ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

অর্থ-বাণিজ্য

আস্থাহীনতায় গভীর সংকটে ই-কমার্স খাতের গ্রাহকরা

এমএম মাসুদ
৩ আগস্ট ২০২২, বুধবার
mzamin

স্বাভাবিক সময়ে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান বেশ ভালোভাবে চললেও করোনা মহামারি শুরুর পর মানুষ ঘরবন্দি থাকায় এই খাত বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। তবে দুর্নীতি, গ্রাহক হয়রানি ও অর্থ আত্মসাৎ আর প্রতারণায় সবকিছু ম্লান হয়ে যায়। কোটি কোটি টাকা হারিয়ে পথে বসেছেন হাজারো গ্রাহক। অনেকেই হন সর্বশান্ত। ফলে প্রতারণার দায়ে অভিযুক্ত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে সব গ্রাহক এখনো টাকা ফেরত পাননি। গ্রাহকের হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে গ্রেপ্তার ও পলাতক আছেন একাধিক ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের সিইও। এসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার তদন্তেও অগ্রগতি নেই। বিপুল অর্থ আত্মসাৎকারী প্রতারক প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক-কর্মকর্তারা লাপাত্তা। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও ভুক্তভোগী গ্রাহকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিতর্কিত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছে এখন যে পরিমাণ অর্থ আছে তা দিয়ে গ্রাহকদের পাওনা মেটানো সম্ভব নয়। ফলে গভীর হতাশা নেমে এসেছে প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহকদের মাঝে।

বিজ্ঞাপন
সব টাকা ফেরত পাবেন কিনা, তা নিয়ে বড় সন্দেহ রয়েছে। পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে থাকা টাকা গ্রাহকদের ফেরত দিতেও এখন অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে। দিন যত গড়াচ্ছে টাকা ফেরত পাওয়ার আশা তত দীর্ঘ হচ্ছে। সংশ্লিষ্টদের মতে, গ্রাহকের টাকা ফেরত না দিতে পারলে কখনোই আস্থা ফিরবে না ই-কমার্স খাতে। 

জানা গেছে, বিতর্কিত ই-কমার্স প্ল্যাটফরম ইভ্যালির বড় প্রতারণার কারণে দেশের ই-কমার্স খাতের দুর্নীতি নিয়ে টনক নড়ে দেশের মানুষের। এরপর একে একে অনিয়মের অভিযোগ উঠে আসে ই-অরেঞ্জ, কিউকম, আলেশা মার্ট, ধামাকাসহ প্রায় অর্ধশত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে। ফলে শেষ পর্যন্ত নড়েচড়ে বসে সরকারের নজরদারি প্রতিষ্ঠানগুলো। সংশ্লিষ্টদের মতে, লোভনীয় অফার দিয়ে কয়েক মাসের মধ্যে হাতিয়ে নেয় প্রায় চার হাজার কোটি টাকা। তবে ৫১৪ কোটির কিছু বেশি টাকা গেটওয়েতে থাকায় বাংলাদেশ ব্যাংক তা আটকে দিতে পেরেছে। অভিযোগ আছে, এর মধ্যে বড় একটা অংশ বিদেশে পাচার হয়েছে। তবে ই-কমার্স খাতের আকার বাড়ছে। বর্তমানে এই খাতের আকার বছরে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা।  বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও ডিজিটাল ই-কমার্স পরিচালন সংক্রান্ত জাতীয় কমিটির তথ্য অনুযায়ী, ২০২১ সালের ৩০শে জুনের পরে লেনদেন পরিশোধকারী প্রতিষ্ঠানে (পেমেন্ট গেটওয়ে) ২৭টি ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের কাছে গ্রাহকদের মোট অর্থ আটকে ছিল ৫২৫ কোটি টাকা। এরমধ্যে ১৩টি প্রতিষ্ঠান এ পর্যন্ত ১৮২ কোটি ৪১ লাখ টাকা গ্রাহকদের ফেরত দিয়েছে। নিজেদের টাকা ফেরত পাওয়া গ্রাহকের সংখ্যা ২০ হাজার ২৯৯। বাকি ৩৪৩ কোটি টাকা গ্রাহকেরা কবে ফেরত পাবেন তা বলতে পারছে না কেউ। তবে পুরো বিষয়টি প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে বলে গ্রাহকেরা আস্তে আস্তে টাকা ফেরত পাবেন বলে আশাবাদী বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। কেস স্টাডি-১: ৩৫ ভাগ ছাড়ের সুযোগ নিতে ধার করে ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান আলেশা মার্টে ৪ লাখ ৯০ হাজার টাকায় দুটি মোটরসাইকেলের অর্ডার দিয়েছিলেন অনার্স ২য় বর্ষের শিক্ষার্থী আবদুল্লাহ জুবায়ের। 

গত বছরের জুন মাসে টাকা দেন তিনি। ৪৫ দিনের মধ্যে মোটরসাইকেল পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। এক বছর পার হলো টাকাও ফেরত পাননি। তিক্ত অভিজ্ঞতার কথা জানিয়ে তিনি বলেন, মোটরসাইকেল না দিয়ে তিন মাস পর আলেশা মার্ট আমাকে ব্যাংকের চেক দিয়েছিল। এক বছরের বেশি সময় ধরে সেই চেক দিয়ে আমি টাকা তুলতে পারিনি। বেশ কয়েকবার চেষ্টা করেছি। কিন্তু প্রতিষ্ঠানের ব্যাংক হিসাবে টাকা না থাকায় টাকা তুলতে পারিনি। আবদুল্লাহ জুবায়ের বলেন, পরিবারের কাছ থেকে টাকা নিয়েছি। মোটরসাইকেলও পাইনি, টাকাও ফেরত পাইনি। পরিবারের সদস্যরা নানা নেতিবাচক কথা বলে। মুখ বুজে সব সহ্য করতে হয়।  শুধু আবদুল্লাহ জুবায়ের নয়, এভাবে বিভিন্ন ছাড়ে মোটরসাইকেল, গাড়িসহ নানা পণ্য অর্ডার করে সেই পণ্য বা টাকা ফেরত পাননি হাজার হাজার গ্রাহক।  গ্রাহকদের দেয়া চেকের মেয়াদ অধিকাংশেরই শেষ। কিন্তু আলেশা মার্ট চেক রিপ্লেস ও মূল টাকা ফেরত দেয়ার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। এমনকি প্রতিষ্ঠানটির সব অফিস, কলসেন্টার দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ। বিভিন্ন ধরনের পণ্য অর্ডার করে প্রায় ৭ হাজার গ্রাহক সেই পণ্য বা টাকা ফেরত পাননি বলে জানান আলেশা মার্ট কাস্টমারস এসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুল্লাহ আল মামুন। ই-কমার্সে অর্ডারকারী ৯০ ভাগ গ্রাহক ছাত্র-জনতা।

 তিনি বলেন, ৩০০ কোটি টাকার মধ্যে মূল্য পরিশোধের গেটওয়েতে থাকা ৪২ কোটি টাকা গ্রাহকদের পরিশোধ করা হয়েছে। বাকি ২৫৮ কোটি টাকা পাবেন গ্রাহকেরা।  কেস স্টাডি-২:, ই-অরেঞ্জে ৩ লাখ ১৬ হাজার, ইভ্যালিতে আড়াই লাখ টাকাসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানে ৬ লাখ টাকা আটকে আছে মামুন নামে এক গ্রাহকের। এখন পর্যন্ত এক টাকাও ফেরত পাননি। ঋণ করে তিনি টাকাগুলো দিয়েছিলেন। এখন হতাশা জেঁকে বসেছে। সূত্র জানায় ইভ্যালির সাভারের দুটি গুদামে ২৫ কোটি টাকার পণ্য রয়েছে।  কেস স্টাডি-৩: রাজধানীর উত্তরার বাসিন্দা সিরাজুল নামে একটি কোম্পানির কর্মকর্তা বলেন, আমি ৯৬ হাজার টাকার পণ্য অর্ডার করেছিলাম। সেগুলো পাইনি, পরে দোকান থেকে কিনেছি। পরে শুনি আমার মতো অনেকের কোটি টাকা আটকে আছে। কবে টাকা পাবো তা নিয়ে কোনো নির্দেশনা না থাকায় মনে হচ্ছে টাকাটা আর পাবো না।  

কেস স্টাডি-৪: একটি বেসকারি প্রতিষ্ঠানে কাজ করেন আলমগীর হোসেন। তিনি জানান, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান থেকে অনেকেই কিনতে দেখে আমিও আগ্রহী হই। এক বছর আগে ধামাকার ঝড় অফারে ১ লাখ ১২ হাজার টাকায় একটি পালসার মোটরসাইকেল অর্ডার দিয়েছিলাম। ১৩ মাস হলো এখন পর্যন্ত টাকাও পাইনি, মোটরসাইকেলও পাইনি। কেউ কোনো দিন ফোনও দেয়নি।  কেস স্টাডি-৫: রংপুরের এক ভুক্তভোগী গ্রাহক সাইফুল জানান, ইভ্যালি থেকে দুইবারে দুটি পণ্য বুঝে পাওয়ার পর আরও বেশি করে পণ্য অর্ডার করেছিলেন তিনি। কিন্তু এরপর আমি ধরা খাই। সাইমুন বলেন, বাড়িতে এখন মুখ দেখাতে পারি না। সবাই শুধু টাকার জন্য খোটা দেয়। কেউ কেউ আবার প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ নিয়েও কথা বলেছেন। তাদের মধ্যে রেহেনা খানম বলেন, ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান ইভ্যালির সাবেক সিইও মো. রাসেল ষড়যন্ত্রের শিকার। রাসেলকে জেলে পাঠানোয় আমাদের টাকা আটকে গেছে। পণ্য পাইনি, টাকাও পাইনি। অবিলম্বে তার মুক্তি চাই। আর রাসেল জেলে যাওয়ার পর থেকে দায়িত্ব নেয়া বোর্ড যে পরিমাণ সময় নিয়েছে, তাতে কাজের কাজ হয়নি।  ইভ্যালির পরিচালনা পর্ষদের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) এবং অবসরপ্রাপ্ত অতিরিক্ত সচিব মাহবুব কবির মিলন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানটির গ্রাহকদের ধৈর্য ধারণের আহ্বান জানিয়েছেন। কোম্পানি বাঁচানোর চেষ্টা করছি। 

আপনারা যেন পণ্য অথবা টাকা ফেরত পান, সেই চেষ্টা করছি। এদিকে গ্রাহক হয়রানি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে বিভিন্ন ই-কমার্স প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার তদন্তে তোড়জোড় নেই। কয়েক আসামিকে গ্রেপ্তার করার পরেই থমকে গেছে অধিকাংশ মামলার তদন্ত কার্যক্রম। শতাধিক মামলার সব তদন্ত শেষ করতে পারেনি পুলিশ। আইনি দিকগুলো বিবেচনায় না নিয়েই একের পর এক ফৌজদারি মামলা করায় অর্থ ফেরত পাওয়া নিয়ে অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে বলে জানিয়েছেন আইন বিশেষজ্ঞরা।  ই-কমার্স এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ই-ক্যাব) নির্বাহী পরিচালক জাহাঙ্গীর আলম শোভন বলেন, ই-কমার্সে আস্থা ফেরাতে আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছি। গেটওয়েতে আটকে থাকা কিছু গ্রাহকের টাকা ফেরত দেয়া হচ্ছে। 

গত বৃহস্পতিবার ই-মার্সের ওপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি বৈঠক হয়েছে। এতে ৬টি প্রতিষ্ঠানের কার্যক্রম বন্ধের ব্যাপারে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশনে চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ ছাড়া মোট ২৭টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ১৩টি প্রতিষ্ঠান কিছু গ্রাহকের টাকা ফেরত দিলেও বাকি ১৪টি ফেরত দেয়ার প্রক্রিয়া শুরু করেনি। এগুলো হচ্ছে ইভ্যালি, সিরাজগঞ্জ শপ, নিডস, টোয়েন্টিফোর টিকেটি, ই-অরেঞ্জ, উইকুম, আকাশ নীল, প্রিয় শপ, আলাদিনের প্রদীপ, আমার বাজার, আস্থার প্রতীক, বাড়ির দোকান ডটকম, নিরাপদ ও ইনফিনিটি মার্কেটিং লিমিটেড।  বাণিজ্য সচিব তপন কান্তি ঘোষ বলেন, টাকা ফেরতের বিষয়টি প্রক্রিয়ার মধ্যে আছে। পেমেন্ট গেটওয়েতে আটকে যাওয়া ২০২১ সালের ৩০শে জুনের পরের টাকা ফেরত দেয়া সম্ভব হচ্ছে। 

অর্থ-বাণিজ্য থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

অর্থ-বাণিজ্য সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status