ঢাকা, ২১ এপ্রিল ২০২৫, সোমবার, ৮ বৈশাখ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ২১ শাওয়াল ১৪৪৬ হিঃ

শেষের পাতা

তামান্নার বেপরোয়া জীবন

জালাল রুমি, চট্টগ্রাম থেকে
১৮ মার্চ ২০২৫, মঙ্গলবার
mzamin

চট্টগ্রাম নগরের শীর্ষ সন্ত্রাসী মো. সাজ্জাদ ওরফে ছোট সাজ্জাদকে গ্রেপ্তারের পরপরই ফেসবুক লাইভ করে আলোচনায় আসেন স্ত্রী তামান্না শারমিন। দেখান ‘টাকার গরম’। পাশাপাশি দেন হুমকিও। যারা তার স্বামীকে গ্রেপ্তার করেছে এবং করতে সহযোগিতা করেছে তাদের দেখে নিবেন বলেও জানিয়েছেন এই লাইভে। বেশ ফুরফুরে মেজাজে ও নানা অঙ্গভঙ্গিতে লাইভে তিনি সমালোচনাকারীদের জন্য ‘এক বালতি সমবেদনা’ জানিয়েছেন। আর স্বামীর ‘সাপোর্টারদের’ জন্য চেয়েছেন দোয়া। বলেছেন, ‘খেলা যারা শুরু করেছে এখন তাদের পালানোর দিন। খেলাটা তারা শেষ করবেন। আর টাকার বান্ডিল ছিটিয়ে ১৪ দিনে স্বামীকে তিনি জামিন করিয়ে নিয়ে আসবেন।’ তার সেই লাইভ দেশ জুড়ে ভাইরাল হয় মুহূর্তেই। গণমাধ্যমেও তামান্না শারমিনকে সাজ্জাদের স্ত্রী হিসেবে ব্যাপক প্রচার করা হয়। তবে মানবজমিনকে একটি বিশেষ সূত্র জানিয়েছেন, তামান্না শারমিন সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদের স্ত্রী পরিচয় দিলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি সাজ্জাদের স্ত্রী নন। তার সঙ্গে ইসলামী শরিয়াহ মোতাবেক বিয়ে হওয়ার কোনো নথি নেই তাদের কাছে। তবে আরেকটি সূত্র বলছে, তাদের বিয়ে হয়েছে ঠিকই। তবে দেশের আইনকানুন মেনে হয়নি। এ জন্য তাদের কাছে বৈবাহিক জীবনের কোনো ডকুমেন্টস নেই। 

কে এই তামান্না শারমিন? 
তামান্না শারমিনের পুরো নাম তামান্না আহমেদ। তিনি  চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের উপ-অর্থ সম্পাদক হেলাল আকবর চৌধুরী বাবরের ডানহাত হিসেবে পরিচিত অমিত মুহুরীর বান্ধবী  ছিলেন। ২০১৯ সালের ৩০শে মে অমিত মুহুরী চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে আরেক আসামির ইটের আঘাতে নিহত হন। কুমিল্লার একটি মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে থাকার পর জোড়া খুন মামলার আসামি অমিত ২০১৭ সাল থেকে কারাগারে ছিলেন। জানা গেছে, অমিতের সঙ্গে তামান্নার দীর্ঘ দিনের প্রেমের সম্পর্ক ছিল। তামান্না শারমিন এমইএস কলেজে পড়াকালীন নিজেও ছাত্রলীগের রাজনীতিতে যুক্ত ছিলেন। ওই সময় থেকেই অমিত মুহুরীর সঙ্গে প্রেমের সম্পর্কে জড়ান তামান্না। 

তামান্না শারমিনের বিরুদ্ধে আছে বিস্তর অভিযোগ। একেকবার একেক যুবককে কথিত বিয়ে করার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। বিয়ের পর ওই যুবকদের কাছ থেকে টাকা পয়সা হাতিয়ে সটকে পড়তেন তামান্না। সাজ্জাদও তার তেমনই এক স্বামী। বর্তমানেও তামান্নার আগের ঘরের এক সন্তান রয়েছে। তাকে অনেকে ‘লেডি ডন’ হিসেবে চিনে। বোয়ালখালীর মেয়ে তামান্না ছেলেদের মোটরসাইকেল চালানো ও কথাবার্তায় কঠোরতার জন্য লেডি ডন পরিচিতি পান। 

বেপরোয়া ও বিলাসী জীবনযাপন করেন তামান্না ও সাজ্জাদ: তামান্না শারমিন ও সাজ্জাদ দু’জনই বেপরোয়া জীবনযাপন করেন। চালান একাধিক ফেসবুক পেইজ, আইডি, টিকটক অ্যাকাউন্ট। নিয়মিত টিকটক করে আলোচনায় থাকেন তামান্না শারমিন। এ ছাড়াও সাজ্জাদও তার আইডি ও ‘অল ইটস হোপ’ নামে একটি ফেসবুক পেইজে পোস্ট করেন হরহামেশা। মূলত সাজ্জাদ বিএনপি ও ছাত্রদলকেন্দ্রিক পোস্ট এবং নিউজ শেয়ার করে বিএনপি’র প্রতি নিজের ভালোবাসার কথা জানান দেয়ার চেষ্টা করেন। শরীরে ট্যাটু লাগানো, রকেট, স্টাইলিশ প্যান্ট ও জুতাই বলে দেয় সাজ্জাদ বিলাসী জীবনে অভ্যস্ত। একই হাল তার স্ত্রী পরিচয় দেয়া তামান্নারও। চুলে রঙ করে নিয়মিত টিকটকে হাজির হন সাবেক ছাত্রলীগ নেত্রী। সমপ্রতি পুলিশের কাজকেও সহজ করে দেয় তামান্না। তামান্নার একটি ভিডিও টিকটকসহ সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়ার পর পুলিশের হাতে আসে গুরুত্বপূর্ণ সূত্র। সেই সূত্র ধরেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

দুজনই ধূর্ত প্রকৃতির: সাজ্জাদের অপরাধ প্রবণতা যেন মিলে গেছে তামান্না শারমিনের সঙ্গে। তার চেয়ে কম যায় না শারমিনও। গত ২৮শে জানুয়ারি রাত ১০টা ৩৯ মিনিটে ফেসবুক লাইভে এসে চট্টগ্রামের বায়েজিদ বোস্তামি থানা পুলিশের ওসিকে প্রকাশ্যে তুলে নিয়ে উলঙ্গ অবস্থায় পেটানোর হুমকি দেন সাজ্জাদ। একইভাবে সাজ্জাদকে ঢাকা থেকে গ্রেপ্তারের পর গ্রেপ্তারকারীদেরও দেখে নেয়ার হুমকি দেন শারমিন। বলেন, ‘এতদিন আমরা পালিয়ে ছিলাম, এবার তোমাদের পালানোর দিন শুরু। কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা ঢেলে জামাইকে আমার কাছে নিয়ে আসবো ১৪ দিনের মধ্যে।’

তামান্নার পোস্ট করা ভিডিও থেকেই তাদের অবস্থান নিশ্চিত করে পুলিশ। ভিডিওতে থাকা একটি গাড়ি শনাক্ত করে বিআরটিএ থেকে মালিকের তথ্য সংগ্রহ করে পুলিশ। এরপর চালককে জিজ্ঞাসাবাদ করে জানা যায়, সাজ্জাদ ও তার স্ত্রী অক্সিজেন মোড় থেকে রাউজান গিয়েছিলেন। সিসিটিভি ফুটেজ বিশ্লেষণ করে তার অবস্থান নিশ্চিত করা হয়। গত ১২ই ডিসেম্বর সাজ্জাদকে ধরতে গিয়ে তামান্না শারমিনকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে আসে পুলিশ। পরে ৬ই জানুয়ারি তিনি জামিনে বের হন। এরপর বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি আরিফুর রহমান, আরও দুই এসআই ও অন্যান্য কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা করেন তামান্না শারমিন। সেই মামলায় তিনি ওসির বিরুদ্ধে নিজের ভ্রূণ হত্যার অভিযোগ করেন। এ নিয়ে ফেসবুকে লাইভেও আসেন তিনি। যদিও ভ্রূণ হত্যার কোনো প্রমাণ তিনি উপস্থাপন করতে পারেননি। 

এদিকে শীর্ষ সন্ত্রাসী ছোট সাজ্জাদ কোন দলের রাজনীতি করেন তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। অনেকেই বলেন, তিনি শিবিরের কর্মী। তবে তার ফেসবুকে এ সম্পর্কিত কোনো প্রমাণ মেলেনি। তিনি শুরু থেকে ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। বিএনপি’র কেন্দ্রীয় সহ সাংগঠনিক সম্পাদক মীর হেলালের সঙ্গে তার একাধিক ছবি রয়েছে। বিএনপি’র এই তরুণ নেতার উদ্যোগে আয়োজিত সবক’টি প্রোগ্রামে সাজ্জাদ অংশ নিতেন। তারেক জিয়ার ছবি হাতে নিয়ে সমাবেশে গিয়ে ছবি পোস্ট করেন তিনি। নিয়মিতই ছাত্রদল ও বিএনপি’র সব ছবি, ভিডিও পোস্ট করে প্রচার চালান। তবে  সে আরেক সন্ত্রাসী সাজ্জাদ খানের  (শিবির সাজ্জাদ) ঘনিষ্ঠ অনুসারী বলে পরিচিত। আলোচিত ‘এইট মার্ডার’র আসামি সাজ্জাদ খান ভারতে পলাতক আছেন।

সাজ্জাদের বিরুদ্ধে ১৫টি মামলা রয়েছে: নগরীর পাঁচলাইশ, খুলশী, বায়েজিদ থানা এবং জেলার হাটহাজারী, ফটিকছড়ি ও আশপাশের থানা এলাকাগুলোতে ব্যাপক ত্রাস সৃষ্টি করতো এই ছোট সাজ্জাদ। কোথাও নতুন ভবন উঠলে হাজির হতো চাঁদার দাবি নিয়ে। এ ছাড়াও কর্ণফুলীর কয়েকটি বালুমহালসহ অন্তত দশটি পয়েন্ট থেকে বিদেশে পলাতক সাজ্জাদকে ভিডিও কলে দেখিয়ে মাসিক হারে চাঁদা আদায় করতো ছোট সাজ্জাদ। চাঁদা আদায়কে কেন্দ্র করে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী সরোয়ারের সঙ্গে তার বিরোধ চলছে। প্রায় সময় তাদের বিরুদ্ধে বিরোধকে ঘিরে ওইসব এলাকায় চলতো গোলাগুলি।  

গেল বছরের ২৯শে আগস্ট নগরের অক্সিজেন-কুয়াইশ সড়ক এলাকায় আনিস ও মাসুদ কায়সার নামে আওয়ামী লীগের দুজনকে গুলি করে হত্যা করে সাজ্জাদের ক্যাডাররা। ২১শে অক্টোবর চান্দগাঁওয়ে তাহসীন নামে এক যুবককে গুলি করে হত্যা করে তার বাহিনী। গত বছরের ৫ই ডিসেম্বর গ্রেপ্তার এড়াতে পাঁচতলা ভবন থেকে লাফিয়ে পালিয়ে যায় সাজ্জাদ। ওইদিন পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলিও ছুড়েন সাজ্জাদ। এতে ২ পুলিশ ও ১ সোর্স আহত হন। এ ছাড়াও গত বছরের ১৪ই ডিসেম্বর তৃতীয় লিঙ্গের শিলা ও আরেক নারীকে নিয়ে ফেসবুকে আপত্তিকর পোস্ট করেন সাজ্জাদ। ওই পোস্টে তিনি লিখেন, ‘আমার চোখের সামনে পড়িস না, পড়লে তোদের বাবারা তোদের আর বাঁচাতে পারবে না।’ পোস্টে ওই দুজনের ছবিতে লাল ক্রস চিহ্ন দেন। সেই পোস্টের এক মাস ১৯ দিন পর গত সোমবার সন্ধ্যায় রাঙ্গামাটির বেতবুনিয়ার একটি বাসা থেকে পুলিশ শিলার লাশ উদ্ধার করে। এদিকে বায়েজিদ বোস্তামী থানার ওসি আরিফুর রহমানকে হুমকি দিয়ে ফেসবুকে নিয়মিত পোস্ট করতেন সাজ্জাদ।

অভিযোগের বিষয়ে জানতে ছোট সাজ্জাদের স্ত্রী তামান্না শারমিনকে ফোন দেয়া হলে তার নাম্বারটি বন্ধ পাওয়া যায়। পরে তাকে ক্ষুদেবার্তা দিলেও তিনি উত্তর দেননি।
 

পাঠকের মতামত

এখনো ওই মহিলা বাহিরে আছে কি করে ভেবে পাচ্ছি না । আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে এ আচড়ন তাহলে সাধারণ মানুষের সাথে এরা কি করে ভেবেই অস্থির হয়ে উঠছি । তাই দ্রুত গ্রেফতার করে এমন অবস্থা করে দেওয়া হোক যেন সারা জীবন সোজা হয়ে দাড়াতে না পারে ।

বাবন
১৯ মার্চ ২০২৫, বুধবার, ১০:৩৩ পূর্বাহ্ন

শাস্তি পাওয়ার জন্য কি আরো অপরাধের প্রয়োজন?

polash
১৯ মার্চ ২০২৫, বুধবার, ১০:৩০ পূর্বাহ্ন

জামিনের ব্যাপারে কঠোরতা অবশ্যই কাম্য। এসব নষ্ট ছেলেমেয়েদের স্হায়ী ঠিকানা হওয়া উচিত "জেল" এবং সমাজ ও দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিকারী এসব দূরাচারের দমন জরুরী।

Mohammad Yousuf
১৯ মার্চ ২০২৫, বুধবার, ২:৫৬ পূর্বাহ্ন

এসব পতিতারা জামিন পায় । জামিন হয়না সাংবাদিক কিম্বা কবি লেখকদের । বেজন্মা নির্লজ্জ চাটুকার বিচার বিভাগ সোজা করা ছাড়া দেশ রক্ষা অসম্ভব ।

M Eliash Malik
১৮ মার্চ ২০২৫, মঙ্গলবার, ২:১৫ অপরাহ্ন

শাস্তি পাওয়ার জন্য কি আরো অপরাধের প্রয়োজন?

আবুবকর
১৮ মার্চ ২০২৫, মঙ্গলবার, ২:০০ অপরাহ্ন

পতিতাদের কোন পরিচয় থাকে না

Muhammad Abdus Samad
১৮ মার্চ ২০২৫, মঙ্গলবার, ১:০১ অপরাহ্ন

অভিযোগ গঠনের জন্য যথেষ্ট নয় কী? আইনকে এগিয়ে আসার আহবান জানাই

জনতার আদালত
১৮ মার্চ ২০২৫, মঙ্গলবার, ৮:০৯ পূর্বাহ্ন

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2025
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status