শেষের পাতা
সিলেটে বড় ধাক্কা
ওয়েছ খছরু, সিলেট থেকে
৭ আগস্ট ২০২২, রবিবারকরোনার পর দু’দফা বন্যা। এখনো মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেনি সিলেটের মানুষ। তছনছ হয়ে গেছে কৃষিখাত। আমদানিনির্ভর নিত্যপণ্যই এখন সিলেটের মানুষের ভরসা। শিল্প-কারখানা নেই। এরপরও পাথর ও বালুকেন্দ্রিক ব্যবসার কারণে অর্থনীতি কিছুটা চাঙ্গা। ভারত থেকে আমদানি করা
পাথর যায় গোটা দেশে। প্রতিদিন কয়েক হাজার কোটি টাকার বাণিজ্য হয় এই খাতে। কিন্তু হঠাৎ করে ছন্দপতন। জ্বালানি তেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় পাথর পরিবহনে বড় ধাক্কা এসেছে।
যেসব ট্রাক আসছে তারা ভাড়াও নিচ্ছে প্রায় দ্বিগুণ। এর প্রভাব পড়েছে বাজারেও। জ্বালানি তেলের কারণে দাম বেড়ে যাচ্ছে বিভিন্ন পণ্যের। সিলেট জেলা ট্রাক মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক শাব্বির আহমদ ফয়েজ গতকাল বিকালে মানবজমিনকে জানিয়েছেন, ‘সিলেটের পাথর, বালু কিংবা পণ্য আসা-যাওয়া করে ডিজেলচালিত ট্রাকে। জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির পর শুক্রবার রাত থেকে সিলেট অঞ্চলে অঘোষিত ধর্মঘট চলছে। রাস্তায় ট্রাকের সংখ্যা খুবই কম। ভাড়া পুনঃনির্ধারণ না করা পর্যন্ত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে না। এ কারণে মালিক ও শ্রমিকরা ব্যক্তিগতভাবে ট্রাক চলাচল বন্ধ রাখছেন।’ তিনি জানান, ‘সিলেটে দূরপাল্লার ট্রাক আসছে না। একে তো জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি, তার সঙ্গে সংকটও রয়েছে। পেট্রোল পাম্পগুলোতে চাহিদা মতো তেল পাওয়া যাচ্ছে না। ফলে যারা বাইরে থেকে ট্রাক নিয়ে আসছেন তারাও দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।’
সিলেট বিভাগীয় পেট্রোল পাম্প ওনার্স এসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা কামাল জানিয়েছেন, ‘সিলেটে জ্বালানি তেলের সংকট তেমন নেই। আমরা শুক্রবার রাত থেকে সরকার নির্ধারিত দামে তেল বিক্রি করছি। এক সঙ্গে বেশি সংখ্যক গ্রাহক হওয়ার কারণে নানা স্থানে বিশৃঙ্খলা হয়েছে। গাড়ির মালিক ও শ্রমিকরা তেল সংকটের আশঙ্কায় রাতে হুড়োহুড়ি করেন। এ কারণে দু’একটিতে তেল সংকট থাকলেও বেশির ভাগ পাম্পে তেল রয়েছে। শনিবার সকাল থেকে পরিস্থিতি স্বাভাবিক ছিল বলে দাবি করেন তিনি।’ জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি হওয়ার কারণে পরিবহন সেক্টরে বড় ধাক্কা লেগেছে। গতকাল কম সংখ্যক বাস চলাচল করেছে। এতে করে সিলেট কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল এলাকায় যাত্রী দুর্ভোগ ছিল চরমে। যারা গন্তব্যে গাড়ি পাচ্ছেন তাদের গুনতে হয়েছে অতিরিক্ত ভাড়া। মূল্যবৃদ্ধির বিষয়টি নিয়ে বিরক্ত সিলেট জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ময়নুল ইসলাম।
তিনি মানবজমিনকে জানিয়েছেন, জ্বালানি তেলের উপর নির্ভর করেই চলে দেশের পরিবহন খাত। তেলের দাম বাড়াবে সরকার, ভালো কথা। কিন্তু তার আগে আলোচনার প্রয়োজন ছিল। কারণÑ বেশি দামে তেল কিনলে ভাড়াও বাড়বে। ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়টিকে গুরুত্ব না দিয়ে হঠাৎ করে দাম বাড়িয়ে দেয়া হয়েছে। এতে চালকরা বিব্রতকর অবস্থায় পড়ছেন।’ তিনি জানান, ‘আমরা জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখছি। এ নিয়ে কেন্দ্রীয়ভাবে আলোচনা হচ্ছে। সবাই বসে সিদ্ধান্ত নেবো কী করা যায়। ভাড়া বৃদ্ধি না করলে পরিবহন খাত টিকবে না বলে জানান তিনি।’ এদিকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায়কে কেন্দ্র করে গতকাল সিলেটের বিভিন্ন এলাকায় চালক-যাত্রীর বচসার ঘটনা ঘটেছে। অতিরিক্ত ভাড়া চাইলে যাত্রীরা তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। এতে করে সড়ক পথে পরিবহনে বিশৃঙ্খলা ছিল চরমে। তবে পরিবহন শ্রমিকরা জানিয়েছেন, ‘আমরা যাত্রীদের কাছ থেকে জোরপূর্বক ভাড়া আদায় করছি না। বাধ্য হয়ে অনেকে করছেন।
এ জন্য বসে সিদ্ধান্ত নেয়ার প্রক্রিয়া চলছে বলে জানান তারা।’ সিলেট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সিনিয়র সহ-সভাপতি ফালাহ উদ্দিন আলী আহমদ জানিয়েছেন, সিলেটের পাথর ও কয়লা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যায়। তেলের দাম বৃদ্ধির কারণে ট্রাকচালকরা নতুন ভাড়া নির্ধারণ না হওয়া পর্যন্ত পাথর ও কয়লা পরিবহন করতে চাইছেন না। পাশাপাশি চট্টগ্রাম থেকে প্রতিদিন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য নিয়ে আগে যে ট্রাক ১৬-১৭ হাজার টাকায় সিলেটে আসতো, এখন সেই ট্রাক ২৭-২৮ হাজার টাকা দাবি করছে। এ জন্য আগে ভাড়ার সমন্বয় করে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল। সেটি না করায় এখন বাজারে চাপ পড়ছে। গতকাল থেকে সিলেটের বাজারে সবজি সহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম বেড়ে গেছে বলে জানান তিনি।
তেল সংকট: পাম্প মালিকরা সিলেটে পর্যাপ্ত তেল রয়েছে বলে দাবি করলেও পাম্পগুলোতে তেল সংকট রয়েছে। আর এই সংকট দেখা দেয় শুক্রবার রাত সাড়ে ১০টা থেকে। হঠাৎ করে জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির খবর পেয়ে গাড়ি নিয়ে পাম্পগুলোতে ভিড় জমান তারা। এ সময় তারা পূর্বের দামে তেল কেনার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়েন। একই সময়ে পাম্প মালিকরাও নেন ভিন্ন পন্থা। তারা তেলের সংকট দেখিয়ে বিক্রি বন্ধ করে দেন। এতে করে ক্ষুব্ধ হন গাড়ির মালিক ও চালকরা। এ নিয়ে রাতে নগরীর চৌকিদেখি এলাকায় সড়ক অবরোধ হয়। কোম্পানীগঞ্জের তেলিখাল এলাকার একটি পেট্রোল পাম্পে হাতাহাতির ঘটনা ঘটে। পাম্প শ্রমিক ও মালিকরা জানিয়েছেন, কেউ কেউ কলস, টিনের কৌটা নিয়ে এসে পূর্বের দামে পাম্প থেকে তেল কেনার চেষ্টা করেন। আবার এক সঙ্গে শত শত গাড়ি এসে পাম্পে ভিড় জমায়। এতে করে পরিস্থিতি সামাল দেয়া কষ্টকর ছিল। পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে পুলিশের সহযোগিতা চান পাম্প মালিকরা। পরিবহন শ্রমিকরা অভিযোগ করেছেন, রাত ১২টা থেকে নতুন দামে তেল বিক্রির কথা ছিল। কিন্তু পাম্প মালিকরা রাত সাড়ে ১০টায়ই জানিয়ে দেন তেল সংকট। এ কারণে যাত্রীরা ক্ষুব্ধ হন। তবে রাত ১২টার পর ওই পাম্প মালিকরা নতুন দামে তেল বিক্রি করেছেন। তখন আর তেলের সংকট ছিল না। ইচ্ছে করেই পাম্প মালিকরা অতিরিক্ত মুনাফার আশায় এ ঘটনা ঘটিয়েছেন বলে জানান তারা।