প্রথম পাতা
ট্রাম্প ঝড়
মানবজমিন ডেস্ক
২১ জানুয়ারি ২০২৫, মঙ্গলবার
তুষার ঝড় আর কনকনে ঠাণ্ডা। এমন এক আবহাওয়ার মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিলেন ডনাল্ড ট্রাম্প। শুরু হলো ট্রাম্প ২.০ যুগের। একই সঙ্গে শুরু হয়েছে ট্রাম্প ঝড়। আগেই প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। বলেছেন, শপথ নেয়ার প্রথম দিনেই নির্বাহী আদেশের ঝড় তুলে দেবেন।
এই ঝড়ের শিকার হওয়ার কথা অবৈধ অভিবাসী, পরিবেশ রক্ষায় নিয়মের কড়াকড়ি কমানো, ডাইভারসিটি প্রোগ্রাম বন্ধ করার মতো ইস্যু। ট্রাম্প আগেই জানিয়েছেন, সোমবার শপথ নিয়েই কমপক্ষে দুই শত নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করবেন। এর মধ্যে আছে নির্বাহী আদেশ ও অন্যান্য নির্দেশনা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের নির্বাহী আদেশ মানে তা আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক।
অন্যদিকে অন্য নির্দেশনার অর্থ তা সাধারণত বাধ্যতামূলক নয়। শপথ নেয়ার আগেই তিনি বলেছেন- বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসনের প্রতিটি উগ্র ও উদ্ভট নির্বাহী আদেশ তিনি শপথ নেয়ার কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই বাতিল করবেন। যুক্তরাষ্ট্রের সময় সোমবার দুপুর ১২টার দিকে নতুন প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নেন ডনাল্ড ট্রাম্প। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের ২০তম সংশোধনীর অধীনে এই শপথ অনুষ্ঠিত হয়। এর সঙ্গে সঙ্গে জো বাইডেনের নামের আগে যোগ হয়েছে সাবেক প্রেসিডেন্ট। ডনাল্ড ট্রাম্পের নামের আগে যুক্ত হয়েছে প্রেসিডেন্ট বিশেষণ। এর মধ্যদিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়। শপথ অনুষ্ঠান আয়োজন করেন মিনেসোটার ডেমোক্রেট সিনেটর অ্যামি ক্লোবুচারের নেতৃত্বে জয়েন্ট কংগ্রেসনাল কমিটি অন ইনঅগুরাল সিরিমনিস। এর মধ্যে ছিল ক্যাপিটলে শোভাযাত্রা, ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্সের শপথ গ্রহণ, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শপথ অনুষ্ঠান, তার উদ্বোধনী ভাষণ, বিদায়ী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও ভাইস প্রেসিডেন্ট কমালা হ্যারিসের সম্মানজনক বিদায়, স্বাক্ষর অনুষ্ঠান, মধ্যাহ্নভোজ, সামরিক পর্যালোচনা এবং প্রেসিডেন্সিয়াল প্যারেড।
উল্লেখ্য, এবার ভয়াবহ ঠাণ্ডা আবহাওয়ার কারণে এসব অনুষ্ঠান হয় ওয়াশিংটনে ক্যাপিটল ওয়ান এরিনাতে। এবারের শপথ অনুষ্ঠানে থিম হলো ‘আমাদের স্থায়ী গণতন্ত্র: একটি সাংবিধানিক প্রতিশ্রুতি’। ভাইস প্রেসিডেন্ট জেডি ভান্সকে শপথ পড়ান সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি ব্রেট কাভানাহ। ওদিকে সোমবার ওয়ান এরিনাতে বিজয় সমাবেশে হাজার হাজার সমর্থকের সামনে বক্তব্য রাখেন ডনাল্ড ট্রাম্প। সেখানে তিনি তার ক্ষমতার চার বছরে যেসব পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে চান, তার বর্ণনা দেন। তিনি বলেন, নির্বাহী ক্ষমতা ব্যবহার করে অবৈধ অভিবাসীদেরকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দেবেন। তিনি বলেন, আমরা আমেরিকাকে প্রথমে রাখবো। আর সোমবার থেকেই এর কাজ শুরু হবে। বিবিসি’র তথ্যমতে, সোমবার তার শপথ অনুষ্ঠানের কথা উল্লেখ করে ট্রাম্প বলেন, সোমবার আপনারা টেলিভিশন দেখে অনেক মজা পাবেন। তিনি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে উন্নত করা, সরকারের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য একটি বিভাগ গঠন করা, জন এফ কেনেডি হত্যা সম্পর্কিত রেকর্ড প্রকাশ করা, সামরিক বাহিনীকে আয়রন ডোম ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করার নির্দেশনা দেয়া, সেনাবাহিনী থেকে বৈচিত্র্য, সমতা ও অন্তর্ভুক্তি নীতি বাতিল করার প্রতিশ্রুতি দেন।
ট্রাম্প আরও বলেছেন, ট্রান্সজেন্ডার নারীদের ‘নারী’ ক্রীড়া বিভাগে প্রতিযোগিতা বন্ধ করা এবং আমেরিকার রাজ্যগুলোর হাতে শিক্ষার নিয়ন্ত্রণ ফিরিয়ে দেবেন। তার ক্ষমতা গ্রহণ নিয়ে চলে ব্যাপক আলোচনা। উত্তর মেরু থেকে দক্ষিণ মেরু। জাপান থেকে লস অ্যানজেলেস, অস্ট্রেলিয়া, ভানুয়াতু পর্যন্ত সর্বত্রই আলোচনা ট্রাম্প। কারণ, তার ক্ষমতার মেয়াদে বিশ্ব রাজনীতি, অর্থনীতি সাজবে নতুন রূপে। এ কারণে সব চোখ ছিল গতকাল ক্যাপিটল হিলে এবং সব চোখ থাকবে এখন থেকে ট্রাম্পের দিকে। তার নীতি বিশ্বকে বদলে দিতে পারে। এ জন্য নির্বাহী আদেশকে ঝড়ের সঙ্গে তুলনা করা হচ্ছে। এর মধ্যদিয়ে সবকিছুকে তিনি ওলটপালট করে দিতে পারেন। তাই দ্বিতীয় মেয়াদে ট্রাম্পের প্রশাসনকে ট্রাম্প ঝড় হিসেবে অভিহিত করা হচ্ছে। সাধারণত, দায়িত্ব গ্রহণের প্রথম দিনে প্রেসিডেন্টরা নির্বাহী আদেশ জারি করে থাকেন। গতরাতে এই রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত তার ওইসব আদেশ হাতে পাওয়া যায়নি। তবে মিডিয়ায় এ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ছিল।
বিবিসি’র মতে, ট্রাম্পের প্রথম দিনের আদেশের সংখ্যা তার পূর্বসূরিদের তুলনায় অনেক বেশি হতে পারে এবং এর অনেকগুলো আদালতে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে পারে। ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দেন, সোমবার তার নির্বাহী পদক্ষেপগুলো অবৈধ অভিবাসন মোকাবিলাকেন্দ্রিক হবে। তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, লাখ লাখ অবৈধ অভিবাসীকে বহিষ্কার করার প্রতিশ্রুতি বিশাল লজিস্টিক বাধার সম্মুখীন হবে এবং সম্ভবত কয়েক বিলিয়ন ডলারের খরচও হতে পারে তার জন্য। ২০২১ সালের ৬ই জানুয়ারি ক্যাপিটলে দাঙ্গার ঘটনায় দোষী সাব্যস্তদের জন্য ট্রাম্প ক্ষমা ঘোষণা করবেন বলে আশা করা হচ্ছে। ওই হামলার নেতৃত্বে তার সমর্থকরাই ছিলেন। সোমবারের বিজয় সমাবেশে ট্রাম্পের সঙ্গে তার পরিবারের সদস্যরাও মঞ্চে যোগ দেন। এর মধ্যে ছিলেন ছেলে ডনাল্ড ট্রাম্প জুনিয়র, এরিক এবং এরিকের স্ত্রী লারা ট্রাম্প। এবারই গত ৪০ বছরের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো প্রচণ্ড ঠাণ্ডা ও তুষারপাতের কারণে শপথ অনুষ্ঠান ক্যাপিটলের ভেতরে সরিয়ে নেয়া হয়েছে। ট্রাম্প শপথ নেয়ার পর সমর্থকদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন। তার ভাষণের মূল বিষয়- ঐক্য, শক্তি এবং ন্যায়বিচার।
কেমন প্রভাব পড়বে বিশ্বে: দ্বিতীয় বারের মতো হোয়াইট হাউসে ফিরলেন প্রেসিডেন্ট ডনাল্ড ট্রাম্প। তার এই ফেরা বৈশ্বিক রাজনীতি ও নীতিতে বড় পরিবর্তন আনতে পারে। বিবিসি বলছে, তার ‘আমেরিকা ফার্স্ট’ এজেন্ডা আন্তর্জাতিক সম্পর্কে নতুন রূপ দেয়ার পাশাপাশি বিশ্ব জুড়ে লাখ লাখ মানুষের জীবনে প্রভাব ফেলতে পারে। নির্বাচনী প্রচারণার সময়েই ট্রাম্প বলেছেন, তিনি রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ একদিনেই শেষ করতে পারবেন, তবে তিনি কীভাবে সেটা করবেন, তা বিস্তারিত বলেননি। তিনি ইউক্রেনকে বিলিয়ন ডলারের সামরিক সহায়তা দেয়ার সমালোচনা করেছেন। এতে উদ্বেগ দেখা দিয়েছে যে, তিনি হয়তো ইউক্রেনকে আঞ্চলিক সমঝোতা করতে চাপ দিতে পারেন। ট্রাম্পের মনোনীত বিশেষ দূত কিথ কেলগ ১০০ দিনের মধ্যে এ সংকট সমাধানের লক্ষ্যে কাজ করছেন এবং ইউক্রেনকে শান্তি আলোচনায় অংশ নেয়ার শর্তে সহায়তা দেয়ার কথা বলেছেন। ন্যাটো নিয়েও সমালোচনা করেছেন ট্রাম্প। তিনি ইউরোপীয় সদস্যদের প্রতিরক্ষা ব্যয় জিডিপি’র পাঁচ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করার দাবি জানিয়েছেন।
যদিও তিনি ন্যাটো থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহারের কথা স্পষ্ট করেননি। তবে তিনি ইউরোপে মার্কিন সেনাদের সংখ্যা কমিয়ে ন্যাটোকে দুর্বল করে দিতে পারেন। তিনি মধ্যপ্রাচ্যে ইসরাইলপন্থি অবস্থান ধরে রাখবেন। আব্রাহাম অ্যাকর্ডসের ভিত্তিতে সৌদি আরব এবং ইসরাইলের মধ্যে চুক্তি করার চেষ্টা করতে পারেন। ইরানের বিরুদ্ধে তার কঠোর অবস্থান অব্যাহত থাকতে পারে। তিনি ইরানের বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা এবং সামরিক প্রতিরোধ জারি করতে পারেন। গাজার যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জও তার নেতৃত্বের পরীক্ষা নেবে।
চীনের প্রতি ট্রাম্পের কঠোর মনোভাব আরও তীব্র হতে পারে। তিনি চীনা পণ্যের উপর ৬০ শতাংশ শুল্ক আরোপের প্রস্তাব দিয়েছেন আগে। তার প্রশাসন চীনকে একটি বড় হুমকি হিসেবে দেখে, বিশেষ করে তাইওয়ান ইস্যুতে। ট্রাম্প সামরিক পদক্ষেপের বিরোধিতা করলেও তাইওয়ানের প্রতি চীনের যেকোনো আক্রমণাত্মক পদক্ষেপের বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক প্রতিশোধের হুমকি দিয়েছেন। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে ট্রাম্প আবার প্যারিস চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে সরিয়ে নিতে পারেন এবং জীবাশ্ম জ্বালানির উৎপাদন বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে পারেন। তিনি সবুজ শক্তির জন্য আর্থিক প্রণোদনা কমানো এবং তেল ও গ্যাস ড্রিলিং বাড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। অভিবাসন নিয়ে ট্রাম্প লাখ লাখ অনথিভুক্ত বা অবৈধ অভিবাসীকে বিতাড়িত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন এবং জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব বাতিলের পরিকল্পনা করেছেন। তার পরিকল্পনার মধ্যে রয়েছে বিতর্কিত ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞা পুনর্বহাল করা এবং সীমান্ত নিরাপত্তা কঠোর করা। তবে, বিশেষজ্ঞরা বলছেন, তার এই পরিকল্পনাগুলো আইনি, লজিস্টিক এবং আর্থিক দিক থেকে বড় চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে।
ট্রাম্প কৌশলগত এবং অর্থনৈতিক স্বার্থের কথা উল্লেখ করে গ্রিনল্যান্ড কেনার এবং পানামা খালের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার ব্যাপারে তার বিতর্কিত ইচ্ছার কথা প্রকাশ করেছেন। যদিও এই পদক্ষেপগুলো সফল হওয়ার সম্ভাবনা কম, তবে এটি বিশ্বব্যাপী মার্কিন আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় ট্রাম্পের আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি প্রকাশ করে।