ঢাকা, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

দেশ বিদেশ

অসহায় মানুষের পাশে ‘মঙ্গল আলোয় ফাউন্ডেশন’

স্টাফ রিপোর্টার
১৩ আগস্ট ২০২২, শনিবার
mzamin

শুক্রবার দুপুর ১টা। রাজধানীর ঢাকা উদ্যানের সি ব্লকে মানুষের ভিড়। কয়েকজন রাস্তার উপর ত্রিপল দিয়ে বিছানা করেছেন। সেখানে সারিবদ্ধ হয়ে বসা প্রায় ৪ শতাধিক মানুষ। সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আশপাশের মানুষও জড়ো হতে থাকে। পাশেই খাবার ভর্তি কয়েকটি বড় ডেক (পাত্র)। দুপুর ২টায় জুমার নামাজ শেষ। কয়েকজন তরুণ-তরুণী প্লেটে করে বিরিয়ানি বিতরণ করছেন। কেউ কেউ বিতরণ করছেন খাবার পানি। কেউবা মিষ্টি দধি।

বিজ্ঞাপন
শিশু থেকে বয়োবৃদ্ধ সবাই খেলেন সেই খাবার। কয়েকজন বললেন, মঙ্গল আলোয় ফাউন্ডেশন আমাদের সব সময় বিরিয়ানি ও খিচুড়ি খাওয়ায়। আজ মজা করে বিরিয়ানি খেলাম। প্রতি শুক্রবার এখানে এসে তৃপ্তি মিটিয়ে খাবার পাওয়া যায়। আয়োজকরা আমাদেরকে মেহমান হিসেবে সম্মান করে। আলী হোসেন নামের এক বৃদ্ধ বলেন, শুক্রবার দুপুর হলেই ঢাকা উদ্যানের সি ব্লকের ৩ নম্বর রোডে চলে আসি। এখানে পেট পুরে খেতে পারি। আমার মতো যারা নিজ বাসায় গোশত দিয়ে খাবার খেতে পারে না, তারা এখানে এসে গোশত, বিরিয়ানি খায়। ২ বছরের বেশি সময় ধরে এখানে খাচ্ছি। 

করোনার সময় যখন খাবারের চিন্তায় ছিলাম, তখন মঙ্গল আলোয়’ এর নার্গিস সুলতানা আপা ও তার সহকর্মীরা প্রতিদিন বাসায় খাবার দিয়ে যেতেন। এই এলাকার প্রত্যেকটি অসহায় পরিবার আপার হাতের খাবার খেয়েছেন। এখন আর খাবার নিয়ে চিন্তা করি না। কোনো কিছুর প্রয়োজন হলেই এখানে এসে পেয়ে যাই। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রায় আড়াই বছরের অধিক সময় ধরে অসহায় ও ক্ষুধার্তদের মাঝে খাদ্য বিতরণ করে আসছে মঙ্গল আলোয় ফাউন্ডেশন নামে একটি সংগঠন। ২০২০ সালের ২৬শে মার্চ থেকে একদল তরুণ তরুণীর উদ্যোগে চলে এ আয়োজন। প্রথমদিকে করোনা মহামারি দেখা দিলেও থেমে যায়নি সংগঠনের স্বেচ্ছাসেবীরা। 

দেশ যখন লকডাউন, মানুষ খাবারের চিন্তায় দিশেহারা, তখন রাজধানীর মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন এলাকায় নিজেদের পরিচয় লুকিয়েই, নিজস্ব অর্থায়নে অসহায় ও দরিদ্র মানুষের ঘরে ঘরে খাবার পৌঁছে দিতেন তারা। পরবর্তীতে করোনার প্রকোপ কমে গেলে প্রতি শুক্রবার খোলা আকাশের নিচে কখনো খিচুড়ি বা বিরিয়ানি, আবার কখনো কখনো তেহারি কিংবা মাছ, মাংস দিয়ে সাদাভাত খাওয়াচ্ছেন ক্ষুধার্তদের। ভিক্ষাবৃত্তিকে নিরুৎসাহিত করতে ‘স্বাবলম্বী প্রজেক্ট’ নামে অসহায়দের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছে সংগঠনটি। মঙ্গল আলোয় ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় গত ২ বছরে কয়েকশ’ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ব্যবসা করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। 

 

 

এছাড়া এ বছরে সিলেটে ভয়াবহ বন্যায় ঢাকা থেকে খাদ্যসামগ্রী নিয়ে বন্যার্তদের মাঝে সপ্তাহব্যাপী খাবার বিতরণ করেছে সংগঠনটি। শুরু থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় শতাধিক স্বেচ্ছাসেবী নিয়মিত সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। ঢাকা উদ্যানের স্থানীয়রা বলছেন, করোনার সময় এই এলাকার মানুষ দিশেহারা হয়ে যায়। খাবারের জন্য প্রতিটি ঘরে ঘরে হাহাকার দেখা দেয়। ঠিক সেই সময় হঠাৎ করেই মঙ্গল আলোয় ফাউন্ডেশন আমাদের পাশে দাঁড়ায়। নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগঠনের লোকজন মাথায় করে, ভ্যানে করে ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়েছেন। এখনো তাদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। শুক্রবার এলেই এখানকার মানুষের মুখে হাসি ফুটে। ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা ঈদের মতো আনন্দ করে। খাবার খেয়ে খুশি মনে আবার চলে যায়। এখানকার মানুষের সঙ্গে তাদের ভালোবাসার কমতি নেই। এ ছাড়া, প্রায় দেড় হাজার দুঃস্থ ও মধ্যবিত্ত পরিবারকে নিয়মিত খাদ্য সহযোগিতা দিয়ে আসছে সংগঠনটি। রমজান মাসে গরিব পথচারীদের ইফতারির ব্যবস্থা, প্রতিবন্ধী শিশু ও পরিবারদের খাদ্য ও পোশাক-পরিচ্ছদ দিয়ে সহায়তা, অর্থাভাবে চিকিৎসা হতে বঞ্চিতদের অর্থ ও অন্যান্য সহায়তা দিয়ে সুচিকিৎসার ব্যবস্থা, পঙ্গু ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের খাদ্য ও চিকিৎসা সহায়তা, গরিব ও দুঃস্থ পরিবারের শিশুদের মাঝে ফলমূল ও খাদ্য বিতরণ, ভাসমান ও দুঃস্থ বেদে পরিবারদের খাদ্য ও আর্থিক সাহায্য, শেরপুর ও সিলেটসহ অন্যান্য এলাকার বন্যার্ত প্রায় ১১০০ পরিবারকে খাদ্যদ্রব্যসহ  অন্যান্য সহযোগিতা করে আসছে সংগঠনটি।

‘মঙ্গল আলোয় ফাউন্ডেশন’র প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারম্যান নার্গিস সুলতানা মানবজমিনকে বলেন, মানুষকে করুণা নয়। ভালোবাসি। দরিদ্র ও অসহায় মানুষের মুখে হাসি ফোটানোই আমার লক্ষ্য। মানবসেবাই আমাদের কাজ। আমার সংগঠনের সবাই নিজেদের জায়গা থেকে মানবতার সেবায় এগিয়ে এসেছে। নিয়মিত কাজ করছেন। কোনো বাধা বিপত্তি আমাদের কার্যক্রম ঠেকাতে পারেনি। আমরা যাদের সহযোগিতা করছি, তারা আমাদের মেহমান। আমাদের অতিথি হিসেবেই প্রতি শুক্রবার দুপুরে ভালো ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার দিয়ে আসছি। শুক্রবার হলেই মানুষজন এখানে চলে আসে। আমরা নিজেরা রান্না করি। আমাদের সামর্থ্য দিয়ে চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমাদের কাজে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকেই আমাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন। অনেকেই আমাদের মাধ্যমে এখানে খাবার দিয়ে যাচ্ছেন। যারা ব্যস্ততার জন্য মানবসেবা করতে পারছেন না, আমরা চাই তারা আমাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে দরিদ্র ও অসহায় ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে দাঁড়াবে। 

তিনি বলেন, ২০২০ সালের ৮ই মার্চ প্রথম করোনায় আক্রান্ত রোগী শনাক্তের পর মানুষের জন্য কিছু করার কথা মাথায় আসে। ২৬শে মার্চে আমরা কয়েকজন সমমনা বন্ধু মিলে ‘মঙ্গল আলোয় ফাউন্ডেশন’র যাত্রা শুরু করি। প্রথম ১০০ মধ্যবিত্তকে সহায়তার মাধ্যমে এই কাজ শুরু করি। আমরা এক মাসের বাজার একটা কার্টনে ভরে আগে থেকে লিস্ট করা অভাবগ্রস্ত পরিবারের দরজার সামনে রেখে কলিং বেল চেপে চলে আসতাম। শুধু আমাদের লোগো থাকতো কার্টনের উপর। আমরা তাদের সঙ্গে দেখা করতাম না, কারণ তারা যদি অস্বস্তি বোধ করেন। কারণ এই মানুষগুলো অভাবে থাকলেও কারও কাছে চাইতে পারবে না, তাদের সাহায্যটা জরুরি ছিল। সেই থেকে এখন পর্যন্ত আমাদের কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আমার মনে হয়, এখানকার মানুষগুলো খাবারের আশায় থাকে। তাই কষ্ট হলেও চালিয়ে যাচ্ছি। লকডাউনে আমরা প্রতিদিন খাওয়াতাম। গত বছর শেষ লক ডাউনেও আমরা টানা ১৯ দিন খাইয়েছি। বর্তমানে প্রতি শুক্রবার দুপুরে ৩০০ থেকে ৪০০ মানুষের খাবার ব্যবস্থা করে থাকি। এখানে আমার পরিচিতজন, বন্ধু ও কিছু মহৎ ব্যক্তির আর্থিক সহায়তায় আমরা এই মঙ্গল আলোয় ফাউন্ডেশনের কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। নার্গিস সুলতানা বলেন, এছাড়াও আমরা মোহাম্মদপুরের বিভিন্ন বস্তি এলাকায় ৩০ জন শিশুকে কোরআন শিক্ষা দিচ্ছি। 

‘স্বাবলম্বী প্রজেক্ট’ নামে ভিক্ষাবৃত্তিকে নিরুৎসাহিত করে তাদের কর্মসংস্থানে নিয়ে আসছি ছোট ছোট ব্যবসা করে দিয়ে। আমাদের আর একটা উদ্যোগ আছে পরিকল্পনায়। ১২ থেকে ১৪ বছরের কিছু মেয়ে আছে, যারা আগে ভিক্ষা করতো। জানতে পারি, বস্তির কিছু মেয়ে পালাক্রমে ৫ থেকে ৭ দিনের জন্য নিয়ে যেতো ভিক্ষা করতে। এভাবে ভিক্ষা করতে গিয়ে অনেক মেয়ে পাচারের শিকার হয়। এই বিষয়টা জানার পর আমার একটা আগ্রহ জাগলো বিষয়টা জানার। বস্তিতে গিয়ে দেখি, একেকটা পরিবারে ৫/৭ জন সদস্য। তারা ঠিকমতো খেতে পারছে না। প্রয়োজনীয় কিছুই অভিভাবকরা দিতে পারছে না। তখন আর তারা ভালো-মন্দ বিষয় না জেনেই ছেলে-মেয়েদের অনুমতি দিয়ে দেয়, ‘যাও রোজগার করে এনে খাও’। এভাবেই অনেক মেয়ে ৫/৭ দিনের জন্যে পরিবারের বাইরে গিয়ে থাকছে। বাইরে থাকতে গিয়ে কিছু মেয়ে অনাকাঙ্ক্ষিত গর্ভবতী হয়ে পড়ছে, কিছু উঠতি বয়সী মেয়ে পাচারের শিকার হচ্ছে। আমি এই মেয়েদের নিয়ে কাজ করতে চাচ্ছি। ওই মেয়েদের অভিভাবকদের সঙ্গে কথা হয়েছে, একটি রুম ভাড়া করে একটা ট্রেনিং সেন্টার করে দিতে চাই। যেখানে ওই মেয়েরা কাজ করবে। 

এছাড়াও ফাউন্ডেশনটি  নিয়মিতভাবে অসহায়, সুবিধাবঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষকে সাহায্য ‘সকাতরে-মানবের তরে’; সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের শিক্ষা, সাস্থ্য, নিরাপত্তাসহ অন্যান্য মৌলিক চাহিদার সহায়তায় ‘ওরাও মানুষ’; নারীদের কল্যাণে ‘উন্নয়নে নারী’; অসহায় বৃদ্ধ/বৃদ্ধাদের পাশে দাঁড়াতে অর্থ, দ্রব্য, মনোবল, সাহস দিয়ে ‘বটবৃক্ষের ছায়াতলে’; শারীরিক ও মানসিক প্রতিবন্ধীদের জন্য ‘বিশেষ মানুষ বিশেষ অধিকার’; পরিবার পরিকল্পনার জন্য ‘সুখী পরিবার’; নিয়মিতভাবে রক্ত দানের মাধ্যমে এবং চিকিৎসা সেবার সুযোগ করে দিয়ে অসুস্থ ব্যক্তিদের সাহায্যে ‘জীবন বাঁচাই’; প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলায় ‘দুর্যোগে দুর্নিবার’; সদস্য/সদস্যাসহ সকল শাখার প্রয়োজনে সুবিধাবঞ্চিতদের জন্যে সাংস্কৃতিক চর্চা/সুস্থ বিনোদনে ‘মঙ্গল আলোয় ফাউন্ডেশন সাংস্কৃতিক সংঘ’ শাখা খোলা হয়েছে। 

নার্গিস সুলতানা বলেন, আমি লক্ষ্য করেছি ১৫-১৮ বছরের অনেক মেয়েরা দিনের বেলা রাস্তায় ফুল বিক্রি করে। রাতে তাদের ঘুমের জায়গা না থাকায় যত্রতত্র ঘুমায়। ফলে তারা অনেক খারাপ কাজের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে। আমি তাদের সঙ্গে কথা বলেছি, তাদের বুঝিয়েছি। তারা আমাকে জানিয়েছে, কাজের সুযোগ হলে তারা এসব কাজ ছেড়ে দেবেন। এসব মেয়েদের কর্মসংস্থানের জন্য কাজ করছে মঙ্গল আলোয় ফাউন্ডেশন। তিনি আরও বলেন, মঙ্গল আলোয় ফাউন্ডেশন একটি দাতব্য প্রতিষ্ঠান। সকলের সহযোগিতায় এই কার্যক্রম চলমান। তাই মানুষের আস্থার জায়গা ঠিক রাখতে আমরা ইতিমধ্যেই আরজেএসসি থেকে আমাদের ফাউন্ডেশনের রেজিস্ট্রেশন সম্পন্ন করেছি। এছাড়াও সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকেও রেজিস্ট্রেশন প্রক্রিয়া চলমান। ভবিষ্যতে পথশিশুদের জন্য একটি স্কুল প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখছি। কেউ যদি আমাদের কাজে সহযোগিতা করতে চায়, তাহলে আমরা তাদেরকে স্বাগত জানাবো।
 

দেশ বিদেশ থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

দেশ বিদেশ সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status