প্রথম পাতা
লিকুর সবই স্ত্রী শ্যালকের নামে
মারুফ কিবরিয়া
১৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪, বৃহস্পতিবারসাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একান্ত সহকারী-২ ছিলেন গাজী হাফিজুর রহমান লিকু। দুর্নীতি-অনিয়মের কারণেই চাকরি হারান চলতি বছরের মে মাসে। চাকরি হারানোর সঙ্গে সঙ্গেই সামনে চলে আসে লিকুর দুর্নীতি ও অনিয়মের তথ্য। অভিযোগ রয়েছে- ঘুষ, টেন্ডার বাণিজ্য, নিয়োগ বাণিজ্যসহ নানা অনিয়মের মাধ্যমে হাজার কোটি টাকা মূল্যের সম্পদ গড়েছেন লিকু। তবে বেশির ভাগ সম্পদই কিনেছেন স্ত্রী, ভাই ও শ্যালকের নামে। জানা যায়, চাকরি হারানোর আগেই লিকুর অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ জমা পড়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। তবে আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকায় তার বিরুদ্ধে কোনো অনুসন্ধান শুরু করেনি সংস্থাটি। সম্প্রতি শেখ হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর তার দলীয় এমপি মন্ত্রীদের সঙ্গে লিকুর অনুসন্ধানের সিদ্ধান্তও নেয় দুদক।
গতকাল কমিশনের সভায় লিকু ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা সম্পদের অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সংস্থাটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আবদুল্লাহর নেতৃত্বে দুই কমিশনার ও সচিব ওই সভায় উপস্থিত ছিলেন। দুদকের ঊর্ধ্বতন একটি সূত্র মানবজমিনকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গোপালগঞ্জের ছাত্রনেতা থেকে সাবেক প্রধানমন্ত্রীর একান্ত সহকারী হওয়ার পরপরই যেন আলাদিনের চেরাগ পেয়ে যান লিকু। বিশেষ করে গত ছয় বছরে গোপালগঞ্জ, ঢাকা ও কুয়াকাটাসহ বিভিন্ন স্থানে নামে বেনামে বিপুল পরিমাণ সম্পদ গড়েন তিনি।
সূত্র মতে, শেখ হাসিনার এপিএস নিয়োগ পাওয়ার পর গাজী হাফিজুর রহমান লিকু তার প্রভাব খাটানো শুরু করেন। বিভিন্নভাবে অনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অবৈধ উপায়ে অঢেল সম্পদের মালিক হয়েছেন তিনি। লিকু দীর্ঘদিন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দায়িত্ব পালন করে সরকারি প্রতিষ্ঠান ও দলের ভেতর বিশাল প্রভাব বলয় তৈরি করেন। সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নাম ভাঙিয়ে ক্ষমতার অপব্যবহার, দলীয় পদ-পদবি বাণিজ্য ও তদবির বাণিজ্য করেন। চলতি বছর প্রথম ধাপে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে ক্ষমতার অপব্যবহার করে গোপালগঞ্জ সদর উপজেলায় তার নিজের প্রার্থীকে জোর করে পাস করতে প্রতিপক্ষের ওপর আগ্নেয়াস্ত্রসহ সশস্ত্র হামলা চালিয়েছেন। এতে ৯ জন গুলিবিদ্ধসহ অনেকেই মারাত্মকভাবে আহত হয়েছেন। নির্বাচনে চেয়ারম্যান পদপ্রার্থী লিয়াকত ভূঁইয়া সর্বোচ্চ ভোট পেলেও গভীর রাতে তাকে পরাজিত দেখিয়ে লিকু সমর্থিত প্রার্থীকে পাস করানো হয়। এসব অভিযোগ তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়েও দেয়া হয়েছিল।
যেখানে যত সম্পদ লিকুর : লিকুর বিরুদ্ধে দুদকে অভিযোগ জমা পড়ে গত মে মাসে। সে অভিযোগের সূত্র ধরে মানবজমিনও গোপালগঞ্জে সরজমিন তথ্য সংগ্রহ করে। এ সময় তার স্ত্রী রহিমা আক্তারের নামে একটি মৎস্য ঘের পাওয়া যায়। প্রায় ৫০০ শতাংশ জমিতে স্থাপিত এই ঘেরের নাম মেসার্স রাফি এগ্রো অ্যান্ড ফিশারিজ। গোপালগঞ্জের কাশিয়ানিতে প্রতিষ্ঠা করা ওই খামারের জমির দলিল মূল্য অর্ধকোটির মতো হলেও বাজারমূল্য কয়েক কোটি টাকা বলে স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। গোপালগঞ্জ জেলার কোটালীপাড়া থানাধীন কুশলা ইউনিয়নের গোড়ার গ্রামসহ গোপালগঞ্জ সদর থানাধীন কাজুলিয়া গ্রামের ৪০০ বিঘা জমিতে মৎস্য ঘের রয়েছে লিকুর স্ত্রী রহিমা আক্তারের। গোপালগঞ্জ জেলার সদর থানাধীন থানাপাড়া ডিসি রোডে পৈতৃক জমিতে ৫ তলা ভবন নির্মাণ করেছেন লিকু। যার নির্মাণ ব্যয় দুই কোটি টাকারও বেশি।
এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নিজ বাড়ির পাশে থানাপাড়া রোডের অনির্বাণ স্কুলের দক্ষিণ পাশে লিকুর শ্যালক শেখ মো. ইকরাম ওরফে হালিম মোল্লার নামে-বেনামে ৬ তলা ভবন নির্মাণ করেছেন যেখানে শ্বশুর-শাশুড়ি বসবাস করে। হালিম মোল্লা গার্মেন্টস ব্যবসার আড়ালে মূলত হুন্ডি ব্যবসার মাধ্যমে অর্থ পাচারের সঙ্গে জড়িত বলে জানা যায়। তিনি ভিয়েতনামে বসবাস করেন। গাজী হাফিজুর রহমানের অবৈধ অর্থ বৈধ করার কাজে তিনি সহযোগিতা করেন।
এ ছাড়া গোপালগঞ্জ সদরের খ্রিষ্টানপাড়া এলাকায় ১০ শতাংশ জমির উপর লিকুর শ্যালক হালিম মোল্লা একটি সাততলা ভবন নির্মাণ করেছেন। সরজমিনে দেখা গেছে, ভবনটি আবাসিক ফ্ল্যাট হিসেবে ভাড়া দেয়া হয়েছে। স্থানীয়রা জানিয়েছেন, ভবনটি শ্যালকের নামে হলেও মূলত লিকুর অর্থায়নেই করা হয়েছে।
এদিকে গোপালগঞ্জ পৌরসভার ১৩ নম্বর ওয়ার্ডে সোনাকুড় নামক স্থানে নিলের মাঠের পাশে ১৩ শতাংশ জমির আরেকটি দশতলা ভবন নির্মাণ করেছেন লিকু। এই ভবনটি স্বর্ণা টাওয়ার নামে পরিচিত। স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, স্বর্ণা টাওয়ার লিকুর শ্যালক হালিম মোল্লার শ্যালকের স্ত্রীর নামে নামকরণ করা হয়েছে। এ ভবনে রয়েছে আধুনিক সুইমিংপুলসহ মোট ৪০টি ফ্ল্যাট। ২০১৫ সালে সদর সাব-রেজিস্ট্রি অফিসের দলিল নম্বর ২০০৮ মূলে ১৩ শতাংশ ভূমি জনৈক নূরে এলাহীর কাছ থেকে কিনে ২০১৯ সালে ৬তলা ভবনের প্ল্যান পাস করিয়ে বর্তমানে অবৈধভাবে ১০তলা সম্পন্ন করা হয়েছে। এই জমির ক্রয় মূল্য ১৭ লাখ টাকা দেখানো হলেও প্রকৃত মূল্য ২০ কোটি কোটি টাকার বেশি হবে।
এদিকে দুদকের প্রাথমিক অনুসন্ধানেও লিকু ও তার আত্মীয়দের নামে বেশ কিছু সম্পদের তথ্য পাওয়া গেছে। অনুসন্ধান সূত্রে জানা যায়, ঢাকার মোহাম্মদপুরের বছিলায় ‘মধু সিটিতে’ এক বিঘার উপর একটি ছয়তলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন লিকু। যার বাজার মূল্য কমপক্ষে ৩০ কোটি টাকা। এ ছাড়া স্ত্রী রহিমা আক্তারের নামে আদাবরের ৬ নম্বর রোডের ৫৮৩ নম্বর বাড়িতে একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। ওই ফ্ল্যাটটি রহিমা আক্তারের বন্ধু নজরুলের কাছ থেকেই কেনা বলে জানিয়েছে দুদক সূত্র। এছাড়া রাজধানীর ধানমণ্ডিতেও আরেকটি ফ্ল্যাট রয়েছে লিকুর নামে।
দুদকের অনুসন্ধানে জানা গেছে, গোপালগঞ্জের পৌর এলাকার ১৫ নং ওয়ার্ডে লিকু তার শ্যালক হালিম মোল্লার শ্যালক রিপন ফকিরের নামেও ১৩ শতাংশ পরিমাণ একটি জমি কেনেন। এর বাজারমূল্যও ৬০ লাখ টাকা। এই জমির উপর একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি নির্মাণ করা হয়েছে। যার নির্মাণ ব্যয় হয়েছে প্রায় তিন কোটি টাকা। এ ছাড়া একই ব্যক্তির নামে আরও একটি প্লটে তিনতলা বাড়ি নির্মাণ করেছেন লিকু।
গোপালগঞ্জ সদরের থানাপাড়া এলাকায় ছোটভাই শফিকুর রহমান ছোটনের নামে আরেকটি প্লট কিনেছেন লিকু। খ্রিষ্টান কবরস্থানের পাশে ২২ শতাংশ পরিমাণ এই জমির মূল্য সোয়া এক কোটি টাকা বলে দুদকের অনুসন্ধান সূত্র জানিয়েছে। এ ছাড়া বেদগ্রাম এলাকায় আরও ১৫ বিঘা জমি কিনেছেন লিকু। একই মৌজায় জমি কিনেছেন ভায়রা ভাই ওমর আলীর নামেও।
দুদকের অনুসন্ধান বলছে, লিকুর সেজো ভাই গাজী মোস্তাফিজুর রহমানের নামে পটুয়াখালীর কুয়াকাটায় একটি রিসোর্ট কিনেছেন। যার মালিকানায় ছিলেন মুমরেজ নামের এক ব্যক্তি। তিনি রিসোর্টটি বিক্রি করে দেন। এই রিসোর্টে সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমানেরও শেয়ার রয়েছে বলে জানিয়েছে দুদক।
পরিবহন ব্যবসায়ও নাম লেখান লিকু: দুদকের অনুসন্ধান সূত্রে জানা গেছে, দুর্নীতি ও অনিয়মের টাকা পরিবহন খাতেও বিনিয়োগ করেন লিকু। ঢাকা-খুলনা-সাতক্ষীরা-গোপালগঞ্জ রুটে চলাচল করা ওয়েলকাম এক্সপ্রেস বাসের মালিকানা রয়েছে তার। ৪২টি বাসের মধ্যে সাতটি এরই মধ্যে বিক্রি করে দিয়েছেন। জানা যায়, কালু নামের এক ব্যবসায়ীর সঙ্গে যৌথ মালিকানা রয়েছে এই পরিবহন ব্যবসায়। এ ছাড়া সাভার থেকে আজিমপুর রুটে চলাচল করা ওয়েলকাম বাসেও লিকুর মালিকানা রয়েছে বলে দুদকের অনুসন্ধানে উঠে এসেছে।
অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে কথা বলতে লিকুর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়। কিন্তু তার মুঠোফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়। অনুসন্ধানের বিষয়ে দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর সাবেক এপিএস-২ এর বিরুদ্ধে দুদক প্রকাশ্যে অনুসন্ধান শুরু করেছে। কর্মকর্তা নিয়োগ হলে অনুসন্ধান কাজ পুরোদমে চলবে।
বাংলাদেশ দুর্নীতির মহাসাগরে ডুবে আছে । কোনটি পড়ব আর কোন টি বাদ দেব। দেশের সরকার যখন দুর্নীতির মহাসাগরে হাবুডুবু খায় তখন সবাই দুর্নীতির মহোৎসব করে । কারণ বাধা দেওয়ার কেউ থাকে না ।
সরকার ক্ষমতায় থাকতেই যখন দুর্নীতির জন্য চাকরি চলে যায়, তখন দুদকের তদন্তে বাধা কি ছিল ? সরকার ই তো চাকরি চ্যুত করেছিল। তারপর ও কি সরকারি দলের প্রভাব খাটানোর ক্ষমতা ছিল ?
So what? Bring all the loots from them.
বাজেয়াপ্ত। বাজেয়াপ্ত। বাজেয়াপ্ত। করার কোন বিকল্প নাই সরকারের।