ঢাকা, ১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার, ৬ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৯ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

চলতি পথে

৯৭তম জন্মবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা- যুদ্ধদিনের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ

শুভ কিবরিয়া
২৩ জুলাই ২০২২, শনিবার
mzamin


‘সংবিধান’ নামক বইয়ের মধ্যে কতগুলো সুন্দর, প্রাঞ্জল ভাষা, কতগুলো সুন্দর সুন্দর শব্দের বিন্যাস ঘটালেই তার উপর নির্ভর করে না সংবিধানের উৎকর্ষ। তা নির্ভর করে এর প্রয়োগের ওপর। সেই প্রয়োগ যদি সাচ্চা জনপ্রতিনিধিদের হাতে থাকে, তাহলে অপপ্রয়োগ কোনোদিন হবে না। আর এদেশের মানুষকে সচেতন রেখে যদি তাদের সাচ্চা প্রতিনিধি আমরা দিতে ব্যর্থ হই, তাহলে কোনোদিনই যতো সুন্দর সুন্দর ভাষা দিয়েই সংবিধান রচনা করা হোক না কেন, সেই সংবিধানের সুফল কেউই ভোগ করতে পারবে না।

 


তাজউদ্দীন আহমদ (১৯২৫-১৯৭৫), বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধদিনের প্রধানমন্ত্রী। যুদ্ধোত্তর স্বাধীন বাংলাদেশেরও প্রথম প্রধানমন্ত্রী। মুক্তিযুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে ফিরে সরকারের হাল তিনিই ধরেছিলেন প্রধানমন্ত্রীরূপে। এরপর ১০ই জানুয়ারি ১৯৭২ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে এসে যখন প্রধানমন্ত্রী হলেন তখন সেই সরকারের অর্থ ও পরিকল্পনামন্ত্রীর দায়িত্ব বর্তায় তাজউদ্দীন আহমদের কাঁধে। তাজউদ্দীন আহমদকে হত্যা করা হয় জেলখানার অভ্যন্তরে ৩রা নভেম্বর ১৯৭৫ সালে। কাজেই তার জীবন দীর্ঘায়ু হয়নি। মাত্র ৫০ বছর বয়সেই তার জীবনের অবসান ঘটে।

বিজ্ঞাপন
বলা যায়, এই স্বল্পায়ু জীবনেই এক মহত্তর কাজের সুযোগ পেয়েছিলেন এবং তার পূর্ণ সদ্ব্যবহার করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ২০শে মার্চ বিশ্ববিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন মুক্তিযুদ্ধরত বাংলাদেশকে নিয়ে এক প্রচ্ছদ কাহিনী রচনা করে। সেখানে তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে লেখা হয়...

Tajuddin Ahmad, 46, Prime Minister, a lawyer who has been a chief organiæer in Awami League since its founding in 1949. He is an expert in economics and is consider one of the partys leading intellectuals.

 

 

মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর শারীরিক অনুপস্থিতিতে যে সরকার তার নামেই পরিচালিত হয়েছে, প্রবাসে অবস্থিত বাংলাদেশের সেই প্রথম সরকারের প্রধানমন্ত্রীরূপে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব  দিতে হয় তাজউদ্দীন আহমদকে। এটা পূর্ব নির্ধারিত কোনো বিষয় ছিল না। ইতিহাস তাকে এই দায়িত্ব দিয়েছিল ঘটনার প্রয়োজনেই। নয় মাসব্যাপী সেই অভূতপূর্ব সংগ্রামের বহুমাত্রিক লড়াইকে সংহত ও লক্ষ্যভেদী করে এক অসামান্য অর্জন তিনি সম্ভব করেছিলেন। শুধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনই নয়, স্বাধীন দেশে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে জীবিত অবস্থায় ফিরিয়ে আনার মতো কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক বিজয়ের পুরোভাগেও ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ এবং তার তৎকালীন সহকর্মীরা। 
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ অর্থমন্ত্রী হিসেবেও ছিলেন অত্যন্ত সফল। দেশের অর্থনীতি, মুদ্রা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক স্থাপন, ব্যাংক, বীমা ইত্যাদি প্রতিষ্ঠান পুনর্গঠন এবং বৈদেশিক অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলায় তার বিশেষ অবদান ছিল। বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন তিনি। 

মাত্র ৪৬ বছর বয়সে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাফল্যের সঙ্গে নেতৃত্ব দেয়া এ মানুষটির জীবন থেমে যায় স্বাধীন দেশে জেলখানার অভ্যন্তরে হত্যাকারীদের নির্মম বুলেটে।
তার সম্পর্কে প্রয়াত সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী ‘ইতিহাসের রক্তপলাশ, পনেরোই আগস্ট পঁচাত্তর’ বইয়ে লিখেছেন, ‘স্বাধীনতা আন্দোলনের আগে যখনই আওয়ামী লীগের পুরানা পল্টনের কেন্দ্রীয় অফিসে (১৫ পুরানা পল্টন) গেছি, তখনই দেখেছি তাজউদ্দীন আহমদকে হয় শেখ মুজিবের বিবৃতি অথবা দলীয় সভায় তোলার জন্য প্রস্তাবের খসড়া তৈরিতে ব্যস্ত থাকতে। ফর্সা, গোলগাল চেহারা, বুদ্ধিদীপ্ত চোখমুখ। বেশি মানুষের ভিড়ে লাজুক এ শিক্ষিত ও মার্জিত রুচির মানুষটি প্রখর ব্যক্তিত্বশালী নেতা ছিলেন না। কিন্তু তার শিক্ষা, বুদ্ধি, সংগঠনিক শক্তির সঙ্গে শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্ব, সাহস, জনপ্রিয়তার মিশ্রণে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের একমাত্র জাতীয় দলে পরিণত হয়। আমি তাজউদ্দীনকে ঠাট্টা করে ডাকতাম চৌ অব বেঙ্গল। অর্থাৎ বাংলাদেশের চৌ এন লাই। চৌ এন লাইকে আমি ১৯৫৬ সালে ঢাকায় দেখেছি। তাজউদ্দীনও চৌ-এর মতো ছোটখাটো। তবে অতো পাতলা নন। কিন্তু রাজনীতিতে দু’জনই স্বল্পভাষী ও নেপথ্যবিহারী মানুষ। তাজউদ্দীন অবশ্য বৈঠকি বক্তা হিসেবে অদ্বিতীয়। তখন তার কথা থামানো যেতো না।’

১৯৫৪ সালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য হয়েছেন নির্বাচনে মুসলিম লীগের হেভিওয়েট প্রার্থীকে হারিয়ে। সেই খবর পুরনো। কিন্তু নতুন যা, তা হচ্ছে ২৯ বছর বয়সে সংসদ সদস্য হওয়ার বছর খানেক পরে তার এক বন্ধুকে চিঠিতে বলেছেন তার নিজের সম্পর্কে। ১৭ই ফেব্রুয়ারি ১৯৫৫ কারকুনবাড়ি লেন, ঢাকা থেকে তিনি সেই বন্ধুকে লিখেছেন, ‘প্রিয় মালেক সাহেব,  আমার সঙ্গে দীর্ঘদিনের ওঠাবসা থেকে আশা করি আমার সম্পর্কে আপনার অন্তত এটুকু ধারণা হয়েছে যে, আমি যেকোনো ধরনের তোষামোদকে ঘৃণা করি, একইসঙ্গে আমার শত্রুও যদি প্রশংসা বা কৃতিত্বের দাবিদার হয়, তাকেও তার প্রাপ্য দিতে কার্পণ্য করি না।’

স্বাধীন দেশের গোড়াপত্তন শেষে যখন সংবিধান রচনার কাজে হাত দেন তখন তাজউদ্দীন আহমদের রাষ্ট্রনৈতিক বিবেচনার কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল ‘মানুষ’। তিনি ভাবতেন মানুষ না তৈরি হলে দেশ বা রাষ্ট্র কোনোটাই দাঁড়াবে না। সেই বিবেচনা থেকে সংবিধান বিষয়ক সংসদীয় আলোচনায় তার মতামত খুব স্পষ্ট করে উচ্চারণ করেছিলেন। বাংলাদেশ গণপরিষদের দ্বিতীয় অধিবেশনের দ্বাদশ বৈঠকে, ৩০শে অক্টোবর ১৯৭২ সোমবার, সংবিধান বিলের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে তৎকালীন অর্থ ও পরিকল্পনা প্রণয়নমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেছেন, ‘সংবিধান’ নামক বইয়ের মধ্যে কতগুলো সুন্দর, প্রাঞ্জল ভাষা, কতগুলো সুন্দর সুন্দর শব্দের বিন্যাস ঘটালেই তার উপর নির্ভর করে না সংবিধানের উৎকর্ষ। তা নির্ভর করে এর প্রয়োগের ওপর। সেই প্রয়োগ যদি সাচ্চা জনপ্রতিনিধিদের হাতে থাকে, তাহলে অপপ্রয়োগ কোনোদিন হবে না। আর এদেশের মানুষকে সচেতন রেখে যদি তাদের সাচ্চা প্রতিনিধি আমরা দিতে ব্যর্থ হই, তাহলে কোনোদিনই যতো সুন্দর সুন্দর ভাষা দিয়েই সংবিধান রচনা করা হোক না কেন, সেই সংবিধানের সুফল কেউই ভোগ করতে পারবে না।’ তাজউদ্দীন আহমদের সংশয় ছিল, যে রক্তস্নাত মুক্তিযুদ্ধের রাজনীতির ওপর দাঁড়িয়ে মানুষের মুক্তির কথা তারা ভাবছেন, সেই মানুষ যদি আদর্শচ্যুত হয়, তাহলে কাক্সিক্ষত স্বপ্ন অর্জন করা সম্ভব হবে না। যে রাজনৈতিক দল বা নেতাদের ওপর মানুষের ভরসা, তারাও যদি আদর্শবান পথে থাকতে না পারেন সেটাও কাক্সিক্ষত রাষ্ট্র গঠনের সহায়ক হবে না।

যেকোনো আদর্শবাদী, নিষ্ঠাবান, সৎ, ব্রতী মানুষের পরিণতি যা হয়, তাজউদ্দীন আহমদও সেই পরিণতির পথেই হেঁটেছেন। কিন্তু লড়াই থামাননি। ১৯৭৩ সালের ৫ই জুলাই বাজেট বিতর্কের সমাপনী বক্তৃতায় অর্থ ও পাট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জাতীয় সংসদে বলেছেন, ‘আমার দেশের উন্নয়ন আমি করবো। সে ব্যয় আমাকে বহন করার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। সেই ব্যয়কে একটা কষ্টিপাথরে যাচাই করতে হবে যে, এই ব্যয়ে দেশের উপকার হবে কী হবে না। এই ব্যয় এইজন্য করতে চাই যে, এই ব্যয়ের ফলে এ দেশের সাধারণ মানুষের কল্যাণ হবে।’ চারপাশের অবনতিশীল পরিস্থিতি তার দৃষ্টি কেড়েছিল। তাই হয়তো ওই একই বক্তৃতায় আক্ষেপ নিয়েই বলেছিলেন, ‘আমরা যদি গাব গাছ লাগিয়ে ফজলি আম চাই, তাহলে আমাদের উদ্দেশ্য সফল হবে না। ফজলি আম পেতে হলে আমাদের ফজলি আমের চারা লাগাতে হবে।’

২৩শে জুলাই ১৯২৫ সালে বর্তমান গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার দরদরিয়া গ্রামে জন্মেছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ। জন্মদিনে তাকে অপার শ্রদ্ধা জানিয়ে লেখাটি শেষ করতে চাই বাংলাদেশের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনে সদস্য হিসেবে কাজ করা সমাজ-দার্শনিক, অর্থনীতির শিক্ষক অধ্যাপক আনিসুর রহমানের জীবন কথা ‘পথে যা পেয়েছি-দ্বিতীয় পর্ব’-এর একটি উদ্ধৃতি দিয়ে।

আনিসুর রহমানের ভাষ্য হচ্ছে, ‘এ জাতির সামন্ত-নেতৃত্বের ব্যতিক্রম হিসেবে বোধহয় একমাত্র তাজউদ্দীনকেই বলা যায়, যিনি মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেবার সময়েও যেমন তার নিজের পরিবারবর্গকে দূরে সরে থাকতে বলেছিলেন, তার ছায়ায় কাউকে কোনোরকম দুর্নীতি-সন্ত্রাস করতে প্রশয় দেননি, স্বাধীনতার পরেও সমতাবাদী-সমাজতান্ত্রিক পথে দেশকে নিতে চেয়েছিলেন, দেশের জনগণের আত্মশক্তিচালিত উন্নয়ন চেয়েছিলেন বিদেশি সাহায্যের জন্য অপেক্ষা না করে, বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের বিপক্ষে কোনো বিদেশি শক্তির কাছ থেকে কোনো সাহায্য নিয়ে জাতিকে অসম্মান করবেন না এই অঙ্গীকার করে। এ রকম নীতিবোধ এবং জনগণের আত্মসম্মান ও আত্মশক্তির ওপর সম্পূর্ণ আস্থা এ জাতির নেতৃত্বের ইতিহাসে বিরল।’

যুদ্ধপূর্ব রাজনৈতিক জীবন, যুদ্ধকালীন জীবন এবং যুদ্ধপরবর্তী প্রশাসনিক-রাজনৈতিক জীবন সর্বত্রই তাজউদ্দীন আহমদ রেখেছিলেন অসাধারণ প্রজ্ঞা, বিনয়, কর্মনিষ্ঠা, সততা, দূরদর্শিতা, নীতিনিষ্ঠতার এক বিরল ছাপ। তার জীবনের মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে সত্যিকার ‘রাষ্ট্র’ করে গড়ে তোলার ভিত তৈরির কাজটি নিস্পন্ন করার। সে চেষ্টাই করে গেছেন যুদ্ধদিনের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জীবনের শেষদিন পর্যন্ত। 

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক। [email protected]

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status