয়া করবে। এটাই ছিল সাদিকের সঙ্গে আমার শেষ কথা। আমার ছেলেকে আমি আর ফিরে পাবো না।’ এ কথা বলে হাউমাউ করে কেঁদে ওঠেন তিনি।
তিনি আরও বলেন, আমার শহীদ পুত্র সাদিক পবিত্র কোরআনের হাফেজ। সে জীবনের শেষদিন পর্যন্ত দিনি শিক্ষা গ্রহণ করেছে ও দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। আল্লাহ্‌ তা’আলা তাকে শহীদের মর্যাদা দেবেন বলে আমি বিশ্বাস করি। সময় তিনি কেঁদে  বলেন, শেখ হাসিনার নির্দেশেই পুলিশ আমার ছেলেকে হত্যা করেছে। আমি চাই, সরকার দোষীদের বিচারের আওতায় আনুক। আমি আমার জীবদ্দশায় হত্যাকারীদের মৃত্যুদণ্ড দেখে যেতে চাই। 
সাদিকের ছোট ভাই শাহেদ বলেন, ভাইয়া খুব ভালো মানুষ ছিলেন। মাওলানা হয়ে বিদেশে যাওয়ার ইচ্ছা ছিল ভাইয়ার। সেটি পূরণ হলো না। যারা আমার নিরপরাধ ভাইকে নির্মমভাবে গুলি চালিয়ে হত্যা করেছে, তাদের যেন এ দেশের মাটিতেই বিচার হয়। তাহলেই আমার ভাইয়ের আত্মা শান্তি পাবে। সাদিকের চাচা মো. মাসুদ জানান,  সাদিকের মৃত্যুর পর ওর মা শাহনাজ বেগম মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন। ছেলে সাদিককে খুব ভালোবাসতেন তিনি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ঘাটাইলের অন্যতম সমন্বয়ক রাকিবুল হাসান রাকিব জানান, শত শত শিক্ষার্থী শহীদ হয়েছে এই আন্দোলনে। তাদের মধ্যে আমাদের ঘাটাইল উপজেলার হাফেজ সাদিক অন্যতম। আমাদের চাওয়া, সাদিকের রাষ্ট্রীয় মর্যাদার পাশাপাশি হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি। এ ব্যাপারে ঘাটাইল উপজেলার নির্বাহী অফিসার মো. আবু সাঈদ বলেন,  হাফেজ সাদিক দেশের গর্ব। সে দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। তিনি আমাদের অকুতোভয় বীর।

দেশ বিদেশ থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

দেশ বিদেশ সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status