ঢাকা, ২৯ মার্চ ২০২৪, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ, ১৮ রমজান ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

কা ও রা ন বা জা রে র চিঠি

শেরেবাংলা নগরে ভোটের আওয়াজ, পর্দার আড়ালে ‘সংলাপ’, আন্তর্জাতিক শক্তির বোঝাপড়া

সাজেদুল হক
২৪ জুলাই ২০২২, রবিবার
mzamin

প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ বাংলাদেশের অনেক বিশিষ্টজনও প্রায়শই বিরোধী শক্তিকে পরামর্শ দেন, ভোটকেন্দ্রে শক্ত অবস্থান নেয়ার। বলা হয়, বিরোধী দলের এজেন্ট থাকে না তো কিসের ভোট! এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে কী জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষমতা রহিত হয়ে যায়। সংবিধান বা আইনে কি এ ধরনের কোনো কথা রয়েছে। এটা সত্য, একটি আসনে একজন মাত্র প্রার্থী থাকলে সেখানে আর ভোটের প্রয়োজন হয় না। আইনই ওই প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণার কথা বলেছে। যদিও সেটা গণতন্ত্রের চেতনাবিরুদ্ধ। কিন্তু দুই জন প্রার্থী থাকলে? সেখানে তো প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের অবাধে ভোট দেয়ার সুযোগ থাকতে হবে। সংবিধান তো এমনি এমনি বলেনি, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস

 

শেরেবাংলা নগর সরগরম। দেশি-বিদেশি অতিথিদের আনাগোনা। কেউ আমন্ত্রণে, কেউবা নিজ উদ্যোগে।

বিজ্ঞাপন
কেউ কেউ আবার দাওয়াত পেয়েও যাচ্ছেন না। বিরাম নেই কাজী হাবিবুল আউয়ালের। সিইসি’র আসনে বসার পর থেকেই দিনরাত ব্যস্ত তিনি। সংলাপের পর সংলাপ। এজেন্ডা আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন। সময়টাও অবশ্য খুব একটা লম্বা নয়। ঘড়ির কাঁটাকে আটকে রাখে এই সাধ্য কার! ২০২৩ সালের ডিসেম্বর কিংবা ২৪ সালের শুরুতেই অনুষ্ঠিত হবে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন।

সাবেক শীর্ষস্থানীয় আমলা কাজী হাবিবুল আউয়াল দায়িত্ব নিয়েছেন বেশিদিন হয়নি। এরইমধ্যে তিনি নানা আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দিয়েছেন। সর্বশেষ রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপে যেমন তার বেশ কিছু বক্তব্য তোলপাড় তৈরি করেছে। একটি বক্তব্যের জন্য অনুতাপ ও দুঃখও প্রকাশ করেছেন তিনি। গত ১৭ই জুলাই রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের শুরুতে এনডিএমের সঙ্গে বৈঠকে তিনি বলেন, “আপনাদের সমন্বিত প্রয়াস থাকবে, কেউ যদি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়ায়, আপনাকেও কিন্তু রাইফেল বা আরেকটি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়াতে হবে। আপনি যদি দৌড় দেন, তাহলে আমি কি করবো? কাজেই আমরা সাহায্য করবো। পুলিশের ওপর, সরকারের ওপর আমাদের কমান্ড থাকবে।” (সূত্র: বিডিনিউজ)।

ওইদিন বিকালেই অবশ্য তিনি নিজের বক্তব্য সংশোধন করেন। সিইসি বলেন, আপনাদের জনসমর্থন নিয়ে যুদ্ধ করতে হবে। আপনারা তলোয়ার-রাইফেল নিয়ে যুদ্ধ করবেন না। আপনাদের জনসমর্থন যেগুলো আছে তারা আসবে। আপনারা ব্যালট নিয়ে যুদ্ধ করবেন। সেই যুদ্ধটা আপনাদের করতে হবে। কাজী হাবিবুল আউয়াল অবশ্য পরে বলেছেন, তলোয়ার-রাইফেলের বক্তব্য তিনি কৌতুক করে দিয়েছেন। এ জন্য অনুতাপ ও দুঃখও প্রকাশ করেছেন। সংবাদমাধ্যমগুলোতে যেভাবে খবর এসেছে তা নিয়ে প্রকাশ করেছেন গভীর হতাশা। সে যাই হোক, হাবিবুল আউয়ালের সফলতা এই যে, প্রায় এক যুগ পর তিনি আবার জনগণের দৃষ্টি শেরেবাংলা নগরে ফেরাতে সক্ষম হয়েছেন। বিরোধী দলগুলো সেখানে না গেলেও এটা নিশ্চিত করেই বলা যায় তারা সেদিকে দৃষ্টি রাখছে। তাদের জন্য অপেক্ষা করার কথাও জানিয়েছেন সিইসি। তিনি পরিষ্কার করেই বলেছেন, বিএনপিকে ছাড়া নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হবে না। জাতির জন্য অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের অনিবার্য প্রয়োজনীয়তার কথাও কবুল করেছেন সিইসি। একটি সংসদে সরকারি দলের ২৯৮ জন এবং বিরোধী দলের দুই জন সদস্য থাকলে সেটি কতো শক্তিশালী বিরোধী দল সে প্রশ্নও তুলেছেন তিনি। বলেছেন, সংসদও দেখি না। ভালো লাগে না, আনন্দ লাগে না।

প্রশ্ন হচ্ছে, নির্বাচন কমিশনের একার পক্ষে একটি অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আয়োজন সম্ভব কিনা? সহজ উত্তর হচ্ছে, ‘না’। বিশেষত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং প্রশাসন যদি নির্বাচন কমিশনকে সহায়তা না করে। নির্বাচন কমিশন রেফারি মাত্র। সে তার সদিচ্ছার প্রমাণ দিতে পারে। কিন্তু নির্বাচনকালীন সরকার যদি নিরপেক্ষ এবং স্বচ্ছ নির্বাচন না চায় তবে তা আয়োজন অত্যন্ত দুরূহ কিংবা অসম্ভব। কারণ পুরো নির্বাচন পরিচালনার জন্য নিজস্ব লোকবল নির্বাচন কমিশনের নেই। নির্বাচন অনুষ্ঠানে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং প্রশাসনের ওপর পুরোমাত্রায় নির্ভর করতে হয় কমিশনকে। রাজনৈতিক দলগুলোর সহায়তাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ। কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের ভবিষ্যৎ আচরণ কেমন হবে- সেটা সময়ই বলবে। কিন্তু এটা বলতে হবে, বিগত দুই জন প্রধান নির্বাচন কমিশনারের চেয়ে তার মুখের ভাষা আলাদা। এরইমধ্যে তিনি ইঙ্গিত দিয়েছেন, আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি যদি একমত হয়, প্রধান নির্বাচন কমিশনারের পদ থেকে চলে যেতেও তার কোনো আপত্তি নেই। অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের অনিবার্য প্রয়োজনীয়তার কথা তিনি স্বীকার করেছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন না হলে কি তিনি থাকবেন?

প্রধান নির্বাচন কমিশনার অবশ্য সংকট সমাধানের পথও বাতলে দিয়েছেন। তিনি মনে করেন, আওয়ামী লীগ-বিএনপি’র ৫-৭টি বৈঠকেই সমাধান সম্ভব। তবে অনেক পর্যবেক্ষকই মনে করেন, বিষয়টি এতো সহজ নয়। আবদুল মান্নান ভূঁইয়া-আবদুল জলিলের সংলাপের কথা নিশ্চয় আমরা এখনো ভুলে যাইনি। দুই জনই আজ প্রয়াত। নবীন এক রিপোর্টার হিসেবে সেই সংলাপ কাভারের সুযোগ হয়েছিল। প্রথম দিনের বৈঠক শেষে আবদুল মান্নান ভূঁইয়ার বলা সেই বিখ্যাত উক্তি, ‘সকল বিষয়ে আলোচনা হয়েছে’ এখনো কানে বাজে। সেই সংলাপ শেষ পর্যন্ত সফল হয়নি। তবে তা সফল হলে হয়তো বিখ্যাত ওয়ান ইলেভেন আসতো না। তারপর বিগত দুটি নির্বাচন ঘিরেও পর্দার আড়ালে এবং প্রকাশ্যে অনেক সংলাপ হয়েছে। কিন্তু কাক্সিক্ষত সফলতা আসেনি। রাজনৈতিক সংকট নিরসনে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে প্রয়োজন চুক্তি। জনগণই যে সকল ক্ষমতার উৎস তা কবুল করতে হবে। কিন্তু কারা ক্ষমতায় থাকবে সে প্রশ্নই যেখানে মুখ্য সেখানে এ ধরনের সমঝোতা কঠিন। বিগত সংসদ নির্বাচন ঘিরেও আওয়ামী লীগ-বিএনপি’র মধ্যে এক ধরনের সমঝোতা ছিল বলে কোনো কোনো সূত্র দাবি করে। কিন্তু ভোটের রাতে সে সমঝোতা আর বহাল থাকেনি। পরিস্থিতি সম্ভবত, ক্ষমতাসীন দলের নেতৃত্বের নিয়ন্ত্রণেও থাকেনি।

সংলাপ নিয়ে যখন চাপান উতোর চলছে তখন নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ দাবি করেছেন, এমন দুটি বৈঠক হয়েছে। একটি অনলাইন টকশোতে অসমর্থিত সূত্রের বরাতে তিনি বলেন, ‘ব্যাংকক এবং লন্ডনে এসব বৈঠক হয়েছে। তবে কোনো ধরনের ব্রেক থ্রু আসেনি।’ এই লেখক এ ধরনের কোনো বৈঠকের ব্যাপারে নিশ্চিত হতে পারেননি। তবে একটি সূত্র প্রভাবশালী এক রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে দেশের প্রধান তিনটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের একটি বৈঠক হয়েছে বলে খবর দিয়েছে। ওই সূত্র বৈঠকের বিস্তারিত জানাতে পারেনি। তবে এটা বলেছে, মূলত ওই দূত রাজনৈতিক নেতাদের কাছে আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে বিস্তারিত জানতে চেয়েছেন। খোলামেলা আলোচনায় পরিস্থিতি বুঝার চেষ্টা করেছেন তিনি। বৈঠকে উপস্থিত কোনো পক্ষই এ ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক কিছু জানায়নি। 

আন্তর্জাতিক শক্তির বোঝাপড়া: এসএনএম আবদির বিশ্লেষণ
পাঠক স্মরণ করতে পারেন ২০১৪ সালে বাংলাদেশে সংসদ নির্বাচনের আগে ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত ড্যান মজিনা দিল্লি ছুটে গিয়েছিলেন।  তার সে সফরে কী হয়েছিল তা এখনো প্রকাশ্যে আসেনি। তবে অনুমান করা যায়। সম্প্রতি ন্যাশনাল হেরাল্ডে ভারতের খ্যাতিমান সাংবাদিক এসএনএম আবদি বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে একটি বিশ্লেষণ লিখেছেন। বাংলাদেশ নিয়ে পশ্চিমা এবং ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার গণমাধ্যমে প্রায়শই নানা নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। তবে এসএনএম আবদির কলামটিতে বাংলাদেশের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর অবস্থান একেবারেই খোলাসা করা হয়েছে।
বিগত দুটি সংসদ নির্বাচনেও আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর অবস্থান স্পষ্ট ছিল। এটি মোটাদাগে তিন ভাগে বিভক্ত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ পশ্চিমা দেশগুলো অন্তত মুখে বরাবরই অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের পক্ষে নিজেদের অবস্থান স্পষ্ট করেছে। চীন এবং ভারতের অবস্থান ছিল আলাদা। 

প্রতিবেশী দেশগুলোর ব্যাপারে দিল্লির নীতি কি? এ ব্যাপারে এসএনএম আবদি লিখেছেন, ভারত আজ আমেরিকার কট্টর মিত্র। ভারত চায় না যে, দক্ষিণ এশিয়ার  কোনো দেশ, বিশেষ করে বাংলাদেশ ও  নেপাল আমেরিকার ঘনিষ্ঠ হোক, তারা চায় না যে, ওয়াশিংটন এ অঞ্চলে ভারতের চেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করুক। মালদ্বীপ হলো একমাত্র দক্ষিণ এশীয় দেশ যাকে ওয়াশিংটনের কাছাকাছি যেতে সম্মতি দিয়েছে ভারত। আবদি বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাপানের রাষ্ট্রদূতের সাম্প্রতিক মন্তব্য উল্লেখ করেন। যেখানে তারা অবাধ এবং স্বচ্ছ নির্বাচনের ওপর জোর দেন। তিনি আরও লিখেছেন, ২০১৮ সালের নির্বাচনে, আওয়ামী লীগ  নেতৃত্বাধীন জোট ৯৬% ভোট পেয়েছিল! এবং ২৯৮ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ২৮৮ আসনে জয়ী হয়। যেকোনো বিবেচনায় নির্বাচন ছিল কারচুপির। নয়াদিল্লি জানতো  যে, নির্বাচনে জয়ী হতে অন্যায় উপায় অবলম্বন করা হবে কিন্তু অসদাচরণের মাত্রা এবং বিজয়ের ব্যবধান দেখে তারা বিস্মিত হয়েছিল। আবদি আরও লিখেছেন, আওয়ামী লীগ ছাড়া বাংলাদেশের কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত হতে ভারত অস্বীকার করেছে। আবদির এ লেখায় বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন ঘিরে আন্তর্জাতিক শক্তিগুলোর অবস্থানের স্পষ্ট ইঙ্গিত মেলে।
 

 

জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস?
প্রধান নির্বাচন কমিশনারসহ বাংলাদেশের অনেক বিশিষ্টজনও প্রায়শই বিরোধী শক্তিকে পরামর্শ দেন, ভোটকেন্দ্রে শক্ত অবস্থান নেয়ার। বলা হয়, বিরোধী দলের এজেন্ট থাকে না তো কিসের ভোট! এখন প্রশ্ন হচ্ছে, শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকলে কী জনগণের ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষমতা রহিত হয়ে যায়। সংবিধান বা আইনে কি এ ধরনের কোনো কথা রয়েছে। এটা সত্য, একটি আসনে একজন মাত্র প্রার্থী থাকলে সেখানে আর ভোটের প্রয়োজন হয় না। আইনই ওই প্রার্থীকে বিজয়ী ঘোষণার কথা বলেছে। যদিও সেটা গণতন্ত্রের চেতনাবিরুদ্ধ। কিন্তু দুই জন প্রার্থী থাকলে? সেখানে তো প্রত্যেক প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের অবাধে ভোট দেয়ার সুযোগ থাকতে হবে। সংবিধান তো এমনি এমনি বলেনি, জনগণই সকল ক্ষমতার উৎস।

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status