ঢাকা, ৫ অক্টোবর ২০২৪, শনিবার, ২০ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১ রবিউস সানি ১৪৪৬ হিঃ

বিশ্বজমিন

দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি: নতুন শীতলযুদ্ধের দ্বারপ্রান্তে

মানবজমিন ডেস্ক
১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবারmzamin

এ বছরের আগস্টে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাটকীয়ভাবে ক্ষমতা হারানোয় দক্ষিণ এশিয়ার রাজনৈতিক আবহাওয়ায় অস্থিতিশীলতার বাতাস লেগেছে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। দক্ষিণ এশিয়ার এ অঞ্চলগুলোর রাজনীতি এখন বৈশ্বিক ব্যবস্থার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ছে বলে তাদের ধারণা। বিশেষ করে এ অঞ্চলে মার্কিন উপস্থিতি একটি স্নায়ুযুদ্ধের ইঙ্গিত দিচ্ছে। যার সঙ্গে ভারতও অগ্রসর হচ্ছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতা হারিয়ে ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়েছেন শেখ হাসিনা। ভারতীয় গণমাধ্যম এনডিটিভি’র এক খবরে বলা হয়েছে, হাসিনা অভিযোগ করেছেন যে- তিনি দেশ ছাড়ার জন্য পর্যাপ্ত সময় পাননি। তাকে একটি নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দেয়া হয়েছিল। এ সময়ের মধ্যে তিনি দেশ  ছেড়ে দিল্লিতে চলে যান। হাসিনার দাবি- ‘আমি পদত্যাগ করেছি। কারণ আমি লাশের সারি দেখতে চাই না। তারা ছাত্রদের লাশ মাড়িয়ে ক্ষমতায় আসতে চেয়েছিল। কিন্তু আমি তা হতে দেইনি। আমি প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছি। আমি ক্ষমতায় থাকতে পারতাম যদি আমি সেন্টমার্টিন দ্বীপের সার্বভৌমত্ব আত্মসমর্পণ করতাম এবং আমেরিকাকে বঙ্গোপসাগরের উপর কর্তৃত্ব করতে দিতাম। আমি আমার দেশের জনগণের কাছে অনুরোধ করছি, দয়া করে মৌলবাদীদের দ্বারা প্রতারিত হবেন না।’ যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে হাসিনার এই অভিযোগ গুরুতর। যদিও যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে হাসিনার এই অভিযোগ একাধিকবার প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। তবে হাসিনার এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে দক্ষিণ এশিয়ার ভূরাজনীতিতে বেশ চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়েছে। দ্য লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস অ্যান্ড পলিটিক্যাল সায়েন্সের ওয়েবসাইটে ‘সাউথ এশিয়া: নেভিগেটিং দ্য নিউ কোল্ড ওয়ার’- শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, হাসিনার এই বক্তব্য দক্ষিণ এশিয়ার শাসনব্যবস্থা পরিবর্তনে ‘বিদেশি হস্তক্ষেপের’ ধারণাকে পুনরুজ্জীবিত করার ইঙ্গিত দিচ্ছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর যেখানেই রাজনৈতিকভাবে ক্ষমতার পরিবর্তন হচ্ছে সেখানেই এমন বিদেশি হস্তক্ষেপের অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। যেমন, ২০২২ সালে পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতাচ্যুত করার পরও এর সঙ্গে বিদেশি গোয়েন্দাদের (মার্কিন গোয়েন্দা) হাত রয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছিল। বর্তমানে দুর্বল হয়ে পড়া জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন (এনএএম) শীতল যুদ্ধের সময় দক্ষিণ এশিয়ার সার্বভৌমত্ব এবং স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির কিছু স্তরে স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সাহায্য করেছিল। এই জোট পরাশক্তিগুলোর মধ্যে উত্তেজনা নিরসনে কাজ করেছিল এবং তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ প্রতিরোধে সহায়তা করেছিল। জোটের অনেক অপারগতা থাকা সত্ত্বেও এনএএম কম এগিয়ে থাকা রাষ্ট্রগুলোকে সম্মিলিত পরিচয় এবং কোনো পরাশক্তির সাহায্য ছাড়াই মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সাহায্য করেছিল। কিন্তু দক্ষিণ এশিয়া এখন চীন, যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের নিজ নিজ মিত্রদের মধ্যে একটি নতুন শীতল যুদ্ধের ঝুঁকিতে রয়েছে। পরাশক্তি রাষ্ট্রগুলোর পক্ষপাতিত্ব বেছে নিতে এখন যে চাপের মধ্যে পড়েছে এই অঞ্চল তাতে এসব রাষ্ট্রের সম্প্রীতি ও স্থিতিশীলতা হুমকির দ্বারপ্রান্তে। দক্ষিণ এশিয়ার বেশক’টি দেশ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। আফগানিস্তান থেকে শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ এবং অতি সমপ্রতি বাংলাদেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা এর বড় প্রমাণ। স্নায়ুযুদ্ধ যুগের মতো, বন্ধুত্বহীন সরকার উৎখাত করে সেখানে অকার্যকর নেতাদের বসানো পরাশক্তিগুলোর জন্য আঞ্চলিক রাজনীতি গঠন এবং তাদের স্বার্থ রক্ষায় কৌশলগত হাতিয়ার হয়ে উঠেছে। এই কৌশলের মাধ্যমে প্রায়ই কাঙ্ক্ষিত ফলাফল অর্জনের জন্য পরাশক্তিগুলো সাইবার যুদ্ধ, অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং বিভ্রান্তিমূলক প্রচারাভিযান সহ আরও প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ পদ্ধতির আশ্রয় নেয়।
দক্ষিণ এশিয়ার শীতল যুদ্ধের মানচিত্র
চীনের উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি পরিবর্তনকারী একটি খেলায় পরিণত হয়েছে। পাকিস্তান, নেপাল, বাংলাদেশ, শ্রীলঙ্কা এবং সমপ্রতি মালদ্বীপে চীনের অর্থনৈতিক পদচিহ্ন এই অঞ্চলের ভূ-রাজনৈতিক ল্যান্ডস্কেপকে নতুন আকার দিয়েছে। যা এখন ভারতের আঞ্চলিক প্রভাবকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছে। পাকিস্তান, স্নায়ুযুদ্ধের সময় এবং পরে ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে’ লড়াইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের একটি শক্তিশালী মিত্র হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে। কিন্তু দেশটি এখন চীনের বিআরআই প্রকল্পেরও প্রধান অংশীদার যা চীন-পাকিস্তান অর্থনৈতিক করিডোরের (সিপিইসি) অংশ হিসেবে উল্লিখিত হচ্ছে। মূলত আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের পর পাকিস্তান তাদের পক্ষ পরিবর্তনের সুযোগটি হাতছাড়া করতে চায়নি। অন্যদিকে শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটা বন্দরে চীন একটি সামরিক ও কৌশলগত করিডোর স্থাপন করেছে। সমপ্রতি মালদ্বীপ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার, বেইজিং এবং মালের মধ্যে নতুন সামরিক চুক্তি ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। নেপালে ২০১৫ সালে ভারতের অর্থনৈতিক অবরোধের সুযোগে সেখানে চীনের উপস্থিতি দ্রুত বৃদ্ধি পেয়েছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৈশ্বিক আধিপত্যে এগিয়ে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। এক্ষেত্রে তাদের বড় প্রতিপক্ষ রাশিয়া এবং চীন। বর্তমানে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় হুমকি চীন। তবে যুক্তরাষ্ট্র এই অঞ্চলগুলোতে তাদের প্রভাব বিস্তার করতে দ্বিপক্ষীয় এবং বহুপক্ষীয় পথ অনুসরণ করছে বলে মনে হচ্ছে। দেশটি ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চলে ভারতের সঙ্গে মিলিত হয়ে তাদের নৌশক্তি আরও প্রসারিত করতে চাইছে। জাপান এবং অস্ট্রেলিয়াও এই পরিকল্পনার অংশ হিসেবে কাজ করছে। দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের আর্থিক বিনিয়োগ এবং অবকাঠামোগত ঋণকে ‘ঋণ-ফাঁদ’ কূটনীতি হিসেবে প্রতিহত করার চেষ্টা করছে যুক্তরাষ্ট্র। উদাহরণস্বরূপ, নেপালে মার্কিন মিলেনিয়াম চ্যালেঞ্জ করপোরেশনকে (এমসিসি) বিআরআই বিনিয়োগের পাল্টা হিসেবে উপস্থাপন করেছে চীন। পক্ষান্তরে এখানে বেইজিংয়ের অবস্থানকে মোকাবিলা করতে ‘ব্লু ডট নেটওয়ার্ক’, জি-৭ নেতৃত্বাধীন ‘বিল্ড ব্যাক বেটার ওয়ার্ল্ড’ (বিডব্লিউ) পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। 
এখন দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর কী করা উচিত?
তুলনামূলক কম শক্তিশালী দেশগুলো সর্বদা বৃহৎ শক্তির প্রতিদ্বন্দ্বিতায় ভোগে। এই দেশগুলোতে প্রায়ই অতিরিক্ত জনসংখ্যা, দারিদ্র্য, অসম উন্নয়ন এবং বেকারত্বের সমস্যা রয়েছে। যেকোনো একটি ব্লকের সঙ্গে জোটবদ্ধ থাকার ফলে তারা কেবল যুদ্ধ, রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিতিশীলতা এবং অর্থনৈতিক দুর্দশার মুখে পতিত হয়। চীনকে মোকাবিলা করতে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সারিবদ্ধ হওয়ার জন্য ভারতের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অকার্যকর। তাদের এ সিদ্ধান্ত দিল্লির স্বার্থকে বিরূপভাবে প্রভাবিত করেছে। ভারতের প্রতিবেশী দেশগুলোর জনগণ এবং রাজনীতিবিদরা পশ্চিমাদের এবং তাদের এজেন্ডা থেকে নিজেদেরকে দূরে রাখার চেষ্টা করে তাই দিল্লির ‘নেবারহুড ফার্স্ট’ নীতি ক্রমশ অকার্যকর হয়ে উঠছে। নেপাল এর একটি কার্যকর উদাহরণ। ভারত প্রায় এক দশক ধরে দক্ষিণ এশীয় আঞ্চলিক সহযোগিতা সংস্থার (সার্ক) কার্যক্রম বন্ধ করে দিয়েছে। কার্যত এতে দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে যোগাযোগ, পারস্পরিক আস্থা ও সৌহার্দ্যে ভাঙন দেখা দিয়েছে। সার্কের কার্যকারিতা না থাকায় দক্ষিণ এশিয়ার এই অঞ্চলগুলো কার্যত পরাশক্তিগুলোর ‘রণক্ষেত্র’ হিসেবে প্রস্তুত হচ্ছে। হাসিনার পদত্যাগের পর বাংলাদেশে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান করা হয়েছে নোবেলজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে। তিনি ইতিমধ্যেই সার্কের কার্যকারিতাকে পুনরুজ্জীবিত করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছেন। যেন দক্ষিণ এশীয় এই দেশগুলোতে যোগাযোগ এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা বৃদ্ধি পায়। তিনি মনে করেন, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোকে অবশ্যই নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বহিরাগত শক্তির হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করতে হবে। এক্ষেত্রে বিশ্লেষকরা মনে করেন, ভারতের উচিত এই অঞ্চলে জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনের নেতৃত্ব দেয়ার ক্ষেত্রে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করা।
 

পাঠকের মতামত

ভারতের সাথে কখনোই আমাদের বন্ধুত্ব হবে না। ভারত তা কোন কালেই মেনে নেবে না, আমরা যত চেষ্টাই করিনা কেন। ভারতীয় রাজনৈতিক দর্শন বাংলাদেশের জনগনও মনে প্রাণে গ্রহন করবে না, ভারত ও তার দোসর আওয়ামী যত কিছুই করুক না কেন । এই বাস্তবাতা নিয়েই আমাদের সামনে এগোতে হবে।

shohidullah
১০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, মঙ্গলবার, ৬:৩৫ পূর্বাহ্ন

বিশ্বজমিন থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

বিশ্বজমিন সর্বাধিক পঠিত

বিবিসির প্রতিবেদন/ হাসিনাকে নিয়ে দ্বিধায় দিল্লি!

ইউক্রেন, গাজা ও বাংলাদেশ পরিস্থিতি বিশ্লেষণের আহ্বান/ সশস্ত্র বাহিনীকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকতে বললেন রাজনাথ

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status