ঢাকা, ১০ ডিসেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, ২৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৭ জমাদিউস সানি ১৪৪৬ হিঃ

শেষের পাতা

সাক্ষাৎকার

আবু সাঈদকে হত্যার পরই চূড়ান্ত ফয়সালার প্রতিজ্ঞা করেছিলাম

হাসনাত মাহমুদ
১০ নভেম্বর ২০২৪, রবিবারmzamin

রংপুরে আবু সাঈদ যেদিন মারা যায় তখন আমরা একটা মিটিংয়ে ছিলাম। সেই মিটিংয়ে থাকা অবস্থায় মৃত্যুর খবর মেলার পর আমাদের ভাবনার জগৎ পুরোপুরি বদলে যায়। তখন থেকেই মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম এর চূড়ান্ত ফয়সালা করতে হবে। এমনটাই বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক হাসনাত আব্দুল্লাহ। ১লা জুলাই থেকে ৫ই আগস্ট। ৩৬ দিনের ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের। রক্তাক্ত এই বিপ্লবের প্রতিটি দিনই ছিল ঘটনাবহুল। মানবজমিনকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে আন্দোলনের নানা দিক তুলে ধরেছেন তিনি। আন্দোলনের সময় মন্ত্রীদের সঙ্গে আলোচনা করতে যাওয়ার বিষয়ে হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আমাকে নিয়ে সে সময় ব্যাপক অপপ্রচার চালানো হয়েছে। শিক্ষার্থী ও মানুষের কাছে আমাদের ভিলেন বানানোর চেষ্টা করা হয়েছে। কোনো ভাবেই তাদের সামনে সত্য তুলে ধরা হয়নি। দুঃখজনকভাবে সে সময় টেলিভিশন মিডিয়াগুলোর ভূমিকা ছিল পুরোপুরি সরকারের পক্ষে। আমাদের একরকম বাধ্য করা হয় মন্ত্রীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। আমাদের ১৭ই জুলাই রাত থেকে মন্ত্রীদের সঙ্গে দেখা করানোর চেষ্টা করতে থাকে ডিজিএফআই একটি গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সঙ্গে তারা ইনফরমাল আলোচনায় বসে। যেখানে তারা আমাদের আন্দোলন থেকে সরে আসার আহ্বান জানায়, সরকারের মন্ত্রীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে জোর দিতে থাকে। তবে তারা দফায় দফায় আমাদের কনভিন্স করার চেষ্টা করেও পারেনি। আবু সাঈদকে হত্যার ঘটনা জানার পর থেকে আমরা পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিয়েছিলাম আমরা কোনো বৈঠকে বসতে পারবো না।
তিনি আরও বলেন, বৈঠকে-ফোনে কনভিন্স করতে না পেরে সেদিন রাতে তারা বাসায় চলে আসে। আমার বাসায় সে সময় সারজিস আলম ছিল। সেদিন ঢাকায় আমার মামার বাসায় গিয়েও তারা ভাঙচুর করে। আমার কুমিল্লার বাসায়ও গোয়েন্দা সংস্থার লোক পাঠানো হয়। পরে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে আমাদের পদ্মায় (রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন) নিয়ে যাওয়া হয়। আমরা যাওয়ার পর সেখানে তিন মন্ত্রী (আনিসুল ইসলাম, মহিবুল হাসান চৌধুরী ও মো. এ আরাফাত) আসে। পরে আমাদের একতলায় রেখে বৈঠকের জন্য রাজি করানোর চেষ্টা করা হয়। বললাম আমরা মন্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলবো না আপনারা যা পারেন করেন। তারপর একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান সেখানে থাকা কর্মকর্তাদের আমাদের আর জোর না করতে বললেন। এরপরই তিন মন্ত্রীকে আমরা বেরিয়ে যেতে দেখলাম। তবে সেখান থেকে আমাদের আর বাসায় যেতে দেয়া হয়নি। নিয়ে আসা হলো এক সেফহোমে। সেদিন থেকে আমাদের ওপর শুরু হয় মানসিক নির্যাতন।

সেফহোমের বিষয়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই আহ্বায়ক বলেন, একেবারে নির্দিষ্ট অবস্থান মনে পড়ছে না। তবে সেটি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা ইনস্টিটিউটের আশেপাশে কোনো একটি পুরাতন ভবন হবে। যদিও ভবনের বাইরে অবস্থা দেখে ভেতরের অবস্থা ছিল পুরোপুরি ভিন্ন। এসি, কনফারেন্স রুম, টিভি, শোবার ঘর সবই ছিল সেখানে। আমাদের নিয়ে গিয়ে দুটি আলাদা রুমে রাখা হয়। নিয়ে যাওয়ার পর থেকে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কর্মকর্তারা দফায় দফায় এসে আন্দোলন বন্ধের চাপ দিতে থাকে। একটি সংস্থার এক জিএসও বলে আন্দোলন বন্ধ না করলে মেট্রোরেলে আগুন, সমস্ত কিলিংয়ের দায় আমাদের ওপর পড়বে। তবে আমরা অনড় ছিলাম। আমাদের একটাই কথা আমাদের সবাইকে (সমন্বয়ককে) একসঙ্গে বসতে হবে। নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদের সঙ্গে তখন আমাদের কোনো যোগাযোগ নেই। ফোন না থাকায় কাদেরসহ কারও সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারছিলাম না। আমাদের মামলার ভয় দেখানো হচ্ছিল। ক্যারিয়ার শেষ করে দেয়ার কথাও বলছিল। তাদের কথা শুনলে রিওয়ার্ডস দেয়ার পাশাপাশি দেশের বাইরে সেটেল করে দেয়ার প্রস্তাবও দেয়। তবে আমরা দাবি থেকে সরে না আসার ব্যাপারে অনড় ছিলাম। আমরা আসলে তাদের সব কথারই যৌক্তিক জবাব দিচ্ছিলাম। ফলে আমাদের ওপর তারা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। রাতে ঘুমাতে দেয়নি। একটু পরপরই আমাদের জেরার মুখোমুখি হতে হয়।

হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, তারা মূলত আমাদের কাছ থেকে আন্দোলন বন্ধের স্টেটমেন্ট আদায়ের চেষ্টা করছিল। সেটি করতে পারলে এরপর থেকে যারা মাঠে নামবে তাদের ওপর সরকার আরও কঠোর হতে পারবে। আন্দোলন বন্ধ করে ক্রেডিট নেয়ার এক রকম প্রতিযোগিতা ছিল বিভিন্ন বাহিনীর মধ্যে। পরদিন আমাদের সঙ্গে একটি গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান দেখা করতে আসেন। তিনিও নানাভাবে আমাদের ওপর চাপ দিতে থাকেন। আমাকে কঠিন এক অবস্থায় ফেলে দেয়া হয় আমি যদি আন্দোলন প্রত্যাহার করি তাহলে ছাত্ররা আমাকে মানবে না, না করলে তাদের চাপ। এ সময় আমি একটু উত্তেজিত হয়ে যাই। কোনো ভাবেই আন্দোলন বন্ধ হবে না এবং দরকারে আমাকে গ্রেপ্তার করতে বলি। তাদের জানাই, যেকোনো সিদ্ধান্ত নিতে আমার সবার সঙ্গে কথা বলতে হবে। ইন্টারনেট বন্ধ, আমি কাউকে ফোনেও পাচ্ছিলাম না। সেদিন শুক্রবার ছিল। পুলিশি জেরার কারণে আমরা নামাজও পড়তে পারিনি। অনেক চেষ্টা করার পর এক সময় হাসিবের (হাসিবুল ইসলাম) সঙ্গে যোগাযোগ হয়। এত ঘটনা সম্পর্কে সে কিছু জানতো না, সেও খুব অসহায় ছিল। পরে সেদিন সন্ধ্যায় ডিজিএফআই তাকেও তুলে নিয়ে আসে আলাদা রুমে রাখে। হাসিব মাদ্রাসা ব্যাকগ্রাউন্ডের ছিল বলে তাকে বাজেভাবে ধরা হয়। এরপর সেদিন ঢাকায় থাকা মোটামুটি সমস্ত শীর্ষ গোয়েন্দা কর্মকর্তারা আমাদের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। তারা মন্ত্রীদের সঙ্গে রাতে দেখা করার জন্য প্রচণ্ড চাপ দিতে থাকে। তাদের ভাষ্য, মন্ত্রীদের তারা অনেক কষ্টে রাজি করিয়েছেন, আমাদের বৈঠকে না নিতে পারলে সেটি গোয়েন্দা সংস্থার বড় ব্যর্থতা। বারবার বলার পরও আমরা জানাই বৈঠক করবো না। তবে আমাদের দাবিগুলো দেয়ার জন্য যেতে পারি। পরে সেটি তারা মেনে নেয়।

৮ দফা ও ৯ দফার বিষয়ে বলেন, আমরা মূলত ছাত্রলীগের হামলার পরদিনই দফাগুলোর একটা খসরা প্রস্তুত করেছিলাম। সেখানে মূলত ছয় দফা ছিল। পরে কাদের (সমন্বয়ক আব্দুল কাদের) ৯ দফা দেয়, তবে সেটি আমরা তখনো জানতাম না। সেদিন রাতে আমার নাহিদের সঙ্গে যোগাযোগ হয়েছিল। সেই আমাদের দফাগুলোর ব্যাপারে নির্দেশনা দেয়। নাহিদ অবশ্য আমাদের মন্ত্রীদের সঙ্গে দেখা না করার জন্য বলেছিল। তবে আমরা তখন বন্দি এবং কি কঠিন পরিস্থিতির মধ্যদিয়ে যাচ্ছিলাম সেটি তাকে জানাতে পারছিলাম না। সেফহোমে থাকা তিনজনকেও তারা খুব একটা একসঙ্গে বসতে দিচ্ছিল না। পরে আমরা মোটামুটি ৯ দফা নিয়েই পদ্মায় যেতে চেয়েছিলাম। যেখানে প্রথম দফা ছিল গণহত্যার জন্য শেখ হাসিনাকে ক্ষমা চাইতে হবে। তবে এ দফা নিয়ে কোনো ভাবেই যাওয়া যাবে না বলে আমাদের জানিয়ে দেয়। তারা দফাটি আমাদের কাটতে বাধ্য করে। পরে আট দফা নিয়েই আমরা রওনা দেই।

হাসনাত আব্দুল্লাহ বলেন, আমাদের রাত ১০টায় প্রায় ৩০টি গাড়ি করে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আগে থেকেই বসেছিলেন তিন মন্ত্রী। তথ্যমন্ত্রী আরাফাত তখন আমাকে বলে, তোমরা তো ভালো করেছো এ পর্যন্ত, ওয়েল ডান। তখন আমাদের বসতে বললো। তখন আইনমন্ত্রী বললেন, ওদের বিব্রত করার দরকার নেই। আমরা দাবি দিয়ে সেখানে সর্বোচ্চ দুই মিনিটের মতো ছিলাম। পরে বাইরে এসে সাংবাদিকের সঙ্গে কথা বলি। পরে সেফ হাউজে এসে সবচেয়ে বড় সার্কাসটা দেখলাম। গোয়েন্দা সংস্থার নির্দেশনায় আমার পুরো বক্তব্য তুলে না ধরে ম্যানুপুলেটেড একটা ভার্সন প্রচার করা হয়। আমি আমার বক্তব্যে শাটডাউন কর্মসূচি অব্যাহত রাখার কথা বলেছিলাম। সেটি প্রচারই করা হয়নি। উল্টো গোয়েন্দাদের কথা মতো প্রচার করা হলো আমরা আন্দোলন স্থগিত করেছি। দুইদিন সেফহোমে চাপের পরও শাটডাউন কর্মসূচি প্রত্যাহার করিনি, তাহলে সেদিন কেন এমন ঘোষণা দিবো? সেদিনের বক্তব্যের মূল ফাইলটা আমি টিভি অফিস থেকে সংগ্রহ করেছি। আমাকে পুরোপুরি ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। আমরা বারবার বলেছি কোনো সংলাপে আমরা বসতে আসিনি। তবে টেলিভিশন মিডিয়াগুলো প্রচার করতে লাগলো আমরা সংলাপে বসেছি। আমাদের আট দফা দাবিও কেউ প্রচার করেনি।

পাঠকের মতামত

Great and heroes. God will bless you. I salute you and all the heroes with you.

Tofazzel Hossain
১০ নভেম্বর ২০২৪, রবিবার, ৯:৪১ অপরাহ্ন

অজস্র শ্রদ্ধা।

Md. Rezwan Hossain
১০ নভেম্বর ২০২৪, রবিবার, ৩:৪২ অপরাহ্ন

তোমরাই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান।

Muhammad Alauddin
১০ নভেম্বর ২০২৪, রবিবার, ৩:৩৯ অপরাহ্ন

আপনাদের সাহসীকতা বিশ্বকে মুগ্ধ করেছে।

মোঃ ইব্রাহীম খলিল
১০ নভেম্বর ২০২৪, রবিবার, ৩:২৮ অপরাহ্ন

তোমরা জাতির বীর সন্তান, হিম্মত রাখো, জিতবেই ইনশাল্লাহ। এগিয়ে যাও, জনগণের সাপোর্ট তোমাদের সাথে আছে।

মোস্তফা
১০ নভেম্বর ২০২৪, রবিবার, ২:১৯ অপরাহ্ন

আমাদের সংগঠিত রাজনৈতিক দলের কর্মীরাও এধরণের পরিস্থিতিতে ঘাবড়ে গিয়ে হার মানার সম্ভাবনা ছিল। তোমাদের অসীম সাহস আর নির্লোভ দেশ প্রেমের প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ।

মাহবুব
১০ নভেম্বর ২০২৪, রবিবার, ১:১৮ অপরাহ্ন

আমরা আপনাদের কাছে ঋণী, জাতি আপনাদের মনে রাখবে, আল্লাহ আপনাদের ভাল রাখুন ।

Zahir
১০ নভেম্বর ২০২৪, রবিবার, ১০:১৯ পূর্বাহ্ন

আপনাদের অবদান অনস্বীকার্য। এখন প্রয়োজনীয় সংস্কার করে দ্রুত সময়ের মধ্যে মানুষের ভোটাধিকার প্রয়োগের জন্য কাজ করেন। বেশি দেরি করলে মানুষ আপনাদের অবদান ভুলে যাবে।

AA
১০ নভেম্বর ২০২৪, রবিবার, ৩:১৭ পূর্বাহ্ন

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status