প্রথম পাতা
প্রবাসী কল্যাণ ভবনে একদিন
সালেহ’র কান্না, সাত্তারের অপেক্ষা
মেহনাজ শাহরিন অর্থি
২২ জানুয়ারি ২০২৫, বুধবারপ্রবাসী। জীবন যুদ্ধের এক নায়ক। কিন্তু এ নায়কের আড়ালে তার জীবনে বয়ে যায় পাহাড়সম যন্ত্রণা। স্বজনদের দেশে রেখে ভিনদেশে বসবাস কতোটা কষ্টের একমাত্র প্রবাসীই জানেন। এরাই দেশের রেমিট্যান্স যোদ্ধা। প্রবাসে থেকে নিজ দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখার দায়িত্বও তাদের কাঁধে। তারপরও তারা বঞ্চিত নানা দিক থেকে। প্রবাসে যেতেও যেন তাদের পাহাড় ডিঙাতে হয়। সেটা চাকরির ক্ষেত্রে হোক কিংবা পড়ালেখার জন্য উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে। তারপরও ছুটছে মানুষ। তাদের চোখে একরাশ স্বপ্ন। কারও কারও স্বপ্নভঙ্গ হয় প্রবাসে গিয়ে। কেউবা স্বপ্ন পূরণ করে নিজেকে উচ্চতায় তুলে ধরেন। প্রবাসে যেতে হলে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুমতির প্রয়োজন হয়। এজন্য সেখানে প্রতিদিন থাকে লম্বা লাইন। কোনো কোনো প্রবাসী দেশে থাকা স্বজনদের মাধ্যমে প্রতারিতও হন। সরজমিন প্রবাসী কল্যাণ ভবনে গিয়ে দেখা যায় হাজারো মানুষের ভিড়। তাদেরই একজন আবু সালেহ। দুঃখ করে তিনি বলেন, পাঁচ বছর কুয়েতে থেকেছি। ওখানে অনেক কষ্টের কাজ করেছি। মানুষ মনে করে বিদেশে থাকা মানে আরাম-আয়েশে থাকা। কিন্তু জীবন কত কঠিন কেবল প্রবাসীরাই বুঝতে পারেন। আমার জীবনে সবচেয়ে দুঃখের বিষয় হলো- উপার্জনের অর্ধেকের বেশি টাকা স্ত্রীর কাছে পাঠাতাম। আমার স্ত্রীকে বলেছিলাম তোমাকে যে টাকাগুলো পাঠাই সেখান থেকে নিজের প্রয়োজনমতো খরচ করে বাকি টাকা সঞ্চয় করে রেখো, যাতে গ্রামে অল্প কিছু জায়গা কিনতে পারি। কিন্তু সে আমার সঙ্গে এমন প্রতারণা করবে- এটা কখনো ভাবিনি। আমি যখন দেশের বাইরে, তখন সে আমারই পাঠানো ফোন দিয়ে অন্য ছেলের সঙ্গে সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ে। সেই ছেলের সঙ্গে পালিয়ে যায়। পরবর্তীতে জানতে পারি যে তাকে বিয়ে করেছে। এমনকি আমার ছেলেকেও তার সঙ্গে নিয়ে যায়। সব হারিয়ে ফেলার পর এখন আর দেশের বাইরে কাদের জন্য থাকবো? তাই দেশে ফিরে আসি। তিনি বলেন, দেশের বাইরে যাওয়ার পরই মায়ের মৃত্যু হয়। তার লাশটাও আমি দেখতে পারিনি। দুই বছর বয়সে ছেলেকে প্রথম দেখেছিলাম মধ্যখানে যখন এক মাসের জন্য দেশে আসি।
সালেহ বলেন, দেশে আসার পর কী করবো, কোথায় থাকবো- কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। ঢাকাতে আপাতত এক বন্ধুর বাড়িতে উঠেছি। কিন্তু এখানেতো আর বেশি দিন থাকতে পারবো না। শুনেছি ওয়েজ অনার্স কল্যাণ বোর্ড থেকে প্রবাস ফেরত কর্মীদের সাময়িক আবাসন সুবিধা দেয়া হয়। কর্মের একটা ব্যবস্থা করতে পারবো, কিন্তু আপাতত থাকার কোনো একটা জায়গা দরকার এই শহরে। তাই প্রবাসী কল্যাণ ভবনে এসেছি। তিনদিন ধরে আসছি এখানে। প্রথমদিন প্রয়োজনীয় কিছু কাগজপত্র আনার কথা বললেন। পরের দিন সেগুলো জমা দেই। এরপর প্রায় পনেরো দিন পরে এসেছিলাম। কিন্তু কোনো ব্যবস্থা হয়নি। আজ আবার এসেছি। কী হয়- কে জানে।
প্রবাসী কল্যাণ ভবনে মোহাম্মদ ছাত্তার নামে আরেকজনের সঙ্গে কথা হয়, যিনি পেশায় একজন চায়ের দোকানদার। বাড়ি কল্যাণপুরে। তিন মেয়েকে নিয়ে সেখানে থাকেন। তিনি বলেন, পরিবারে আর্থিক সংকট থাকার কারণে একরকম বাধ্য হয়েই আমি আমার স্ত্রীকে দেশের বাইরে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেই। জর্ডানে তাকে বিনা খরচেই পাঠানো হয়। কিন্তু ও ওখানে গিয়ে শারীরিকভাবে আস্তে আস্তে দুর্বল হয়ে পড়ে। জর্ডানের এক গার্মেন্টসে কাজের জন্য নেয়া হয় তাকে। কিন্তু শারীরিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ায় সে কাজেও যেতে পারছে না। সে যেখানে আছে ওখানে ডাক্তার থাকার পরেও সুস্থ হতে পারেনি। ওখানকার ডাক্তার বলেছেন, মূলত ওই দেশের আবহাওয়ার সঙ্গে সে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারছে না। তাই আমি চাচ্ছি ওকে দেশে ফিরিয়ে আনার। প্রবাসী কল্যাণ ভবনের সহায়তা নিয়েই ওকে জর্ডানে পাঠিয়েছিলাম। তাই আবার এখানে এসেছি দেশে আনার ব্যবস্থা করতে। উনারা আমাকে আশ্বস্ত করলেও দুই মাস ধরে ঘুরছি। কোনো ব্যবস্থা হয়নি এখনো। প্রতিদিন হতাশ হয়েই বাড়ি ফিরতে হচ্ছে আমাকে।
রেশমা আক্তার নামে একজন নার্সের সঙ্গে কথা হয় প্রবাসী কল্যাণ ভবনে। তিনি বলেন, তার স্বামী সৌদিপ্রবাসী। তাদের এক ছেলে ও দুই মেয়ে। ছেলে কথা বলতে পারে না। তিন ছেলে-মেয়েকে নিয়ে ঢাকাতে চলতে একরকম সংগ্রাম করতে হয় তাকে। এছাড়া তার স্বামী আগের মতো উপার্জনও করতে পারছেন না। স্বামীর কাছে জেনেছেন, এখানে প্রবাসী কর্মীর প্রতিবন্ধী শিশুদের ভাতা দেয়া হয়। বলেন, এক মাস ধরে এখানে আসছি কিন্তু কোনো সুরাহা হলো না। তাদের কথামতো প্রয়োজনীয় সব কাগজপত্র জমা দিয়েছি। কিন্তু এখনো কোনো ব্যবস্থা হয়নি।
প্রবাসীদের যে কোনো সহযোগিতায় কাজ করে প্রবাসী সাপোর্ট সেন্টার। সেখানকার কর্মকর্তারা বলেন, আমরা বিদেশ ফেরত অসুস্থ ও মৃত কর্মী পরিবহনে বিমানবন্দর থেকে এম্বুলেন্স সেবা প্রদান, প্রবাসী কর্মীর পরিবারকে দায়মুক্তির সনদ, অঙ্গীকারনামা, ক্ষমতা অর্পণপত্র, পারিবারিক সনদ, পাওয়ার অব অ্যাটর্নি, এইচ ফরম, এফএএস ফরম তৈরিসহ অন্যান্য আইনি ও প্রশাসনিক সহায়তা প্রদান, অনিবন্ধিত ও অনাবাসী বাংলাদেশিদের বোর্ডের সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্তকরণ, শ্রমকল্যাণ উইংয়ের মাধ্যমে সহায়তা, প্রবাসে সমস্যা অথবা বিপদগ্রস্ত নারী কর্মীদের সেইফ হোমে আশ্রয় প্রদান এবং প্রয়োজনে দেশে ফেরত আনয়নে সহায়তা প্রদান, প্রত্যাগত কর্মীদের পুনঃএকত্রীকরণ করে থাকি। অন্যদিকে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ওয়েজ আর্নার্স কল্যাণ বোর্ড বিদেশগামী ও প্রবাস ফেরত কর্মীদের সাময়িক আবাসন সুবিধা দেয়। এছাড়াও প্রবাসীদের সন্তানদের শিক্ষাবৃত্তি প্রদান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তিতে সহায়তা ও কোটা সংস্করণ, প্রবাসী কর্মী ও তার পরিবারকে বীমা সুবিধা প্রাপ্তিতে সহায়তা, প্রবাসী কর্মীর প্রতিবন্ধী সন্তানদের প্রতিবন্ধী ভাতা প্রদান করে থাকে।
জানতে চাইলে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব সাফি কামাল বলেন, আমাদের এখান থেকে বেশি যায় গার্মেন্টস শ্রমিক। তাদের যাওয়ার ক্ষেত্রে যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা আমরা দিয়ে থাকি। প্রবাসী দেশগুলোর চাহিদা অনুযায়ী আমরা তাদের প্রশিক্ষণ দেই। এরপর তারা পরীক্ষা দিয়ে সেই দেশে যাওয়ার জন্য নির্বাচিত হন। সেখানে গিয়ে তাদের থাকা, খাওয়া, চাকরির ব্যবস্থা বিনা খরচে করে থাকি আমরা। তিনি বলেন, বিদেশে যাওয়ার জন্য অনেকেরই ঋণের প্রয়োজন পড়ে আবার বিদেশ থেকে ফেরার পর অনেকেই আর্থিক সংকটে পড়েন বিধায় আমরা তাদের ঋণ দিয়ে সহযোগিতা করি। এছাড়া আমরা মানুষকে আত্মকর্মসংস্থানে সহযোগিতা, উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ গ্রহণে সহযোগিতা, কারিগরি প্রশিক্ষণ গ্রহণে সহযোগিতা ছাড়াও অন্যান্য সহায়তা দিয়ে থাকি। ২০২৩-২০২৪ সালে আমাদের সহায়তায় ১৫ হাজার ৫৫৮ জন শ্রমিক বিদেশে গেছেন। যাদের মধ্যে ১১ হাজার ৫০২ জনই জর্ডানে। আর এদের সবাইকে বিনা খরচেই পাঠানো হয়েছে।