শরীর ও মন
পাইল্স রোগের সাধারণ জ্ঞান ও প্রতিকার
ডা. মোহাম্মদ তানভীর জালাল
৩১ আগস্ট ২০২৪, শনিবারঅনেকের জীবনের একটি বিড়ম্বনার নাম এই হেমোরয়েড, পাইলস বা অর্শ রোগ। গবেষণায় দেখা যায় বয়স পঞ্চাশের কোটায় যেতে না যেতেই শতকরা ৫০ ভাগ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হন।
পাইলস হওয়ার কারণ: হেমোরয়েডস বা পাইলস নামগুলো সাধারণভাবে রোগ বোঝাতে ব্যবহৃত হলেও আসলে এটা পায়ুপথের শেষাংশে থাকা একধরনের রক্তনালিগুচ্ছের সাধারণ নাম। বৃহদান্ত্রের শেষভাগে মলদ্বারের ভেতরে ও বাইরে থাকা কুশনের মতো এই রক্তনালিগুচ্ছ বা জালিকা প্রয়োজনমতো সঙ্কুচিত ও প্রসারিত হয়ে মলত্যাগে সহায়তা করে। পাইলস বা অর্শ রোগ হলো এই রক্তনালিগুচ্ছের প্রদাহ ও সংক্রমণ।
রোগটিকে আমরা প্রচলিত শব্দে যদি পাইলস নামে অভিহিত করি তাহলে এর কারণ নেহায়েত কম নয়! দীর্ঘদিনের কনস্টিপেশন বা কোষ্ঠকাঠিন্য, পুরনো ডায়রিয়া, মেদস্থূলতা, শারীরিক নিষ্ক্রিয়তা, আঁশযুক্ত খাবার কম এবং প্রক্রিয়াজাত খাবার বেশি খাওয়া- মূল কারণ এগুলোই।
প্রেগনেন্সি, বাড়তি ওজন বা অন্য কোনো কারণে মলত্যাগে বেশি জোরাজুরি করলেও পাইলস হতে পারে।
আর ঘণ্টার পর ঘণ্টা চেয়ারে বসে কাজ করতে যারা অভ্যস্ত পাইলসের উচ্চ ঝুঁকিতে আছেন তারাও। যে কারণে বেশির ভাগ সময় বসে কাজ করেন এমন চাকরিজীবীদের মধ্যে রোগটি একটু বেশিই দেখা যায়।
কীভাবে বুঝবেন পাইলস হয়েছে: প্রাথমিক যে অবস্থা পাইলসের জানান দেয় তা হলো মলদ্বার ও পায়ুপথে শিরা ফুলে যাওয়া বা গোটা বের হওয়া। ব্যথা বা অস্বস্তি না হওয়ায় পায়ুপথের ভেতরে পাইলস হলে তা বোঝা মুশকিল। তবে পায়ুর বাইরের দিকে পাইলস বোঝা সহজ। গোটা বের হওয়ার পাশাপাশি হতে পারে ব্যথা, চুলকানি ও রক্তপাতও। পাইলসের ক্ষেত্রে শিরা ফোলাকে ৪টি পর্যায়ে ভাগ করা যায়।
প্রথম পর্যায়ে শিরা ফুলে গেলেও তা বাইরে বেরিয়ে আসে না। দ্বিতীয় পর্যায়ে শিরা মলত্যাগের সময় বাইরে বেরিয়ে এলেও তা আপনা-আপনি ঠিক হয়ে যায়। তৃতীয় পর্যায়ে বেরিয়ে আসা শিরা নিজে নিজে ঠিক না হলেও হাত দিয়ে ঠিক করা যায়। চতুর্থ পর্যায়ে ফোলা শিরাকে আর আগের অবস্থায় ফেরানো যায় না।
পরিণতি কী: প্রাথমিক অবস্থায় পাইলস তেমন একটা যন্ত্রণাদায়ক বা অস্বস্তিকর না হলেও প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা না নিলে পাইলস বড় হয়ে ঘটাতে পারে নানাবিধ জটিলতা। যেমন- রক্তপাতের ফলে অ্যানিমিয়া বা রক্তাল্পতা দেখা দিতে পারে, মলদ্বারের বাইরে থাকা ফোলা শিরায় ঘা হয়ে প্রচণ্ড ব্যথা ও চুলকানি হতে পারে। এমনকি ফোলা স্থানে রক্ত সঞ্চালন বন্ধ হয়ে জায়গাটি পচেও যেতে পারে।
তবে পাইলস থেকে কোলন বা রেক্টাল ক্যান্সার হয়- এমন একটি ধারণা প্রচলিত থাকলেও হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুলের একটি নিবন্ধে বলা হয়েছে, পাইলস এই ক্যান্সারগুলো সৃষ্টি বা এগুলোর ঝুঁকি বৃদ্ধি কোনোটিরই কারণ নয়।
প্রতিকার: বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পাইলস নিজে থেকেই নিরাময় হয়, চিকিৎসা লাগে না। লাইফস্টাইল পরিবর্তনের মাধ্যমে সহজেই পাইলস নির্মূল সম্ভব।
স্টুল যত শক্ত হবে পাইলসের জন্যে তা তত খারাপ। তাই স্টুল স্বাভাবিক হওয়ার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। এজন্যে ফলমূল ও শাকসবজিসহ এমন খাবার খান যা অধিক আঁশসমৃদ্ধ। পান করুন পর্যাপ্ত পানি। ঝরিয়ে ফেলুন বাড়তি ওজন।
তবে এতেও যদি কাজ না হয় বা অবস্থা জটিল রূপ ধারণ করে তাহলে মেডিকেল ট্রিটমেন্ট নিন। অনেক সময় রোগের গ্রেড দেখে ও কিছু পরীক্ষা করে চিকিৎসক যদি মনে করেন অপারেশন করতে হবে তখন অপারেশন করতে হবে।
তবে প্রতিকারের চেয়ে প্রতিরোধের পথে হাঁটাই অধিক নিরাপদ।
পাইলস প্রতিরোধে সুস্থ খাদ্যাভ্যাস ও স্বাস্থ্যসম্মত জীবনাচার জরুরি। এজন্যে কিছু করণীয়-বর্জনীয়-
*একনাগাড়ে লম্বা সময় চেয়ারে বসে থাকলে মলদ্বার সংলগ্ন জায়গাগুলোয় রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়ে পাইল সৃষ্টি করে। তাই পড়ালেখা বা কাজের ফাঁকে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান, হাঁটাহাঁটি করুন। আরও ভালো হয় যদি দাঁড়িয়ে পড়ালেখা বা কাজের পরিবেশ তৈরি করেন;
*রিফাইন্ড কার্ব যথাসম্ভব বর্জন করুন। ময়দা ও সাদা আটার বদলে লাল আটা, সাদা চালের বদলে লাল চাল- অর্থাৎ ব্র্যান বা খোসাসমেত খাবার খাওয়ার অভ্যাস করুন। ডায়েটে রাখুন পর্যাপ্ত আঁশসমৃদ্ধ ফলমূল ও সবজি।
*মেদ ঝরান। চেহারায় লাবণ্য বাড়ার পাশাপাশি কমবে পাইলসের ঝুঁকি। তবে বেশি ভারী বস্তু ওঠানো থেকে বিরত থাকুন।
*টয়লেট করার সময় বেশি চাপ দেবেন না। কারণ টয়লেটের সময় মলদ্বারের ওপর যত বল প্রয়োগ করবেন তত শিরা বাইরের দিকে বেরিয়ে এসে পাইলস সৃষ্টি করবে।
*কয়েকটি যোগাসন নিয়মিত চর্চা করার মাধ্যমে আপনি পাইলস প্রতিরোধ করতে পারেন। যেমন- গোমুখাসন, সর্বাঙ্গাসন, শীর্ষাসন, সুপ্ত ভদ্রাসন, অশ্বিনীমুদ্রা (বিপরীত করণীতে/ গোমুখাসনে/ বজ্রাসনে)। পাইলস প্রতিরোধে আরেকটি কার্যকরী আসন হলো বঙ্গাসন। প্রতিদিনের ঘরোয়া কাজ আপনি বঙ্গাসনে বসে অনায়াসে করতে পারেন।
লেখক: সহযোগী অধ্যাপক (কলোরেক্টাল সার্জারি বিভাগ) কলোরেক্টাল, লেপারোস্কপিক ও জেনারেল সার্জন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
চেম্বার: ১৯ গ্রীন রোড, এ.কে.কমপ্লেক্স, লিফ্ট-৪, ঢাকা।
ফোন: ০১৭১২৯৬৫০০৯