প্রথম পাতা
চলতি বছরও ১২৬৪ কোটি টাকা লাভ করেছে বিপিসি
অর্থনৈতিক রিপোর্টার
১১ আগস্ট ২০২২, বৃহস্পতিবারসেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেছেন, চলতি বছরে তেল বিক্রি করে ১ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা লাভ করলেও ৮ হাজার ১৫ কোটি টাকা লোকসানের কথা বলছে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন (বিপিসি)। এ ছাড়া ২০১৫ সাল থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ৪৬ হাজার ৮৫৮ কোটি টাকা লাভ করেছে বিপিসি। বলেন, জ্বালানি খাতের সংস্থাগুলোর দুর্নীতি-অপচয় বন্ধ করতে না পেরে জ্বালানি তেলের উচ্চ মূল্যবৃদ্ধি জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। জ্বালানি তেলের কর প্রত্যাহার বা কমিয়ে মূল্যবৃদ্ধি এড়ানো যেতো। করোনা মহামারির প্রভাবে অনেক মানুষ এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি। সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে অনেকে। তাদের উপর উল্টো চাপ তৈরি করা হচ্ছে। গতকাল ধানমণ্ডিতে সিপিডি’র কার্যালয়ে আয়োজিত ‘জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি এখন এড়ানো যেতো কি?’ শীর্ষক সংলাপে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে তিনি এসব কথা বলেন। অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে এ তথ্য পেয়েছেন বলে জানিয়েছেন ড. ফাহমিদা।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ড. ইজাজ হোসেন, বিকেএমইএ সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান, সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক, যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী ও সিপিডি’র গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। সিপিডি বলেছে, ভর্তুকি সম্পদের অপচয় করে।
আমরা কার সঙ্গে কি তুলনা করছি? আমরা বলছি হংকং এ নাকি জ্বালানি তেলের দাম আরও বেশি। এটা ঠিক আছে। কিন্তু হংকং এ মাথাপিছু আয় ৪৯ হাজার ৬৬০ ডলার। আমাদের ২ হাজার ৫০৩ ডলার। সুতরাং কোনো দেশের সঙ্গে তুলনা করতে হলে মাথাপিছু আয়ও দেখতে হবে। জ্বালানি তেলের মূল্য মূল্যস্ফীতিকে উসকে দেবে। যাতায়াত ব্যবস্থার খরচ বেড়ে যাবে। বাস ভাড়া, ট্রাক ও লঞ্চ ভাড়া বেড়ে যাবে। এরইমধ্যে ভাড়া বেড়ে গেছে। তিনি বলেন, ডিজেলের দাম বৃদ্ধির ফলে কৃষি খাতের উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। অনেক কৃষক ডিজেলচালিত পাম্প ব্যবহার করেন। কৃষি উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। কৃষি উৎপাদন কমে যাবে। বুয়েটের সাবেক অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, ভর্তুকি প্রত্যাহার সমর্থন করি কিন্তু যেভাবে করা হয়েছে, এটাকে সমর্থন করি না। দেশের অর্থনীতির সবচেয়ে খারাপ সময়ে সরকার জ্বালানি তেলের কর তুলে দিতেই পারে। বরং দাম বাড়িয়ে সাধারণ মানুষের ওপর পরোক্ষ কর চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। এটা ভয়ঙ্কর বৈষম্যমূলক। ধনীর কিছু হবে না, গরিব মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। আমরা অর্থনৈতিকভাবে সবচেয়ে খারাপ সময়ে আছি। এই সময়ে সরকার কীভাবে কোনো কিছু না বিবেচনা করে জ্বালানি তেলের দাম এত বাড়ালো সেটা আমার বুঝে আসে না। আমরা যখন অর্থনৈতিক বিভিন্ন সমস্যায় জর্জরিত তখন এই দাম বাড়ানো হলো কেন? সাবেক কৃষি সচিব আনোয়ার ফারুক বলেন, একবারে এত বেশি দাম বাড়ানোর মতো পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ এখনো আসেনি।
ধান চাষে প্রতি বিঘা জমিতে ১ হাজার টাকা খরচ বাড়বে কৃষকের। এ খাতে ১৫ লাখ কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহার হয়, যার ৭৫ শতাংশ ডিজেলচালিত। এখানে অন্তত আগের দামে জ্বালানি তেল সরবরাহ করতে হবে। কৃষিতে ভর্তুকি তুলে দেয়ার কোনো সুযোগ নেই। ধানের উৎপাদন ব্যাহত হলে দেশ বড় বিপর্যয়ের মধ্যে পড়বে। এ সময়ে মূল্যবৃদ্ধি এড়ানো গেলে রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য সহায়ক হতো বলে মনে করছেন বিকেএমইএ সহ-সভাপতি ফজলে শামীম এহসান। তিনি বলেন, গ্যাস সরবরাহ না থাকায় ডিজেলের ব্যবহার বেড়েছে কারখানায়। নতুন দামে কিনে কারখানা চালানো সম্ভব নয়। দুই মাস আগেই দাম কমিয়েছে ক্রেতারা। এদিকে উৎপাদন খরচ বাড়ছে। মূল্যস্ফীতির কারণে সামনে শ্রমিকদের বেতন বাড়ানো লাগতে পারে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি অবশ্যই এড়ানো যেতো বলে দাবি করেন সিপিডি’র গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, ভর্তুকি ব্যবস্থাপনার মানে ভোক্তার ওপর দায় চাপানো নয়, অপচয় কমানো। বিপিসি’র পুরাতন হিসাবের খতিয়ান জনগণের সামনে প্রকাশের দাবিও জানান গোলাম মোয়াজ্জেম। কিন্তু হিসাব খুঁজে পাওয়া যায় না। অর্থ মন্ত্রণালয়ের তথ্য তুলে ধরে খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, ২০১৫ সালে ৪ হাজার ১২৬ কোটি, ২০১৬ সালে ৯ হাজার ৪০, ২০১৭ সালে ৮ হাজার ৬৫৩, ২০১৮ সালে ৫ হাজার ৬৪৪ কোটি টাকা লাভ করেছে বিপিসি। এ ছাড়া ২০১৯ সালে ৪ হাজার ৭৬৮, ২০২০ সালে ৫ হাজার ৬৭ এবং ২০২১ সালে বিপিসি জ্বালানি তেল বিক্রি করে ৯ হাজার ৫৫৯ কোটি টাকা লাভ করেছ। বিপিসি সব সময় জ্বালানি তেল বিক্রি করে লাভ করেছে তাহলে এখন কেন ভর্তুকি তুলে নেয়া হলো? তিনি বলেন, ১০ হাজার কোটি টাকা সরকার নিয়েছে।
বাকি ৩৬ হাজার কোটি টাকা কোথায় গেল? তিনি বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়সহ সরকারের বিভিন্ন সূত্রে যে খতিয়ান দেখতে পাই, তাতে নিজস্ব অর্থায়নে ১১টি প্রকল্পের তথ্য পেয়েছি। সেখানে ব্যয় হবে ৮ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। এরমধ্যে মাত্র ৫টি প্রকল্প চলমান। বাকিগুলো বন্ধ। তাহলে বিপিসি’র টাকা কোথায়? আমরা জানতে পেরেছি বিভিন্ন ব্যাংকে বিপিসি’র ২৫ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা জমা রয়েছে। বাকি টাকা কোথায়? গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, বিপিসি যদি হিসাবে স্বচ্ছতা রাখতো, তাহলে বাড়তি ব্যয়ের হিসাব সমন্বয় করা যেতো। বিপিসি কীভাবে অর্থের হিসাব রাখছে, আমাদের জানা দরকার। তিনি মনে করেন মূল্যবৃদ্ধি না করে, অব্যবহৃত অর্থ দিয়ে সাবসিডি অ্যাডজাস্ট করা যায়। আইএমএফ’র পরামর্শ বাস্তবায়নে ভর্তুকি ব্যবস্থাপনায় ওই কৌশল নেয়া যেতো। আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি, এ বছরেও বিপিসি বিনিয়োগ করবে! জনগণের মাথায় বোঝা চাপিয়ে বিপিসি কোথায় বিনিয়োগ করবে? বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় কিছু সুপারিশ করেছে সিপিডি। এগুলো হলো- মূল্যবৃদ্ধি পুনর্বিবেচনা করে এটি কমিয়ে আনা। খোলাবাজারে কম দামে সরকারের পণ্য বিক্রি বাড়ানো। রেশন কার্ডের সংখ্যা আগের চেয়ে বাড়ানো।
শুধু দরিদ্র নয়, নিম্নআয়ের মানুষদেরও দিতে হবে। আর এটা যার প্রয়োজন, তাকে দেয়ার বিষয়টিও নিশ্চিত করা। মধ্যমেয়াদি ব্যবস্থা হিসেবে প্রাথমিক জ্বালানি নিশ্চিত করতে দেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে জোর দেয়ার পরামর্শ দিয়েছে সিপিডি। প্রায় ৩৫০ যাত্রী ও ১২টি দূরপাল্লার বাস কাউন্টারে গিয়ে কথা বলেছে যাত্রী কল্যাণ সমিতি। সংগঠনটির সভাপতি মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, দিনে শহরে যাতায়াত খরচ বেড়েছে গড়ে ৭০ থেকে ২০০ টাকা। আর দূরপাল্লার বাসে খরচ বেড়েছে ১০০ থেকে ৩০০ টাকা। শহরে প্রতি কিলোমিটারে আড়াই টাকা নির্ধারণ করা হলেও তিন থেকে ৭ টাকা পর্যন্ত নিচ্ছে বিভিন্ন পরিবহন। ফলে রাজধানীতে মধ্যবিত্ত চাকরিজীবীদের অফিস যাতায়াতে ভাড়া ২ হাজার ১০০ থেকে ৬ হাজার টাকা পর্যন্ত বেড়েছে।