মত-মতান্তর
ভারত থেকে ডিম আমদানি: বাংলাদেশের পোল্ট্রি শিল্পের জন্য দীর্ঘমেয়াদী বিপদ
(৪ মাস আগে) ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, রবিবার, ৪:৪০ অপরাহ্ন
বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ খাত গত কয়েক দশকে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। সরকারি ও বেসরকারি উভয় ক্ষেত্রের সমন্বিত প্রচেষ্টায় এ খাত দেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। পোল্ট্রি, গবাদি পশু এবং মৎস্য খাতে উল্লেখযোগ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ঘটেছে। আমরা এখন মাংস উৎপাদনে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ, এবং দুধের উৎপাদনও উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। পোল্ট্রি শিল্প বর্তমানে দেশের অন্যতম দ্রুত বর্ধনশীল কৃষি খাতগুলোর একটি। এই খাত দেশের অভ্যন্তরীণ ডিম ও মাংসের প্রায় ৯৮% সরবরাহ করে। ছোট ও মাঝারি আকারের খামারগুলো এই শিল্পের মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করছে, যা দেশের অর্থনীতিতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। প্রায় ৬০ লক্ষ মানুষ এই খাতের সঙ্গে সরাসরি বা পরোক্ষভাবে জড়িত, যারা এই শিল্প থেকে তাদের জীবিকা নির্বাহ করে আসছে। পোল্ট্রি খাতে বড় ধরনের উন্নয়ন দৃশ্যমান। বিশেষত ডিম উৎপাদনে এক কথায় বিপ্লব ঘটেছে। প্রাণিসম্পদ খাত সংশ্লিষ্ট আমরা এ বিপ্লবের নীরব সাক্ষী। আমরা জানি কি অক্লান্ত পরিশ্রমে এ সেক্টরকে তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন আমাদের খামারী ও এ খাত সংশ্লিষ্ট উদ্যোক্তারা। দেশে এখন বছরে প্রায় ১,৭০০ কোটি ডিম উৎপাদন হয়, যা দেশের চাহিদা মেটাতে সক্ষম। দেশের ডিম উৎপাদন স্থানীয় চাহিদা পূরণের পাশাপাশি সমগ্র বাজার ব্যবস্থাপনায় মূল্য স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করছে।
সম্প্রতি ডিমের মূল্যবৃদ্ধি এবং বাজারে ডিমের সংকট মোকাবিলায় ভারত থেকে ডিম আমদানির সিদ্ধান্ত ব্যাপক আলোচনা ও বিতর্কের জন্ম দিয়েছে। বাজারে ডিমের মূল্য নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে ভারত থেকে ডিম আমদানি শুরু হয়েছে, কিন্তু এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব দেশের পোল্ট্রি শিল্পের ওপর যে কতটা ক্ষতিকর হতে পারে, তা গভীরভাবে পর্যালোচনা করা অত্যন্ত জরুরি। ভারত থেকে ডিম আমদানির এ সিদ্ধান্ত অত্যন্ত উদ্বেগজনক। এ ধরনের আমদানি শুধু দেশের পোল্ট্রি শিল্পের ভবিষ্যতের জন্য হুমকিস্বরূপ নয়, বরং খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতায় দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব ফেলতে পারে। সস্তায় ডিম আমদানির ফলে দেশের খামারিদের আয় কমে গেলে তারা মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটে পড়বে, যার ফলে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের ধাক্কা লাগতে বাধ্য।
ভারতীয় ডিমের আপাত সস্তা দাম দেশীয় খামারিদের প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে ফেলছে, যা স্থানীয় খামারিদের টিকে থাকা কঠিন করে তুলবে। দেশীয় খামারিরা এই মুহুর্তে বিদেশি প্রতিযোগিতার সম্মুখীন। আমাদের পোল্ট্রি ফিড, ওষুধ, এবং ভ্যাকসিনের অধিকাংশই আমদানি নির্ভর ফলে খাদ্য, ওষুধ, এবং অন্যান্য সরঞ্জামের খরচ ভারতের তুলনায় বেশি ফলে দেশীয় খামারিরা ভারতীয় ডিমের সাথে প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়বে এটাই স্বাভাবিক। ভারতের পোল্ট্রি খাতের উৎপাদন খরচ কম হওয়ার অন্যতম কারণ তাদের পোলট্রি উৎপাদন পুরোপুরি দেশীয় কাঁচামাল দ্বারা সমৃদ্ধ, যার ফলে তাদের উৎপাদন ব্যয় কম। এর ফলে, ভারতীয় খামারিরা সস্তা ডিম উৎপাদন করে আন্তর্জাতিক বাজারে সহজেই প্রতিযোগিতা করতে পারছে, যা আমাদের খামারিদের জন্য বড় ধরনের সমস্যা তৈরি করছে। সরকারের এই আমদানি নির্ভর পদক্ষেপ দেশের পোল্ট্রি খাতকে আরো ঝুঁকিতে ফেলবে। দেশীয় খামারিরা যদি প্রতিযোগিতায় টিকে না থাকতে পারে, তবে তারা ব্যবসা থেকে সরে দাঁড়াবে, এবং ভবিষ্যতে আমাদের ডিমের জন্য বিদেশের ওপর নির্ভরশীল হতে হবে।
একবার দেশীয় খামারিরা ব্যবসা বন্ধ করতে বাধ্য হলে, তখন বাজারে ডিমের সরবরাহ সম্পূর্ণভাবে আমদানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়বে। এই অবস্থায় আমদানিকারকরা ডিমের দাম নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা পাবে, যা সাধারণ ভোক্তাদের জন্য ক্ষতিকর হয়ে দাঁড়াবে। আজ ডিমের দাম কমানো হলেও, ভবিষ্যতে এই দাম বাড়িয়ে জনগণের উপর চাপ সৃষ্টি করা হবে নিশ্চিত। এ ধরনের আমদানি নির্ভরতা দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলবে এবং আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল করে তুলবে।
এক্ষেত্রে আমাদের স্বাস্থ্য ও খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে পোল্ট্রি খামারগুলোতে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি অনুসরণ করে ডিম উৎপাদন করা হয়। কিন্তু আমদানিকৃত ডিমের ক্ষেত্রে এই মান বজায় রাখা হয়েছে কি না, তা নিশ্চিত করা কঠিন। ভারত থেকে আমদানি করা ডিমের মান, নিরাপত্তা এবং স্বাস্থ্য ঝুঁকির বিষয়টি নিশ্চিত করতে কোনো স্পষ্ট বিধিমালা নেই। যদি আমদানি করা ডিমের মান নিয়ে কোনো সমস্যা দেখা দেয়, তা দেশের জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরনের হুমকি তৈরি করবে। পাশাপাশি, এই ডিমের উৎস সম্পর্কে স্বচ্ছতা ও সঠিক পরীক্ষার অভাবও উদ্বেগজনক। সারা বিশ্বে বহুল ব্যবহৃত কিছু পোল্ট্রি খাদ্য উপাদান যেমন মিট ও বোন মিল বাংলাদেশে পোলট্রি খাদ্যে খুব কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। এছাড়াও আমাদের দেশে পোল্ট্রি খাদ্যে এন্টিবায়োটিকের ব্যবহার একেবারে শুণ্যের কোঠায়। এই ব্যাপারগুলো মানুষের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ কিন্তু এটা মুরগির ডিম ও মাংসের উৎপাদন খরচ বাড়াচ্ছে। ভারতের ডিম উৎপাদনে এই নিষেধাজ্ঞা মানা হচ্ছে কি না সেটা নিশ্চিতের কোন ব্যবস্থা নাই।
ডিম আমদানির পরিবর্তে বাংলাদেশে ডিমের বাজার ব্যবস্থাপনায় নজর দেওয়া উচিত যা বর্তমানে একটি বিশেষ গোষ্ঠী ও মধ্যস্বত্বভোগিদের দখলে। দেশের প্রতিটি বাজারে এখনো ডিমের দাম নির্ধারণের পদ্ধতি মূলত চাহিদা ও সরবরাহের উপর নির্ভর করে। বড় ডিলাররা একসঙ্গে বসে ডিমের দাম নির্ধারণ করে, যা বাজারের প্রকৃত অবস্থার প্রতিফলন ঘটে না। এই পদ্ধতিতে স্বচ্ছতার অভাব রয়েছে এবং এটি অনেক সময় মুনাফাখোরদের হাতে চলে যায়। ফলে সাধারণ মানুষ চড়া দামে ডিম কিনতে বাধ্য হয়, অথচ খামারিরা যথাযথ দাম পায় না। এই বাজার ব্যবস্থার আধুনিকায়ন খুবই প্রয়োজন। আধুনিক ডিম বাজার ব্যবস্থাপনায় ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করা যেতে পারে, যেখানে খামারি থেকে ভোক্তা পর্যন্ত পুরো চেইনটি স্বচ্ছ এবং নিয়ন্ত্রিত থাকবে। বাজারদর নির্ধারণের ক্ষেত্রে ইলেকট্রনিক ট্রেডিং সিস্টেম প্রয়োগ করা যেতে পারে, যা খামারিদের সরাসরি ন্যায্যমূল্য পাওয়ার সুযোগ দেবে। এছাড়া, লজিস্টিকস এবং কোল্ড স্টোরেজ সুবিধা বাড়ানোর মাধ্যমে ডিম সংরক্ষণ এবং বিতরণে উন্নতি করা যাবে, যা বাজারে ডিমের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হবে। এর ফলে, সরবরাহ সংকট বা মূল্যবৃদ্ধি এড়ানো সম্ভব হবে, যা দেশীয় বাজারকে স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করবে। অন্যদিকে, উৎপাদক এবং ভোক্তাদের মধ্যে সরাসরি যোগাযোগের ব্যবস্থা করতে ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলা যেতে পারে। এতে করে খামারিরা তাদের ডিম সরাসরি ভোক্তাদের কাছে বিক্রি করতে পারবে, যা বাজারের মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমিয়ে দেবে এবং খামারিরাও ন্যায্য দাম পাবে।
দেশের পোল্ট্রি শিল্পের দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নে গুরুত্ব দেওয়া অত্যন্ত জরুরি। ডিম উৎপাদন বাড়াতে সরকারকে দেশীয় খামারিদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা দিতে হবে। খাদ্য ও পশু খাদ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ, সহজ ঋণ সুবিধা, এবং খামারিদের জন্য আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগ বৃদ্ধি করা হলে, দেশের পোল্ট্রি শিল্প আরো শক্তিশালী হতে পারে। এর ফলে ডিমের দাম স্থিতিশীল থাকবে এবং সংকটের সময়ে আমদানির প্রয়োজনীয়তা কমবে। সরকারের উচিত বাজার নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি দেশীয় উৎপাদন ব্যবস্থার উপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া। আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করলে, পোল্ট্রি শিল্পের সঙ্গে জড়িত লক্ষাধিক মানুষের জীবিকা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। বাংলাদেশে পোল্ট্রি খাতের গুরুত্বকে অবমূল্যায়ন করা যাবে না, কারণ এটি শুধু একটি ব্যবসায়িক খাত নয়, বরং দেশের খাদ্য নিরাপত্তার একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ। সরকার ও সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর উচিত এ খাতে গবেষণা এবং উন্নয়নে বিনিয়োগ করা, যাতে দেশের খামারিরা সহজলভ্য ও সাশ্রয়ী মূল্যে ফিড, ওষুধ এবং ভ্যাকসিন পেতে পারে। এর ফলে খামারিদের উৎপাদন ব্যয় কমে যাবে এবং তারা ভারতীয় খামারিদের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারবে। ভারত থেকে ডিম আমদানির সাময়িক পদক্ষেপটি দেশের বাজারে ডিমের দাম কমাতে সহায়ক হয়ত হবে, কিন্তু এর দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব পোল্ট্রি শিল্পের জন্য ধ্বংসাত্মক হবে। আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় পোল্ট্রি শিল্পকে শক্তিশালী করার লক্ষ্যে সরকারের সঠিক নীতিমালা গ্রহণ করতে হবে। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা এবং পোল্ট্রি শিল্পের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আমাদের সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার এখনই সময়।
ডাঃ মোঃ মোছাব্বির হোসেন
কৃষক ও কৃষি চিন্তক
[email protected]
নিজেরা ইচ্ছে মতো ডিমের দাম বাড়িয়ে দিচ্ছেন আর আমদানির কথা বললে পোল্ট্রি শিল্প ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কান্না !!! এসব ফাজলামো বাদ দিন আমরা চাই ডিমের দাম প্রতি পিস আট টাকার বেশি যেন না হয়। যদি ডিমের দাম আট টাকার বেশি হয় তাহলে আমরা সাধারণ জনগণ ডিম্ আমদানির পক্ষে সোচ্চার হবো!
আমাদের পোলট্রি শিল্পের স্বার্থে ভারতীয় ডিম আমদানি বন্ধ করা প্রয়োজন। ডিমের মূল্য কমাতে এ শিল্পের জন্য ভর্তুকি প্রদানের বিষয়টি বিবেচনা করা যেতে পারে।