মত-মতান্তর
বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট এখন লোকসানে
ড. ইলিয়াছ প্রামাণিক
২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, সোমবার২০০৪ সালের দিকে আমি যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ি তখন আমাদের তৃতীয় বর্ষে একটা তিন ক্রেডিটের কোর্স ছিল নাম স্যাটেলাইট কমিউনিকেশন। তখনকার সময়ে বাংলাদেশে এটি ছিল একটা নতুন ও অত্যাধুনিক কোর্স। আমাদের শিক্ষকও এই কোর্সে অভিজ্ঞ ছিলেন না, কারণ তিনি নিজে কখনো এমন কোর্স পড়েননি। তিনি নিজে পড়ে এসে আমাদের শেখাতেন এবং আমরা মূলত তাত্ত্বিক ভিত্তিতে কোর্সটি অধ্যয়ন করতাম, কারণ তখন বাংলাদেশের কোনো নিজস্ব স্যাটেলাইট ছিল না। এই কোর্সের অন্তর্ভুক্তির উদ্দেশ্য ছিল ভবিষ্যতে বাংলাদেশ নিজস্ব স্যাটেলাইট তৈরি করবে এবং আমাদের মতো শিক্ষার্থীরা সেই প্রকল্পে অবদান রাখবে। তবে, ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ৫৭তম দেশ হিসেবে নিজের স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করলেও, কোনো স্থানীয় বিজ্ঞানী বা গবেষক সেই প্রকল্পে অবদান রাখার সুযোগ পায়নি।
আমরা তখন ভেবেছিলাম বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটি বাণিজ্যিক বিবেচনায় উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। দেশ এখান থেকে মুনাফা অর্জন করবে। তাই হয়েও আসছিল বাংলাদেশ স্যাটেলাইট কোম্পানি লিমিটেড (বিএসসিএল) সর্বশেষ নিরীক্ষা প্রতিবেদনে (২০২১-২২) কোম্পানিটির মুনাফা ৮৫ কোটি টাকা দেখিয়েছিল। কিন্তু এখন দেখছি ওখানে একটা শুভঙ্করের ফাঁকি ছিল। ওই প্রতিবেদনে তারা স্যাটেলাইটের অবচয় বা ডেপ্রিসিয়েশন আমলে নেয়নি। অবচয় ধরা হলে মুনাফার বদলে লোকসান দাঁড়ায় প্রায় ৬৬ কোটি টাকা। আগের অর্থবছরেও প্রায় সমপরিমাণ লোকসান ছিল। এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে যে বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইটি থেকে দেশের কী লাভ হলো? না হলো গবেষণা না হলো বাণিজ্য। এই প্রকল্পটির সম্ভাব্যতা, কার্যকারিতা, এবং বাজার বিশ্লেষণ যথাযথভাবে সম্পন্ন করা হয়নি, ফলস্বরূপ দেশ এই প্রকল্প থেকে কোনো উপকার পায়নি। বরং, প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছে। প্রকল্পটির ক্ষেত্রে আর্থিক মূল্যায়ন ও প্রকল্প সম্পর্কিত প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও গবেষণা অত্যন্ত জরুরি ছিল।
ভারত ১৯৭৫ সালে বিদেশি উৎক্ষেপক ব্যবহার করে প্রথম জাতীয় উপগ্রহ আর্যভট্ট উৎক্ষেপণ করে। এই উপগ্রহটি ইন্ডিয়ান স্পেস রিসার্চ অর্গানাইজেশন (ওঝজঙ) নিজেই তৈরি করেছিল। তবে, উৎক্ষেপণের জন্য তারা সোভিয়েত ইউনিয়নের কসমস৩ এম রকেট ব্যবহার করে। ১৬ই জুলাই, ১৯৯০ সালে পাকিস্তান ্তুইধফৎ-অ্থ উপগ্রহটি সোভিয়েত ইউনিয়নের রকেট থেকে উৎক্ষেপণ করে। ‘ইধফৎ-অ’ উপগ্রহটি পাকিস্তানের মহাকাশ গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা (ঝটচঅজঈঙ) দ্বারা তৈরি করা হয়েছিল। আবার চীন ১৯৭০ সালে নিজস্ব উৎক্ষেপক ব্যবহার করে তাদের প্রথম উপগ্রহ ডং ফ্যাং হং ১ সফলভাবে উৎক্ষেপণ করে। উপগ্রহটি তৈরি করেছিল চীনের মহাকাশ সংস্থা চায়না একাডেমি অফ স্পেস টেকনোলজি (ঈঅঝঞ), যা চীনের প্রথম মহাকাশ গবেষণা ও প্রযুক্তি উন্নয়ন সংস্থা। উৎক্ষেপণ করা হয়েছিল চীনের নিজস্ব উৎক্ষেপক লং মার্চ-১ রকেটের মাধ্যমে। লং মার্চ উৎক্ষেপক সিরিজটি তৈরি এবং পরিচালনা করে চায়না ন্যাশনাল স্পেস অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, যা চীনের সরকার পরিচালিত মহাকাশ সংস্থা। এদিকে বাংলাদেশ ২০১৮ সালে বিদেশি উৎক্ষেপক ব্যবহার করে প্রথম উপগ্রহ বঙ্গবন্ধু-১ উৎক্ষেপণ করে। এই উপগ্রহটি তৈরি করেছিল ফ্রান্সের থ্যালেস অ্যালেনিয়া স্পেস কোম্পানি এবং উৎক্ষেপণ করেছিল স্পেসএক্স কোম্পানির ফ্যালকন ৯ রকেটের মাধ্যমে, যা একটি বেসরকারি মার্কিন মহাকাশ সংস্থা। চীন নিজস্ব প্রযুক্তি ও গবেষকদের ব্যবহার করে উৎক্ষেপক ও উপগ্রহ উভয়ই তৈরি করেছিল। ভারত প্রথম জাতীয় উপগ্রহ উৎক্ষেপণের সময় বিদেশি উৎক্ষেপক ব্যবহার করলেও, উপগ্রহ ‘আর্যভট্ট’ সম্পূর্ণভাবে নিজেদের প্রযুক্তি ও দেশীয় গবেষকদের মাধ্যমে তৈরি করেছিল। তবে ১৯৮০ সালের ১৮ই জুলাই, ভারত সফলভাবে নিজস্ব উৎক্ষেপক (ঝখঠ-৩) ব্যবহার করে রোহিণী (জঝ-১) উপগ্রহটি উৎক্ষেপণ করে। পাকিস্তানও নিজস্ব প্রযুক্তিতে তৈরি উপগ্রহ (্তুইধফৎ-অ্থ) উৎক্ষেপণ করে। কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে নিজস্ব উৎক্ষেপক ও উপগ্রহ কোনোটিই ছিল না। ফলে বাংলাদেশের দেশীয় প্রযুক্তি ও গবেষকদের কোনো অবদানই ছিল না বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট প্রকল্পে। জাতীয় নিরাপত্তার দিক থেকে অন্যের তৈরি উপগ্রহ ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে, কারণ উপগ্রহ প্রস্তুতকারী সংস্থা উৎক্ষেপণ প্রক্রিয়া ও ডেটার পুরো বিষয় সম্পর্কে অবগত থাকে, যা গোপনীয়তা ও নিরাপত্তার জন্য বড় হুমকি সৃষ্টি করতে পারে। যেহেতু বাংলাদেশের উপগ্রহটি বিদেশি কোম্পানি দ্বারা নির্মিত, তাই আমাদের জাতীয় তথ্য নিরাপত্তা নিয়েও উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। এ বিষয়ে ভারত,পাকিস্তান বা চীন কোনো রাষ্ট্রই আপস করেনি, অথচ বাংলাদেশ এই বিষয়টিকে সঠিক গুরুত্ব দেয়নি।
এখন সরকারের যদি দ্বিতীয় উপগ্রহ উৎক্ষেপণের পরিকল্পনা থাকে তবে আগের প্রকল্পটির ভুলগুলো থেকে সঠিক শিক্ষা নিতে হবে। বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট প্রকল্পের বাস্তবায়ন থেকে প্রাপ্ত শিক্ষাগুলো গভীরভাবে মূল্যায়ন করতে হবে, বিশেষ করে জাতীয় নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক ক্ষতির বিষয়ে। দ্বিতীয় উপগ্রহ উৎক্ষেপণ প্রকল্পের আর্থিক বিশ্লেষণে যদি নিজস্ব উৎক্ষেপক তৈরি করা সম্ভব নাও হয়, অন্তত নিজস্ব প্রযুক্তি ও গবেষক ব্যবহার করে যেন উপগ্রহটি তৈরি করা হয়। এ ধরনের প্রকল্প পরিকল্পনায় সফলতার জন্য, সরকারের উচিত দেশীয় গবেষণা ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দেয়া, বিদেশি প্রযুক্তি ও বিশেষজ্ঞদের সহায়তা প্রদান করা এবং দেশের বিজ্ঞানী, নিরাপত্তা বিশ্লেষক ও গবেষকদের সম্পৃক্ত করা। এই ধরনের কৌশলগত পদক্ষেপ বাংলাদেশের মহাকাশ প্রযুক্তি খাতকে একটি নতুন দিগন্তে নিয়ে যেতে সক্ষম হবে, যা শুধুমাত্র জাতীয় স্বার্থে নয়, আন্তর্জাতিক পর্যায়েও দেশকে আরও শক্তিশালী ও সম্মানজনক অবস্থানে নিয়ে আসবে।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ
বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর।
[email protected]
এমন কোন প্রজেট নাই যেখানে তারা লুটপাঠ করে নাই তাদের এমন বিচার চাই যাতে আর কোন প্রজন্ম এমন দূর্নিতী না করতে পারে।
এটা কি কখনো লাভে ছিল?
আপনার কথা থেকে বুঝলাম স্যাটেলাইট নিজে তৈরি করা বা গবেষণা করা কতটা গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু স্যার সেই গবেষণাটা করবে কে? সবাই গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে বিদেশে চলে যায় অথবা বিশ্ববিদ্যালয় পড়া অবস্থায় বিসিএস প্রিপারেশন নেয়। বুয়েট থেকে বের হয়ে প্রশাসন ক্যাডারে চাকরি করে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়া মানেই সবার ধান্দা টাকা উপার্জন বা চাকরি করা। তাহলে গবেষণা করবে কে ??
উদ্দেশ্য একটাই ছিল তা হলো "মেগা" টাকা পাচার করা।