শেষের পাতা
পানিবন্দি লাখ লাখ মানুষ
শেরপুর-ময়মনসিংহে ভয়াবহ বন্যা, নিহত ৩
বাংলারজমিন ডেস্ক
৬ অক্টোবর ২০২৪, রবিবারভারী বর্ষণ এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে শেরপুর-ময়মনসিংহে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি হয়েছে। পানির তোড়ে ভাঙছে বাঁধ, ডুবছে একের পর এক গ্রাম।
এতে পানিবন্দি হয়ে পড়েছে জেলা দু’টির লাখ লাখ মানুষ। তলিয়ে গেছে রাস্তাঘাট, বাড়িঘর, ফসলি জমি ও সবজি ক্ষেত। শেরপুরে পাহাড়ি ঢলের পানিতে ভেসে ৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এ ছাড়া আরও ৩ জন নিখোঁজ রয়েছে। এদিকে টানা বর্ষণে কুড়িগ্রামে ফের বাড়ছে নদ-নদীর পানি। পানিবন্দি হয়ে পড়েছে রৌমারী, চিলমারী, রাজীবপুর ও রাজারহাটের নিম্নাঞ্চল। তলিয়ে গেছে এসব উপজেলার ফসলি জমি ও সবজি ক্ষেত। বিস্তারিত প্রতিনিধিদের পাঠানো রিপোর্টে-
শেরপুর প্রতিনিধি জানান, শেরপুরে ৩ দিনের টানা ভারি বর্ষণ এবং উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে সৃষ্ট সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। শুক্রবার রাত থেকে শনিবার বিকাল পর্যন্ত নালিতাবাড়ী, ঝিনাইগাতী ও শ্রীবরদী উপজেলার নতুন নতুন গ্রাম প্লাবিত হচ্ছে। নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতী উপজেলা সদরের পানি কিছুটা নেমে গেলেও নিম্নাঞ্চলের অন্তত দেড়শ’ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এ ছাড়া শ্রীবরদী, শেরপুর সদর ও নকলা উপজেলার আরও ৫০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এতে জেলায় বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রাস্তাঘাটসহ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমন আবাদ, মাছের ঘের ও সবজি আবাদ। পানিবন্দি হয়ে আছে ৩ উপজেলার প্রায় ১ লাখ মানুষ।
প্রশাসন, পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, পাহাড়ি ঢলে নালিতাবাড়ীতে এক বৃদ্ধ ও নারীর মৃত্যু হয়েছে এবং নিখোঁজ হয়েছেন আরও ৩ জন। এ ছাড়া ঝিনাইগাতীতে পাহাড়ি ঢলের সঙ্গে উজান থেকে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর এক ব্যক্তির লাশ ভেসে এসেছে বলে খবর পাওয়া গেছে। নালিতাবাড়ীতে নিহত ২ জন হলেন- বাঘবেড় গ্রামের মানিক মিয়ার স্ত্রী ওমিজা খাতুন (৪৫) ও আন্ধারুপাড়া গ্রামের ইদ্রিস মিয়া (৮০)। এ ছাড়া উপজেলার নন্নী অভয়পুর গ্রামের বছির উদ্দীনের ২ ছেলে আবু হাতেম (৩০) ও আলমগীর (১৭) এবং বাতকুচি গ্রামের মৃত আব্দুল হাকিমের স্ত্রী জহুরা খাতুন (৪৫) নিখোঁজ রয়েছেন। শুক্রবার বিকালে উপজেলার নয়াবিল ইউনিয়নের আন্ধারুপাড়া গ্রামে ঢলের পানিতে ডুবে থাকা সড়ক পার হওয়ার সময় ডুবে যান ইদ্রিস মিয়া। পরে স্থানীয়রা খোঁজাখুঁজির পর তার লাশ উদ্ধার করে।
ঝিনাইগাতী উপজেলার মহারশি এবং নালিতাবাড়ীর ভোগাই ও চেল্লাখালী নদীর অন্তত ১০ জায়গায় বাঁধ ভেঙে ও নদীর পাড় উপচে প্লাবিত হওয়া গ্রামগুলোর বিভিন্ন রাস্তাঘাট ও আবাদ তলিয়ে গেছে। জেলার অন্তত ১৮ হাজার হেক্টর জমির আমন আবাদ সম্পূর্ণ ও ১৭ হাজার হেক্টর জমির আমন আবাদ আংশিকসহ ১ হাজার হেক্টর সবজির আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি কার্যালয়। এতে অন্তত ৬৫ হাজার ৪০০ কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।
নালিতাবাড়ী উপজেলার ভোগাই ও চেল্লাখালী নদীর বাঁধ ভেঙে ও নদীর পাড় উপচে পানি যাওয়ায় রামচন্দ্রকুড়া, কাকরকান্দি, নন্নী, পোড়াগাঁও, নয়াবিল, বাঘবেড়, কলসপাড়, মরিচপুরান, যোগানিয়া, রাজনগরসহ ১০টি ইউনিয়ন ও পৌর শহরের ৩টি স্থানে বাঁধ ভেঙে যাওয়ায় কয়েক হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এতে উপজেলার প্রায় ৬০০ পুকুর ও ১০ হাজার হেক্টর আমন আবাদ তলিয়ে গেছে বলে জানিয়েছে কৃষি ও মৎস্য অফিস। এ ছাড়া গতকাল শ্রীবরদী উপজেলার পাশাপাশি অপর ২ উপজেলা শেরপুর সদর ও নকলা উপজেলার নিম্নাঞ্চলের বেশকিছু এলাকা প্লাবিত হয়ে পড়েছে।
এদিকে জেলার সব সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ঘোষণা করেছে প্রশাসন। শুক্রবার বিকাল থেকে বন্যাকবলিত বেশকিছু এলাকায় জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে। নালিতাবাড়ী ও ঝিনাইগাতী উপজেলা প্রশাসনের সহযোগিতায় রাতভর পানিবন্দি মানুষদের উদ্ধারের চেষ্টা করেছেন স্বেচ্ছাসেবীরা। পরে সেনাবাহিনীর সদস্যরাও উদ্ধার কাজ পরিচালনা করেন। গতকাল জেলা বিএনপি’র সভাপতি, সাবেক এমপি মাহমুদুল হক রুবেল স্থানীয় দলীয় নেতাকর্মীদের নিয়ে ঝিনাইগাতীর বিভিন্ন এলাকায় দুর্গত মানুষের মাঝে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেছেন।
নালিতাবাড়ী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. মাসুদ রানা বলেন, অবিরাম বৃষ্টি ও ঢলের পানিতে কয়েকটি ইউনিয়ন ও পৌরসভায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। এতে কয়েক হাজার মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। তাদের সরিয়ে আনা হচ্ছে।
বন্যা পরিস্থিতি সম্পর্কে শেরপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) তরফদার মাহমুদুর রহমান বলেন, শেরপুরে পাহাড়ি ঢলের পানিতে হাজার হাজার মানুষ আটকা পড়েছে। আটকে পড়া মানুষকে উদ্ধারে নৌকা নিয়ে আসা হচ্ছে। বন্যাকবলিত মানুষের জন্য শুকনো খাবার রেডি করা হচ্ছে। রাতের মধ্যেই সেগুলো পৌঁছে দেয়া হবে।
ময়মনসিংহে পানিবন্দি হাজার হাজার মানুষ
স্টাফ রিপোর্টার, ময়মনসিংহ থেকে: গত ২৪ ঘণ্টায় টানা বর্ষণে ময়মনসিংহে ১৪৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে। এ ছাড়া ভারত নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা হালুয়াঘাট, ফুলপুর এবং ধোবাউড়ার বেশকিছু গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এর ফলে পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন হাজার হাজার মানুষ। শুক্রবার দিনভর সারা দেশের মতো ময়মনসিংহ জেলাতেও টানা বৃষ্টিপাত হয়। এরপর বৃষ্টির সঙ্গে পাহাড়ি ঢল নেমে আসায় সীমান্তবর্তী হালুয়াঘাট, ধোবাউড়ার বেশকিছু গ্রাম প্লাবিত হয়। বৃষ্টি ও ঢলের পানিতে তলিয়ে গেছে শত শত ফিশারি এবং কয়েক হাজার একর জমির ফসল।
ধোবাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিশাত শারমিন বলেন, উপজেলার দক্ষিণ মাইজপাড়া ও ঘোষগাঁওসহ কয়েকটি গ্রাম তলিয়ে গেছে বলে শুনেছি। নেতাই নদীর বাঁধ কিছু কিছু পয়েন্টে ভেঙে গেছে। এক থেকে দেড় হাজার লোক পানিবন্দি আছে, প্রায় তিনশত ঘরবাড়ি পানিতে তলিয়ে গেছে।
হালুয়াঘাট উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আবিদুর রহমান বলেন, যেসব এলাকায় পানি আটকে জলাবদ্ধতা দেখা দিয়েছে সেখান থেকে মানুষকে সরিয়ে নেয়া হচ্ছে।
ময়মনসিংহ আবহাওয়া অফিসের ইনচার্জ মিজানুর রহমান বলেন, গত ২৪ ঘণ্টায় জেলায় ১৪৯ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়েছে। তবে আগামীকাল আবহাওয়া কেমন থাকবে তা কেন্দ্রীয় আবহাওয়া অফিস থেকে জানানো হবে।
ফুলপুরে নিম্নাঞ্চল
ফুলপুর (ময়মনসিংহ) প্রতিনিধি জানান, ফুলপুরে গত দু’দিনের টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে নিম্নাঞ্চলগুলো প্লাবিত হয়েছে। এতে রোপা আমনের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন ইউনিয়নে বেশির ভাগ আমন ক্ষেত অথৈ জলে তলিয়ে গেছে। যা দু’দিন আগেও ছিল সবুজ সমারোহ ও নির্মল প্রান্তর। এক থেকে দেড় মাসের মধ্যে নতুন ধান ঘরে তোলার কথা থাকলেও এখন পাহাড়ি ঢলের পানিতে নিমজ্জিত হাজারো কৃষকের স্বপ্ন।
কুড়িগ্রামে ফের বাড়ছে নদ-নদীর পানি
স্টাফ রিপোর্টার, কুড়িগ্রাম থেকে: ভারি বৃষ্টি ও উজানের ঢলে কুড়িগ্রামে ফের বাড়ছে নদ-নদীর পানি। তিস্তা, ধরলা, দুধকুমার ও ব্রহ্মুপুত্রের পানি ধীরগতিতে বাড়লেও তিস্তার পানি বিপদসীমার কাছাকাছি অবস্থান করছে। ভারি বৃষ্টির কারণে কুড়িগ্রাম শহরের জেলা প্রশাসকের কার্যালয় চত্বর, ফায়ার সার্ভিস চত্বর, টাপু ভেলাকোপা, চর হরিকেশ, তালতলা ও রৌমারীপাড়াহ কয়েকটি এলাকায় জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় কুড়িগ্রাম সদর উপজেলায় ১০০ মিলিমিটারসহ জেলায় ১৫৭ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে। টানা বৃষ্টিপাতের কারণে জেলার সবগুলো নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে বলে জানান কুড়িগ্রাম পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রাকিবুল হাসান।
পাহাড়ি ঢলে সীমান্তবর্তী জিঞ্জিরাম নদীর পানি দুকূল ছাপিয়ে রৌমারী ও রাজীবপুর উপজেলার ১০টি গ্রামের নিচু এলাকার আমন ও বাদাম ক্ষেত তলিয়ে গেছে। এরমধ্যে রৌমারী উপজেলার চর লাঠিয়াল, চান্দারচর, ভন্দুরচর, বড়াইবাড়ী এবং রাজীবপুর উপজেলার বালিয়ামারি, শিবেরডাঙি ও নয়ারচর রয়েছে। গত এক সপ্তাহেরও বেশি সময় ধরে তিস্তা ও ধরলার নিচু এলাকায় প্রায় ৫০০ হেক্টর জমির আমন ক্ষেত তলিয়ে থাকায় ক্ষেত নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা করছেন কৃষকরা।