ঢাকা, ৪ অক্টোবর ২০২৪, শুক্রবার, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৩০ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬ হিঃ

শেষের পাতা

ডেলিভারিম্যান ইয়াকুবের মায়ের চোখের পানি থামছে না

শুভ্র দেব
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, শুক্রবারmzamin

পঞ্চাশোর্ধ্ব রহিমা বেগমের দুই সন্তান। ছেলে ইয়াকুবকে নিয়ে তিনি চানখাঁরপুল নাজিম উদ্দিন রোডের জরাজীর্ণ একটি বাসায় থাকতেন। ছোট মেয়ে শাহজাদী বেগমের বিয়ে হয়েছে কয়েক বছর আগে। সন্তানেরা যখন অনেক ছোট তখনই তার স্বামী পুরান ঢাকার নামকরা চা বিক্রেতা ইউসুফ মিয়া মারা যান। তারপর থেকে সন্তানদের বড় করা ও দু’বেলা দু’মুঠো খাবারের যুদ্ধে নামতে হয় রহিমাকে। সংসারের হাল ধরতে হয় ছেলে ইয়াকুবকে। প্রাইমারি পর্যন্ত লেখাপড়া করা এই সন্তান টুকটাক কাজ করে যে আয় করতেন সেটা দিয়েই টানাটুনির সংসার চলতো। ধীরে ধীরে ইয়াকুব ইলেকট্রিক মিস্ত্রির কাজ শিখেন। কাজ পেলে সেই টাকা সংসারের খরচে ব্যয় করতেন। সম্প্রতি ইয়াকুব অনলাইনে শাড়ি বিক্রেতা একটি প্রতিষ্ঠানের ডেলিভারিম্যানের কাজ ধরেন। সারা দিন ডেলিভারি করে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা আয় করতেন। খরচ বাদে কিছু টাকা সঞ্চয়ও করতেন। রহিমা বেগম ও তার ছেলের স্বপ্ন ছিল কিছু টাকা জমিয়ে প্রথমে জরাজীর্ণ ঘর মেরামত করবেন। পরে ইয়াকুব বিয়ে করবে। ঘরে নতুন বউ আসবে। তিনজন মিলে সুখের সংসার গড়ে তুলবেন। কিন্তু মা-ছেলে দু’জনের স্বপ্ন আজ মিইয়ে গেছে। সরকার পতনের দিন শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার লোকের সঙ্গে আন্দোলনে অংশ নেন ইয়াকুব। ঘর থেকে বের হয়ে কিছুদূর যাওয়ার পরই পুলিশের একটি গুলি লাগে তার হাতে। আরেকটি গুলি পেটের একপাশ দিয়ে ঢুকে অন্যদিকে বের হয়ে যায়। মাটিতে লুটিয়ে পড়েন ইয়াকুব। পরিচিতরা তাকে উদ্ধার করেন। নেয়া হয় মিটফোর্ড হাসপাতালে। সেখানকার চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন। ছেলের এমন অকাল মৃত্যু কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না রহিমা। ঘটনার দিন যখনই খবর এলো ইয়াকুব আর নেই তখন থেকে তার স্বাভাবিক জীবন-যাপন যেন থমকে গেছে। ছেলের স্মৃতি আঁকড়ে ধরে বেঁছে থেকেও মরার মতো। 

৫ই আগস্ট সোমবার। অন্যান্য দিনের মতো ঘুম থেকে উঠে মায়ের সঙ্গে নাস্তা করেন ইয়াকুব। নাস্তা শেষ করে মা’কে বলেন, একটু বাইরে থেকে আসতেছি। পৌনে ১১ টায় বাসা থেকে বের হয়েই দেখেন পুলিশের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও  গোলাগুলি চলছে। প্রতিবেশী ও বন্ধু-বান্ধবরাও আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। তাই তিনিও তাদের সঙ্গে যোগ দেন। হাজার হাজার আন্দোলনকারী তখন নাজিম উদ্দিন রোডে জড়ো হয়েছেন। তারা সবাই শহীদ মিনার হয়ে শাহবাগে যেতে চাচ্ছেন। কিন্তু পুলিশের মুহুর্মুহু গুলির কারণে কেউ সামনে যেতে পারছিলেন না। পুলিশের এলোপাতাড়ি গুলিতে অনেকেই মারাত্মকভাবে আহত হচ্ছেন। কারও হাতে, কারও মাথায়, শরীরে, পায়ে গুলি লাগছে। পরিচিতরা তাদের ধরে নিয়ে মিটফোর্ড হাসপাতালে পৌঁছে দিচ্ছেন। আহতদের অনেকেই হাসপাতালে পৌঁছার আগেই নিহত হন। পুলিশের গুলি থেকে বাঁচার জন্য আন্দোলনকারীরা নিমতলীর দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। পুলিশ তখনও গুলি করছে। কিন্তু পুলিশের গুলি উপেক্ষা করেই সবার আগে ইয়াকুব নিমতলীর দিকে  যেতে থাকেন। ঠিক তখনই পুলিশ ইয়াকুবকে লক্ষ্য করে একটি গুলি ছুড়ে। সেই গুলি তার হাতে লাগে। পরে আরেকটি গুলি এসে তার পেটের একপাশ দিয়ে ঢুকে আরেকপাশ দিয়ে বের হয়ে যায়। গুলিবিদ্ধ স্থান হাত দিয়ে চেপে ধরে কয়েক সেকেন্ড দাঁড়িয়ে থাকার পর মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। পরে তাকে হাসপাতালে নেয়া হয়। পাশেই ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থাকা সত্ত্বেও সেখানে নেয়া যায়নি। পরে মিটফোর্ড হাসপাতালের চিকিৎসকরা তখন জানিয়েছিলেন হাসপাতালে নেয়ার আগেই ইয়াকুবের মৃত্যু হয়েছে। বাদ মাগরিব জানাযা শেষে আজিমপুর কবরস্থানে তাকে শায়িত করা হয়। 

স্থানীয়রা জানান, নাজিম উদ্দিন রোড এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা ইয়াকুব। পুরান ঢাকায় নামকরা চা ওয়ালা হিসেবে নামডাক রয়েছে তার বাবা ইউসুফের। তার বাবা নিজের মালিকানাধীন অল্প জায়গায় দুই রুমের একটি বাসা তৈরি করেছিলেন। অনেক বছরের পুরনো হওয়াতে এখন বাসাটি জরাজীর্ণ অবস্থায় আছে। ঘরের চেয়ে রাস্তা উঁচু হওয়াতে অল্প বৃষ্টি হলেই ঘরে পানি ওঠে। উপায়ন্তর না থাকায় কষ্ট করে মা রহিমা ও ছেলে ইয়াকুব ওই বাসাতেই থাকতেন। ইয়াকুব ছোটবেলা থেকে বেড়ে উঠেছেন নাজিম উদ্দিন রোডের জাগরণী সোসাইটিতে। এখানেই মৃত্যুর আগের দিন পর্যন্ত বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়েছেন। পাড়া-প্রতিবেশীদের সঙ্গে কখনওই খারাপ ব্যবহার করেননি। কোনো রাজনীতি বা অন্য কোনো সংগঠন এবং খারাপ সঙ্গের সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তাই তার এমন অকাল মৃত্যু প্রতিবেশীদের মনেও দাগ কেটেছে। তাদেরকেও শোকাহত করেছে। সরকার পতনের এই আন্দোলনে তার অবদান ও প্রতিবেশীদের ভালোবাসার প্রতিদান স্বরূপ তার বেড়ে ওঠার এলাকার নাম জাগরণী সোসাইটির পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে শহীদ ইয়াকুব সোসাইটি। 

ইয়াকুবের মা রহিমা বেগম বলেন, একটা মাত্র ছেলে আমার।  মেয়ে বিয়ে দেয়ার পরে তাকে নিয়েই আমার সবকিছু ছিল। মা-ছেলে মিলে অভাব অনটনের মধ্যে সুখেই ছিলাম। ভেবেছিলাম কিছু টাকা হাতে এলে তাকে বিয়ে করাবো। ঘরে বউ এনে তিনজন মিলে থাকবো। তার আগে ঘরটা ঠিক করাবো। সেজন্য রাতদিন কাজ করতো ইয়াকুব। একদিকে ইলেকট্রিক মিস্ত্রির কাজ অন্যদিকে অনলাইন ডেলিভারির কাজ করতো। সবমিলিয়ে মোটামুটি ভালোই আয় হতো। তার আয়ের উপরই নির্ভরশীল ছিলাম। এখন ছেলেটাকে মেরে ফেললো। আমার বুকটা খালি হয়ে গেল। এখন কাকে নিয়ে বাঁচবো। সংসারের খরচ চালাবে কে? তিনি বলেন, ওইদিন নাস্তা করে আমাকে বলেছিল বাইরে যাচ্ছে চলে আসবে। যদি জানতাম এই যাওয়াটাই শেষ যাওয়া তবে তাকে যেতে দিতাম না। 
 

পাঠকের মতামত

May Allah SWT grant him Jannatul Ferdaus.

Mohammad Monir Hossa
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, শুক্রবার, ৬:০২ পূর্বাহ্ন

এর পর ও কিছু হারামি ছোট খাট ঘটনায় অশ্রু বিসর্জন করে । আওয়ামীলীগের চৌদ্দ গোষ্ঠীর ( ওবায়দুল কাদের এর ভাষাতেই বলছি ) পিঠের ছাল উঠানো দরকার। তারা জানত যে পরিমাণ অন্যায় করছে এর পর পরিণাম কি হবে । ইঁদুর এর বাচ্চাদের মত এখন গর্তের ভিতর লুকিয়েছে ।

Kazi
১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, শুক্রবার, ৫:৫০ পূর্বাহ্ন

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status