ঢাকা, ২৯ মার্চ ২০২৪, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

বাংলাদেশের ক্রিকেট কি সুদূরপ্রসারী কোনো পরিকল্পনার মধ্যদিয়ে হাঁটছে?

খেলায় জয়-পরাজয় থাকবেই তাই বলে এমন পরাজয়?

রেজানুর রহমান
১২ আগস্ট ২০২২, শুক্রবার
mzamin

খেলা মানেই জয় অথবা পরাজয়। দুর্বল প্রতিপক্ষও খেলায় নেমে জয়ের আশা করে। কখনো কখনো জিতেও যায়। তখন কেউ কেউ সেটাকে বলেন অঘটন। বড় দলের সঙ্গে ছোট দল জিতে গেলে সেটা হয়ে যায় অঘটন। আচ্ছা, আপনাদের কি মনে হয়, বাংলাদেশ ক্রিকেট দল কি বড় দল? এই যে জিম্বাবুয়ের সঙ্গে অব্যাহত গতিতে হেরে যাচ্ছে এটাকে কি আমরা অঘটন বলবো? অঘটন একবার হতে পারে। তাই বলে বারবার ঘটবে? না, এটাকে মোটেই অঘটন বলা যাবে না। তাহলে প্রকৃত অবস্থা কি দাঁড়ালো? ক্রিকেটে এখন বাংলাদেশ শ্রেষ্ঠ নাকি জিম্বাবুয়ে শ্রেষ্ঠ? কে না জানে এই জিম্বাবুয়ে বাংলাদেশের কাছে কতোটা দুর্বল প্রতিপক্ষ ছিল। সেই জিম্বাবুয়ে কি করে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এতটা অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠলো? টি-২০ তে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জিম্বাবুয়ে একটা চমক দেখালো। অর্থাৎ টি-২০ সিরিজ জিতলো।

বিজ্ঞাপন
তখন আমরা বলার চেষ্টা করলাম, টি-২০ তে বাংলাদেশ এখনো সেই ভাবে আস্থার জায়গা তৈরি করতে পারেনি তাই হেরেছে।

 শুরু হলো ওয়ানডে সিরিজ। ক্রিকেটের তিন ফরমেটের মধ্যে এই একটাই বাংলাদেশের জন্য নির্ভার করার মতো জায়গা। ওয়ানডে ফরমেটে বলতে গেলে বাংলাদেশ অনেকটাই অপ্রতিরোধ্য। ওয়ানডের র‌্যাংকিং এ বাংলাদেশের অবস্থান অহংকার করার মতো। সেই ওয়ানডেতেও বাংলাদেশ দুর্বল প্রতিপক্ষ হয়ে উঠলো জিম্বাবুয়ের কাছে। ওয়ানডের প্রথম খেলায় ৩০০’র অধিক রান করার পরও যখন জিম্বাবুয়ের কাছে হেরে গেল তখন আমরা কেউ কেউ বলতে শুরু করলাম, এটা অঘটন। প্রথম খেলায় বাংলাদেশ হেরেছে। দ্বিতীয় খেলায় নিশ্চয়ই ঘুরে দাঁড়াবে। কিন্তু দ্বিতীয় ওয়ানডেতেও হেরে গেল বাংলাদেশ। টি-২০ সিরিজ জেতার পর ওয়ানডে সিরিজও জিতলো জিম্বাবুয়ে। যদিও মাঠে লড়াই করেছে বাংলাদেশ। লড়াই করেই হেরেছে এবং শেষ ওয়ানডেতে লড়াই করে জিতেছে। এটাকেই কি আমরা সান্ত্বনা ভেবে  নেব? কিন্তু বিপক্ষ দল যখন জিম্বাবুয়ে তখন বাংলাদেশের অব্যাহত পরাজয়ের বিশ্লেষণ কি? খেলায় হারজিৎ থাকেই। কাজেই এই পরাজয় স্বাভাবিক ঘটনা। ঘরের মাঠে স্বাগতিক দল একটু এডভানটেজ পায়। মাঠ তাদের। দর্শক তাদের।

 মাঠ সাজায় তাদের মতো করে। কাজেই জিম্বাবুয়ের কাছে বাংলাদেশ হেরেছে এতে আপসেট হওয়ার মতো কিছু হয়নি। এসব হলো যুক্তির কথা। আপনি লড়াই করে হেরেছেন এটা হলো সান্ত্বনার কথা। ইতিহাসের পাতায় আপনার পরাজয়টাই বড় করে লেখা থাকবে। বাংলাদেশ জিম্বাবুয়েতে খেলতে গিয়ে পর পর ক্রিকেটের দুটি ফরমেটেই হেরেছে এটাই লেখা থাকবে ইতিহাসের পাতায়। এখন প্রশ্ন হলো ক্রিকেটে বাংলাদেশের এই হার কি কোনো স্বাভাবিক ঘটনা? তাও আবার জিম্বাবুয়ের কাছে হার? ধরে নিলাম ওদের মাঠ, ওদের দর্শক, ওদের মতো করেই ওরা পিচ বানিয়েছে। তাই ওরা জিতেছে। এটাই কি প্রকৃত সত্য? বাংলাদেশ একজন সিকান্দার রাজার বিরুদ্ধেই মাঠে দাঁড়াতে পারেনি। টি-২০ ও ওয়ানডে সিরিজে জিম্বাবুয়ের একজন সিকান্দার রাজাই বাংলাদেশকে ভুগিয়েছে। 

বলতে গেলে একাই সিংহাসন পুনরুদ্ধারের জন্য লড়াই করেছে। আমাদের খেলোয়াড়দের মধ্যে কেউ কি সিকান্দার রাজার মতো জ্বলে উঠতে পেরেছিলেন? যদিও আমি একজনের সঙ্গে অন্যজনের তুলনা করতে চাই না। কিন্তু টিভিতে মাঠের লড়াই দেখে মনে হয়েছে বাংলাদেশের খেলোয়াড়রা (তাদের প্রতি সম্মান রেখেই বলছি) জিম্বাবুয়ের সঙ্গে খেলতে যাওয়ার আগে জেতার ব্যাপারে অনেকটাই নির্ভার ছিল। দলটা যেহেতু জিম্বাবুয়ে কাজেই দুশ্চিন্তার কোনো কারণ নাই। হেসে খেলে জিতে যাবে বাংলাদেশ। আমার ধারণা এই মনোভাবই বাংলাদেশ দলের জন্য পরাজয়ের বৃত্ত তৈরি করে। পচা শামুকেও কিন্তু পা কাটে। সেটা আরও ভয়ঙ্কর। আমার ধারণা জিম্বাবুয়েকে দুর্বল প্রতিপক্ষ ভেবে নেয়ার মনোভাবই বাংলাদেশকে আজকের বিতর্কিত অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে। বাংলাদেশ ক্রিকেট দল যখন জিম্বাবুয়ের কাছে হারে তখন দলটির সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক।

একটা সময় এই জিম্বাবুয়ের সঙ্গেই বাংলাদেশকে কঠিন লড়াই করতে হয়েছিল। কিন্তু বাংলাদেশ তার ক্রিকেট সামর্থ্যে জিম্বাবুয়ের চেয়ে অনেক সামনে এসে দাঁড়ায়। অথচ আবার যেন একই বৃত্তে দাঁড়িয়েছে দুটি দল। ব্যাপারটা কি সেই খরগোশ ও কাছিমের গল্পের মতো হয়ে গেল। দুই জনের মধ্যে দৌড় প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। খরগোশ বেশ একটা উন্নাসিক ভাব দেখালো। কাছিম কি আমার সঙ্গে দৌড়ে পারবে? শুধু শুধু লড়াইয়ে নেমেছে। খরগোশ মনের আনন্দে দৌড় দিলো। কিছুদূর যাওয়ার পর তার মনে হলো কাছিম তার থেকে অনেক পেছনে পড়ে আছে। কাজেই একটু বিশ্রাম নিলে কেমন হয়! বিশ্রাম নিতে গিয়ে খরগোশ ঘুমিয়ে পড়লো। কিন্তু কাছিম একটি বারের জন্য বিশ্রামের কথা ভাবেনি। সে বিরামহীন গতিতে হেঁটেছে। জয়টা তারই হয়েছে? 

বাংলাদেশ ক্রিকেট দল কি চতুর খরগোশের মতো জিম্বাবুয়েকে গুরুত্ব দিতে চায়নি? একটি ঘটনার কথা মনে পড়ছে। বাংলাদেশের গর্ব সাকিব আল হাসানের সঙ্গে দেখা করার জন্য মিরপুরে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডে গিয়েছিলাম। জিম্বাবুয়ে দল বাংলাদেশে খেলতে এসেছে। মাঠে ক্রিকেট অনুশীলন করছিল বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়রা। তবে দলের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়দেরকে অনুশীলনে দেখলাম না। অনেকে বোর্ডের বিভিন্ন কর্মকর্তার কক্ষে আড্ডা দিচ্ছেন। একজন কর্মকর্তাকে প্রশ্ন করেছিলামÑ আজ বাদে কাল জিম্বাবুয়ের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রিকেট খেলা। অথচ খেলোয়াড়দের অনেকেই অনুশীলন করছেন না এর কারণ কি? ওই কর্মকর্তা মৃদু হেসে বলেছিলেন, দলটা যেহেতু জিম্বাবুয়ে তাই খেলোয়াড়দের অনেকেই গুরুত্ব দিচ্ছে না। 

উদ্বেগজনক খবর হলো ওই সময় জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট দল বাংলাদেশ ক্রিকেট দলকে খেলার মাঠে নাস্তানাবুদ করে ছেড়েছিল। বাংলাদেশ হেরেছিল জিম্বাবুয়ের কাছে। আমার ধারণা, অনেকেই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিতে চান না। অথবা ইতিহাস তাদের কাছে গুরুত্বহীন। তাই ইতিহাস তৈরি করার স্বপ্নও হয়তো জাগে না। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড আর্থিক সামর্থ্যে বেশ ধনী বলা যায়। ধনী বলেই কি বোর্ডের নির্দিষ্ট কোনো লক্ষ্য আমাদের চোখে পড়ে না? ক্রিকেট বোর্ডের আদৌ কি কোনো সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য আছে? বাংলাদেশের ক্রিকেটে পঞ্চ পাণ্ডব বলা হয় পাঁচ ক্রিকেটারকে। মাশরাফি, সাকিব, তামিম, মুশফিকুর রহীম ও মাহমুদুল্লাহ এই পাঁচজনকে বলা হয় পঞ্চ পাণ্ডব। তারা যখন সক্রিয় ছিলেন তখনই ক্রিকেট বোর্ডের ভাবনায় গুরুত্ব পাওয়ার কথা ছিল একদিন পঞ্চ পাণ্ডবরা থাকবেন না। তখন ক্রিকেটের কি হবে? মাশরাফি বলতে গেলে হঠাৎ করেই বিদায় নিলেন ক্রিকেট থেকে। সাকিব আল হাসান দলে আছেন। টেস্টের দায়িত্ব তার কাঁধে পড়েছে। 

টেস্ট অধিনায়ক মমিনুল হকের ব্যর্থতায় ক্রিকেট বোর্ড সাকিব আল হাসানকে টেস্ট অধিনায়ক বানিয়েছেন। টি-২০ তে বাংলাদেশের ক্রিকেটের অব্যাহত অবদমনের প্রেক্ষিতে মাহমুদুল্লাহ বলতে গেলে চাপের মুখে সরে যান দল থেকে। নূরুল হাসানকে সেনাপতি করে টি-২০’র অপেক্ষাকৃত একটি দুর্বল, অনভিজ্ঞ টিমকে পাঠিয়ে দেয়া হয় জিম্বাবুয়েতে। তরুণদের নিয়ে গড়া এই দলটির ব্যাপারে ক্রিকেট বোর্ডের একজন কর্মকর্তার মন্তব্য ছিল, জিম্বাবুয়েতে যদি ওরা হারেও তবুও আমার মন খারাপ হবে না। আমি চাই তরুণেরা সাহসী হোক। 

এই যে সাহসের কথা বলা হলো এটাই হলো আসল। পঞ্চ পাণ্ডব দলে থাকার সময় একটা সাহস ছিল। মাশরাফি রাজনীতিতে ব্যস্ত। সাকিব আল হাসান দলের গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। কিন্তু বর্তমান সময়ে তিনি বোধকরি খেলার চেয়ে ব্যবসার দিকেই বেশি মনোযোগী হয়েছেন। একটি প্রতিষ্ঠানের শুভেচ্ছা দূত হয়ে তিনি নতুন করে বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। ক্রিকেট বোর্ডের সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন প্রচার মাধ্যমে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেছেন, বিতর্কিত কোনো প্রতিষ্ঠান অথবা সংগঠনের শুভেচ্ছা দূত হওয়ার ক্ষেত্রে আমাদের ক্রিকেটারদের আরও সতর্ক হওয়া দরকার। আমি বিষয়টি নিয়ে সাকিবের সঙ্গে কথা বলবো। তার এই বক্তব্য শুনে দেশের চলচ্চিত্রের দুর্দশার চিত্র চোখের সামনে ভেসে উঠলো। 

দেশের গুরুত্বপূর্ণ সেক্টরগুলোতে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কে কার সঙ্গে কথা বলবে এই নিয়ে একটা অস্থিরতা আছে। একটা সময় সিনেমার নায়ক-নায়িকারা পরিচালকের সঙ্গে যোগাযোগ করে শুটিং তারিখ ঠিক করতেন। অথবা তাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি এক্ষেত্রে পরিচালকের সঙ্গে লিয়াজোঁ করতো। আর এখন পরিচালক নিজেই জনপ্রিয় তারকাদের শিডিউল নেয়ার জন্য শিল্পীর বাসায় গিয়ে ধরনা দেন। অভিজ্ঞ মহলের মতে, যেদিন থেকে পরিচালকরা নায়ক-নায়িকার বাসায় গিয়ে শুটিং ডেট পাওয়ার জন্য ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করতে শুরু করলেন সেদিন থেকেই মূলত আমাদের সিনেমার ধস নামতে শুরু করে। ক্রিকেটের ক্ষেত্রেও অনেকটা একই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বোর্ডের সঙ্গে কথা বলেই খেলোয়াড়রা তাদের ছুটি মঞ্জুর করে  নেবেন। এটাই তো নিয়ম। অথচ ক্রিকেটারদের কেউ কেউ বোর্ডের সঙ্গে কথা না বলেই নিজেদের ছুটি নিজেরাই ঘোষণা করেন। আমি অমুক সিরিজে খেলছি না। কিন্তু ‘আমি’ না খেললে ওই সিরিজে দলের অবস্থাটা কেমন হবে? দলের পারফরমেন্স কেমন হবে? এই ভাবনাটা বোধকরি একেবারেই গুরুত্ব পাচ্ছে না। সে কারণেই জিম্বাবুয়েতে টি-২০’র জন্য তরুণদের পাঠানো হলো। এই যে সেখানে দলের ভরাডুবি হলো তার দায়-দায়িত্ব কে নিবে? শুধুই কী খেলোয়াড়? নাকি বোর্ডেরও দায়-দায়িত্ব আছে? 

ক্রিকেট, একমাত্র ক্রিকেটই বাংলাদেশের একমাত্র খেলা যার জন্য দলমত নির্বিশেষে দেশের মানুষ এক কাতারে দাঁড়ায়। দলের সাফল্যের জন্য সমবেত প্রার্থনা করে। ক্রিকেট হাসলে আসলে গোটা বাংলাদেশ হাসে। সেজন্যই এত কথা বললাম। আমি ক্রিকেট বিশেষজ্ঞ নই। ক্রিকেট ভালোবাসি। প্রতিটি খেলায় প্রতিদিন বাংলাদেশ জিতুকÑএমনটাও আশা করি না। তবে অব্যাহত পরাজয় মেনে নিতে পারি না। তখন মনে হয় আমাদের ক্রিকেট বোধকরি সঠিক পথে হাঁটছে না। তবুও ক্রিকেটের জয় হোক।

 

 

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status