দেশ বিদেশ
সরজমিন তেজগাঁও থানা
মামলা, জিডি কম টহল টিমের দেখা পান না স্থানীয়রা
শুভ্র দেব
৪ অক্টোবর ২০২৪, শুক্রবারদুপুর আড়াইটা। ঢাকা মহানগর পুলিশের তেজগাঁও থানা। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে বসে আছেন ডিউটি অফিসার হাবিব। তার পাশে এএসআই মোজাহিদ। তাদের দু’জনকে সহযোগিতা করছিলেন ইউনিফর্মবিহীন এক ব্যক্তি। ভেতরে বসার জন্য সোফার ব্যবস্থা রয়েছে। সেখানে ১০ থেকে ১২ জন নারী-পুরুষের জটলা। প্রায় প্রতিটি আসনই পূর্ণ। ডিউটি অফিসারের সামনে কয়েকজন নারী-পুরুষ দাঁড়িয়ে বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে কথাবার্তা বলছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন জুরাইনের বাসিন্দা রহিমা ইসলাম। ডিউটি অফিসারের সঙ্গে কথা বলে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারছিলেন না। তাই ডিউটি অফিসার রহিমাকে ইউনিফর্মবিহীন ওই ব্যক্তির কাছে পাঠান। ওই ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে কিছুটা রাগান্বিত হন রহিমা। কথা বলে জানা যায় তিনি একটি বিষয়ে জিডি করতে থানায় এসেছেন। কাওরান বাজার কাব্যকস মার্কেটের এক ট্র্যাভেল এজেন্সির এক ব্যক্তির মাধ্যমে ছেলেকে বিদেশে পাঠানোর চুক্তি করেন। ৮ লাখ টাকাও দিয়েছিলেন। কিন্তু ওই ব্যবসায়ী তার ছেলেকে ভুয়া ভিসা দেন। ধরা পড়ার পর থেকে তিনি তার সঙ্গে একাধিকবার যোগাযোগ করেও কোনো ফল পাচ্ছেন না। তাই তিনি জিডি করতে থানায় এসেছেন। রহিমা বলেন, থানায় আসার পর আমি নিজেকে একজন উপদেষ্টার আত্মীয় পরিচয় দিয়েছি। কিন্তু এ কথা বলার পরও তাদের কোনো ভ্রুক্ষেপ নাই। আমি বললাম আমি কখনো লিখি নাই, কীভাবে লিখতে হয় জানি না। তাই তাদের সাহায্য চাইলাম। কিন্তু একজন আমাকে বললেন, নিজে লেখার জন্য। সুযোগ করে একটু সময় দেয়ার অনুরোধ করলাম। কিন্তু তিনি দিলেন না। আমি বললাম, একটু অপেক্ষা করবো কিনা। তিনি বললেন, এটা আমার ইচ্ছা। পরে নিজে নিজেই ফিলাপ করেছি। প্রথম দিকে তাদের ব্যবহার আমার ভালো লাগেনি। তবে রহিমা সন্তুষ্টি না হলেও তেজতুরী বাজারের রয়েল ফুটওয়্যার লিমিটেডের কর্মী নাজিম বলেন, জিডি করতে এসে তিনি পুলিশের ব্যবহারে সন্তুষ্ট। সরজমিন তেজগাঁও থানার পরিবেশ দেখলে মনে হবে সেখানে খুব কর্মযজ্ঞ চলছে। কিন্তু নথিপত্রে কাজকর্মের তেমন কোনো রেকর্ড নাই। কারণ গতকাল সকাল ৮টা থেকে বিকাল সাড়ে ৩টা পর্যন্ত থানায় জিডি হয়েছে মাত্র ৫টা। এদিন কোনো মামলা হয়নি।
তেজগাঁও থানার বিভিন্ন এলাকার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ৫ই আগস্টের আগ পর্যন্ত বিভিন্ন অলিগলি, বাজারে, গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার আশপাশে পুলিশের যে রকম আনাগোনা ছিল এখন আর সে রকম দেখা যায় না। রাতে দিনে তেজগাঁও থানার ৭টি বিট এলাকায় পুলিশের টহল টিম থাকতো। কিন্তু ইদানিং সেটি দেখা যায় না। তেজগাঁও এলাকার ব্যস্ততম ফার্মগেট, কাওরান বাজার এলাকাতেও টহল টিমের উপস্থিতিও নাই। অথচ কাওরান বাজার সিগন্যালে দাঁড়িয়ে থাকা বাস ও প্রাইভেট গাড়ি থেকে অহরহ ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। পুলিশের উপস্থিতি না থাকাতে ছিনতাইকারীরা দেদারসে ছিনতাই করছে। এমনকি থানায় গেলেও পুলিশের কাজকর্মে আন্তরিকতার ঘাটতি আছে। বেশির ভাগ সময় পুলিশ থানায় সময় কাটাচ্ছে। বাইরে সময় কম দিচ্ছে। এলাকার ছিনতাইকারী, চোর, মাদক ব্যবসায়ী, খুনের আসামি প্রকাশ্য ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাদের ধরছে না। এতে করে দিনের পর দিন তেজগাঁও এলাকা আরও অপরাধপ্রবণ হয়ে যাচ্ছে। রাতেরবেলা রাস্তাঘাটে চলাফেরা করা অনেকে নিরাপদ মনে করছেন না।
সূত্রগুলো বলছে, সরকার পতনের আগ পর্যন্ত তেজগাঁও থানা এলাকার বিভিন্ন খাত থেকে দিনে দেড় কোটি টাকার মতো ঘুষ উঠতো। এসব টাকা পুলিশ, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা উঠাতেন। পরে এসব টাকা ভাগবাটোয়ারা করে সবাই নিতেন। কিছু কিছু স্থান থেকে পুলিশ আলাদাভাবে চাঁদা উঠাতো। কিন্তু সরকার পতনের পর থেকে পুলিশ আর চাঁদা উঠাতে পারছে না। অবৈধ আয় না থাকাতে পুলিশের কাজকর্মে আগ্রহ কম বলেও ধারণা করছেন অনেকে। কাওরান বাজার এলাকার ব্যবসায়ী আলমগীর হোসেন বলেন, আগে কাওরান বাজার প্রধান সড়কে বিভিন্ন ধরনের অপরাধ কর্মকাণ্ড হওয়ার কারণে তেজগাঁও থানা পুলিশ সার্বক্ষণিক টহল দিতো। কিন্তু সরকার পতনের পর আর এমন কিছুই দেখা যায় না। মাঝেমধ্যে দেখা গেলেও সেটি খুব কম। হুমায়ুন কবীর নামের আরেক সবজি ব্যবসায়ী বলেন, আগে পুলিশ এবং পুলিশের সোর্স এসে চাঁদা নিয়ে যেতো। এখন পুলিশের পক্ষ থেকে কেউ চাঁদা নিতে আসে না। তেজতুরী বাজার এলাকার বাসিন্দা, হোসেন মিয়া বলেন, এলাকায় ছোটখাটো অনেক অপরাধমূলক ঘটনা ঘটে। কিন্তু পুলিশের আনাগোনা নাই।
তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোবারক হোসেন মানবজমিনকে বলেন, টহল টিম আছে। তবে আরও বাড়িয়ে দেয়া হবে। থানার অধিকাংশ অফিসার বদলি। ২০ জন বদলি হলে আসতেছে ৩ জন। অপরাধ কম হওয়াতে মামলা কম হচ্ছে। তবে বিভিন্ন সমস্যার কারণে জিডি হচ্ছে। আমরা বিভিন্ন অপরাধের জন্য আসামি গ্রেপ্তার করছি। মাঠে পুলিশকে কম দেখা যাচ্ছে কেন? এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আগে তো তেজগাঁও থানা এলাকা থেকে বড় অঙ্কের চাঁদা উঠানো হতো। জনশ্রুতি আছে দিনে দেড় কোটি টাকা। অনেক অসাধু পুলিশ এটার সঙ্গে জড়িত ছিল। কিন্তু এখন আর কোনো চাঁদাবাজি নাই। তাই এখন পুলিশকেও কম দেখা যায়।