ঢাকা, ২৩ জানুয়ারি ২০২৫, বৃহস্পতিবার, ৯ মাঘ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২২ রজব ১৪৪৬ হিঃ

মত-মতান্তর

হাসিনার পতন এবং অতঃপর

মারুফ কামাল খান

(৫ মাস আগে) ১৮ আগস্ট ২০২৪, রবিবার, ৩:২৪ অপরাহ্ন

সর্বশেষ আপডেট: ১২:০৯ পূর্বাহ্ন

mzamin

মিথ্যাচার, সন্ত্রাস, মেকি অভিনয় ও চক্রান্তের ওপর ভর করে হাসিনার উত্থান আমি দেখেছি। হত্যা, জুলুম, দম্ভ ও ভণ্ডামিতে ভরা তার ভয়ঙ্কর স্বৈরশাসনের করুণ শিকার হয়েছি সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশবাসীর সঙ্গে আমিও। স্বৈরাচারের হত্যাযজ্ঞে ক্রোধোন্মত্ত ছাত্র-তরুণ-জনসাধারণের রক্তমাখা মহাজাগরণে আমি তার পতন ও পলায়ন দেখেছি। এখন বাংলাদেশে দানবের ওপর মানবের বিজয়কে সংহত করার কঠিন সময়। এই চ্যালেঞ্জও সাফল্যের সঙ্গে মোকাবেলা করা ছাড়া জাতির সামনে আর কোনো বিকল্প নেই।

যুদ্ধজয় শেষ কথা নয়। জনগণের স্বতঃষ্ফূর্ত অংশগ্রহণে সাধিত বিপ্লবে অর্জিত বিজয়কে সংহত করে গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবার দায়িত্ব নেতৃত্বের ও সমাজের অগ্রণী অংশের। সে দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে ব্যর্থ হবার সুযোগ নেই।

১৯৭১ সালের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ সর্বস্তরের মানুষ অংশগ্রহণে জাতীয় গণযুদ্ধে উন্নীত হয়েছিল। বিজয়ের পর মুক্তিযোদ্ধারা ফিরে গিয়েছিলেন নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে। সে বিজয়কে একটিমাত্র দল কুক্ষিগত ও আত্মস্থ করে গণমানুষের আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্নকে হত্যা করেছিল অচিরেই। দুর্ভিক্ষ, দুঃশাসন, হত্যা, নির্যাতন ও গণতন্ত্র হত্যায় তারা নিজেদের শাসনের ইতিহাসকে করেছিল কলঙ্কিত। স্বাধীনতাকে করে তুলেছিল অর্থহীন। তাই স্বাধীনতার লক্ষ্য পূরণে এদেশে বারবার রক্তসিক্ত পরিবর্তন আনতে হয়েছে। পঁচাত্তর, নব্বই সাল আমাদের জাতীয় ইতিহাসের শোণিতাক্ত পরিবর্তনের একেকটি বাঁক।

প্রতিটি সফল অভ্যুত্থানের পরেই গণমানুষ আবার তাদের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে ফিরে যাবার পর নেতৃত্বের ব্যর্থতা, ভুল বা লিপ্সায় সে বিপ্লব বারবার বেহাত হয়েছে এদেশে। সেই ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে আমাদেরকে সচেতন পদক্ষেপ নিতে হবে যাতে চব্বিশের মহাগণবিপ্লবও আবার বেহাত ও ব্যর্থ হয়ে না যায়।

হাসিনা বাংলাদেশে তার দেড় দশকব্যাপী স্বৈরশাসনের ভিত্তি গড়েছিলেন ব্যক্তিপূজা, বিকৃত ইতিহাস ও কল্পনাশ্রয়ী রূপকথা মিশ্রিত কাল্ট রচনার মাধ্যমে। জনগণকে গৌণ করে এবং ব্যক্তিপূজার পৌত্তলিকতাকে মহিমামণ্ডিত করে হাসিনা সব ভিন্নমত দমিয়ে দিয়ে একক মত প্রতিষ্ঠার এক নিষ্ঠুর শাসন প্রবর্তন করেছিলেন।

রাষ্ট্রের সব বাহিনীকে ব্যক্তিগত বা দলীয় লাঠিয়ালে পরিণত করে মধ্যযুগীয় সামন্ততান্ত্রিক এক পারিবারিক জমিদারি কায়েম করেছিলেন। সব ক্ষমতা একক হাতে কুক্ষিগত করে জাতীয় গণযুদ্ধে অর্জিত রাষ্ট্রকে ব্যর্থ করে দিয়েছিলেন। দেদার বৈদেশিক ঋণ ও জনগণের ওপর যথেচ্ছ করারোপ করে উন্নয়নের নামে ইট-কাঠ-কংক্রিটের বিভিন্ন কাঠামো বানাতে গিয়ে ব্যয়ের এক বিপুল অংশ তারা অবাধে লুণ্ঠন করেছেন। দেশে-বিদেশে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। দরিদ্র মানুষের দেশের শাসকদের বিপুল বিত্ত-বৈভব ও ভোগ-বিলাস আধুনিক যুগেও রাজন্যসুলভ রূপকথার জন্ম দিয়েছে।

এখন সেই ব্যর্থরাষ্ট্রের ভস্মস্তুপের উপর আধুনিক এক মানবিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হবে। ধীরলয়ের কোনো সংস্কার নয়, এজন্য প্রয়োজন হবে বৈপ্লবিক দ্রুতির। পুরনো ধ্যানধারণা দিয়ে নয়, একুশ শতকের মুক্ত আলোকিত উদার চিন্তার প্রতিফলন ঘটাতে হবে সবখানে। প্রতিটি ব্যক্তিকে, তিনি যতো মহিমান্বিতই হোন, করতে হবে সমষ্টির অধীন। জনগণের মতামত ও সম্মিলিত মেধার প্রয়োগের সুযোগ অবাধ ও অবারিত করতে হবে। দলীয় সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে দেশ-জাতির স্বার্থকে অগ্রাধিকার দেয়ার বাচনিকতাকে বাস্তবে করতে হবে রূপায়িত। ব্যক্তিগত ও পারিবারিক কাল্ট কেন্দ্রিক পৌত্তলিকতার স্থলে বহুবাচনিক ও বহুমতের সমাজ গড়ে তুলতে হবে। জাতীয় জীবনে দ্রুত গড়ে তুলতে হবে শ্রমঘন এক কর্মযজ্ঞের সংস্কৃতি।

সকলকে জবরদস্তি করে একমতে আনার ফ্যাসিবাদী ধারার অবসান ঘটিয়ে বৈচিত্রের মধ্যে জাতীয় ঐক্য গঠনকে নীতি হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। আনুগত্য ও স্তুতিকে দূরে সরিয়ে জ্ঞান, মেধা, প্রজ্ঞা, যোগ্যতা, আন্তরিকতা ও সততাকে দিতে হবে অগ্রাধিকার। মণিকাঞ্চনযোগ ঘটাতে হবে অভিজ্ঞতা ও তারুণ্যের প্রাণশক্তির।

ফ্যাসিবাদ ও স্বৈরশাসনের পুনরাবির্ভাব রোধে রাষ্ট্রীয় প্রথা ও প্রতিষ্ঠান সমূহের পুনর্গঠনের পাশাপাশি পতিত রেজিমের গুরুতর অপরাধ ও অপকর্মসমূহের বিচার ও দৃষ্টান্তমূলক সাজা নিশ্চিত করতে হবে।

অতীতের দু'টি ব্যর্থতা আমাদের মনে রাখতে হবে এবং সেই ভুল থেকে শিক্ষা নিতে হবে। মুক্তিযুদ্ধ এবং প্রতিটি পরিবর্তনের পর আমরা পরাজিত অপশক্তির অন্যায়-অপরাধ-অপকর্মের উপযুক্ত বিচার ও সাজা নিশ্চিত করতে পারিনি। আর প্রতিটি লড়াইয়ের শহীদ, যোদ্ধা ও ক্ষতিগ্রস্তদের উপযুক্ত মূল্যায়ন আমরা করিনি, মর্যাদা দিইনি বরঞ্চ তাদেরকে ভুলে গিয়েছি, করেছি উপেক্ষা ও অবহেলা। এবারে যেন তার পুনরাবৃত্তি না ঘটে।

(লেখক পরিচিতি: মারুফ কামাল খান, লেখক ও সাংবাদিক)

পাঠকের মতামত

আমার মতে একটানা দেশের নেতৃত্ব দেওয়াটা শেখ হাসিনার ভুল হইয়াছে। কারণ শেখ হাসিনার কেবিনেটে যারা ছিল তারা লুটপাট করতে সুবিধা হইয়াছে। যার ফলে শেখ হাসিনার কেবিনেটে ভালো লোক পরে আসতে পারে নাই। আর যাদেরকে নিয়ে কেবিনেটে বসে ছিল তাঁরা শেখ হাসিনা কে ভালো উপদেশ দেয় নাই।

মোঃফরিদ মিয়া
১৮ আগস্ট ২০২৪, রবিবার, ১০:২০ অপরাহ্ন

স্বৈরাচারের পুনরাবৃত্তি যেন না ঘটে সেদিকে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে। সন্ত্রাসী চাঁদাবাজি ভুঁইফোঁড় সংঘটনের নামে কোন বদমায়েশ যেন মাথা চারা দিয়ে উঠতে না পারে সেদিকে সবাইকে সজাগ থাকতে হবে।

Md Manirul Islam Sar
১৮ আগস্ট ২০২৪, রবিবার, ৫:৩৯ অপরাহ্ন

শুধু শুধু একক ভাবে স্বৈরাচার শেখ হাসিনাকে দোষারোপ করলেই চলবে না। এর পূর্বের সরকার গুলিই স্বৈরাচার দিয়ে শুরু করেছে। অর্থাৎ তৃতীয় বিশ্বের মানবতাহীন স্বার্থবাদী ব্যক্তিরাই স্বৈরাচারক হয়। এবং এদের বিদায় এভাবেই হয়। কেউ এরচেয়ে আরো ভয়াবহ হয়।

Khokon
১৮ আগস্ট ২০২৪, রবিবার, ৪:৩১ অপরাহ্ন

যথার্থ লিখেছেন, ধন্যবাদ আপনাকে।

রহমান
১৮ আগস্ট ২০২৪, রবিবার, ৪:০০ অপরাহ্ন

মত-মতান্তর থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

Bangladesh Army

মত-মতান্তর সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status