ঢাকা, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

খোলা চোখে

অতঃপর হাতে হারিকেন...

রুমিন ফারহানা
১৮ জুলাই ২০২২, সোমবার
mzamin

খাতটি বিদ্যুৎ হোক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠান- সরকারের মূল লক্ষ্য আসলে একটাই। ইনডেমনিটি দিয়ে হোক, নতুন নতুন আইন তৈরি করে হোক কিংবা বিদ্যমান আইন পরিবর্তন করে হোক তাকে ক্ষমতায় আনা এবং ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করা কিছু অলিগার্কের হাতে অবিশ্বাস্য পরিমাণ অর্থ তুলে দেয়া। জনগণের কাছে জবাবদিহিতার বালাই যেহেতু নাই এমন কি পাঁচ বছর পরপর ভোট দিয়ে সরকার গঠনের ক্ষমতাও যেহেতু তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে সুতরাং সরকারের সত্যিই কোনো ঠ্যাকা পড়েনি মানুষের কথা ভাববার, মানুষের স্বার্থ দেখবার। তার চেয়ে বরং টিকে থাক অলিগার্ক


জ্বি! ঠিক তাই। অতঃপর হাতে হারিকেন। নিন্দুকেরা বলছে ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ আর প্রয়োজনের দ্বিগুণ বিদ্যুৎ উৎপাদন নিয়ে গর্ব করা সরকারের হলো কি হঠাৎ? মানুষকে তার ভোটাধিকার বঞ্চিত করা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, গুম, খুন, বিচারবহির্ভূত হত্যা, হেফাজতে নির্যাতন, বিরোধী মত দমনের মতো যা কিছু নিয়েই প্রশ্ন করা হোক না কেন সরকারের তরফে উত্তর ছিল একটিই- ‘উন্নয়ন’। এমন কি ঘোষণা দিয়ে গণতন্ত্র আর উন্নয়নকে পরস্পরের মুখোমুখি দাঁড় করাতেও মুহূর্তমাত্র দ্বিধা করেনি। যদিও সরকারের উন্নয়নের সংজ্ঞা বরাবরই ছিল ভারী সংকুচিত। মূলত প্রবৃদ্ধি, মাথাপিছু আয়, রিজার্ভ, কিছু অবকাঠামো নির্মাণ আর বিদ্যুৎ- সরকারের বয়ানে এই হলো ‘উন্নয়ন’।  এই সব কিছুর মধ্যে বিদ্যুৎ নিয়ে সরকারের গলাবাজি ছিল দেখার মতো।

বিজ্ঞাপন
গত ২১শে মার্চ প্রধানমন্ত্রী যখন শতভাগ বিদ্যুতায়নের ঘোষণা দেন তখনই সরকারি দলের তরফ থেকে বিএনপি’র অ্যাকটিং চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একটা পুরনো সাক্ষাৎকার ফেসবুকে ভাইরাল করা হয়। যেখানে তিনি বলেছিলেন সন্ধ্যায় পিক আওয়ারে বাসাবাড়ি এবং মার্কেটে একসঙ্গে বিদ্যুৎ দেয়া কোনো সরকারের পক্ষেই সম্ভব নয়।

 এটি নিয়ে ব্যাপক ব্যঙ্গ বিদ্রূপও করেছিল সরকারি দল। এমনকি স্বনামধন্য এক বিদেশি চ্যানেলের বেশ আলোচিত একজন উপস্থাপকও ভিডিওটির প্রসঙ্গ টেনে বারবার আমাকে ব্যঙ্গ করছিলেন। এরপর ৩ মাসও পার হয়নি। গত ১৮ই জুন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় প্রজ্ঞাপন জারি করে বলে- ‘বিশ্বব্যাপী জ্বালানির অব্যাহত মূল্যবৃদ্ধির কারণে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সাশ্রয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রী নির্দেশনা দিয়েছেন। বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ এর ১১৪ ধারার বিধান কঠোরভাবে প্রতিপালন করে সারা দেশে রাত ৮টার পর দোকান শপিংমল মার্কেট বিপণি বিতান কাঁচাবাজার ইত্যাদি  খোলা না রাখার বিষয়টি যথাযথ ভাবে নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করা হলো’।

 গত ১১ বছরে বিদ্যুৎ খাতে কি ভয়াবহ লুট চলেছে, কীভাবে মানুষের পকেট কেটে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে দেয়া হয়েছে সরকারের ঘনিষ্ঠ কিছু চক্রের হাতে সেটি নিয়ে নিশ্চয় একদিন নিরপেক্ষ তদন্ত হবে। তার আগে শুধু বলে রাখি গত ১১ বছরে বিদ্যুতের পাইকারি দাম বেড়েছে ১১৬ শতাংশ আর গ্রাহক পর্যায়ে ৯০ শতাংশ। ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎ সংকট মোকাবিলার নামে একটা আইন করে যেটি ‘বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০’ নামে পরিচিত। সোজা বাংলায় বলতে গেলে এটি আসলে বিদ্যুতের কুখ্যাত ইনডেমনিটি বা দায়মুক্তির আইন। এই আইনের অধীনে সরকার যে কারও সঙ্গে ভাড়াভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের চুক্তি করতে পারবে কোনো রকম দরপত্র আহ্বান ছাড়াই এবং সরকারি ক্রয়প্রক্রিয়ার অন্যসব পদক্ষেপকে পুরোপুরি পাশ কাটিয়ে। এই সব চুক্তির অধীনে নেয়া কোনো পদক্ষেপ কখনোই কোনো আদালতে চ্যালেঞ্জও করা যাবে না। এরপর শুরু হয় তেলভিত্তিক কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের প্রতিযোগিতা।

 বলাই বাহুল্য এগুলো সব স্থাপন করে সরকারের সঙ্গে অতি সুসম্পর্ক থাকা হাতেগোনা কিছু মানুষ (অলিগার্ক)। এসব কেন্দ্র থেকে উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কেনার সঙ্গে সঙ্গে তাদের দিতে হয় নির্দিষ্ট ভাড়া (ক্যাপাসিটি চার্জ)। বিদ্যুৎ উৎপাদন হোক কিংবা না হোক ভাড়া বা ক্যাপাসিটি চার্জ দেয়া বাধ্যতামূলক। এক মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন না করেও হাজার হাজার  কোটি টাকা কুইক রেন্টাল কোম্পানির মালিকদের (ক্ষমতাসীনদের অলিগার্ক) হাতে তুলে দেয়ার নামে রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটের কথা জানে যেকোনো সচেতন নাগরিক। বলা হয়েছিল বিশেষ আইনের অধীনে বিদ্যুৎকেন্দ্র হবে কেবল দুই বছরের জন্য, আপদকালীন সময়টা সামাল দেয়া পর্যন্ত। এই সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রীয় মালিকানায় গ্যাস এবং কয়লাভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্র তৈরি করে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলো বন্ধ করে দেয়া হবে। শুরুতে ২ বছরের কথা বলে আইনটি করা হলেও এই আইনের মেয়াদ বাড়তে বাড়তে ১৬ বছরে এসে ঠেকেছে। অথচ দেশে বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনের ক্ষমতা সর্বোচ্চ চাহিদার প্রায় দ্বিগুণ। 

এখনো রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কম ব্যয়ের বিদ্যুৎকেন্দ্র বসিয়ে রেখে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র চালিয়ে কয়েক গুণ বেশি দামে বিদ্যুৎ কেনা হয় শুধুমাত্র কিছু ব্যক্তির হাতে অবিশ্বাস্য অঙ্কের টাকা তুলে দেয়ার জন্য। গত ১০ বছরে কুইক রেন্টাল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোকে ক্যাপাসিটি চার্জই দেয়া হয়েছে ৭০ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়াও এদের কাছ থেকে অতি উচ্চমূল্যে বিদ্যুৎ কেনার কারণে দেশের ইউনিট প্রতি গড় উৎপাদনমূল্য অনেক বেশি হয়ে যাবার প্রেক্ষাপটে সরকারকে বিদ্যুৎ খাতে বিশাল অঙ্কের ভর্তুকি দিতে হয়েছে প্রতি বছর। এতে আওয়ামী লীগের ক্ষমতায় থাকার সময়ে মানুষকে শুধু ১১ বার বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধির ধাক্কাই সইতে হয়নি সেই সঙ্গে ভর্তুকি দিতে দিতে বিদ্যুৎ খাতও এখন পঙ্গু প্রায়। আগে যদি এত ভর্তুকি দিতে না হতো, তাহলে আজ সংকটের সময় সরকারের ভর্তুকি দেয়ার সামর্থ্য থাকতো।  ২০১০ সালে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যেখানে দেশীয় গ্যাসের ওপরে নির্ভরশীলতা ছিল প্রায় ৯০ শতাংশ, সেটি কমতে কমতে ২০২২ সালে এসে দাঁড়ায় ৫০ শতাংশে। এর মূল কারণ দেশে নিজস্ব গ্যাস উৎপাদনের হার কমে যাওয়া এবং এর অনিবার্য পরিণতিস্বরূপ আমদানি করা অতি উচ্চ মূল্যের এলএনজির ব্যবহার। 

দেশীয় গ্যাসের সঙ্গে আমদানিকৃত এলএনজির মূল্যের তুলনাতেই স্পষ্ট হবে কেন দেশীয় গ্যাসের আবিষ্কার এবং সংরক্ষণ অতি জরুরি ছিল আমাদের জ্বালানির নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে। প্রতি ইউনিট দেশীয় গ্যাসের দাম যেখানে ২ থেকে ৩ ডলার সেখানে আমদানি করা গ্যাসের জন্য দাম দিতে হয় ১২ ডলার, তাও যদি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি হয়। আর যদি অনিশ্চিত স্পট মার্কেট থেকে কিনতে হয়, তাহলে সে দাম গিয়ে দাঁড়াতে পারে যেকোনো জায়গায়, যা বর্তমানে ৩৫ থেকে ৪১ ডলার। এমনকি স্পট মার্কেটের এই দাম ১০০ ডলারে উঠলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। এখানে বলে রাখা ভালো আমাদের সঙ্গে এলএনজি আমদানির দীর্ঘ মেয়াদি চুক্তি আছে কেবল দুটি দেশের-কাতার এবং ওমান।  এ বছর দিনে ৮৫ কোটি ঘনফুট গ্যাস আমদানির লক্ষ্যমাত্রা আছে পেট্রোবাংলার। এর মধ্যে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার ও ওমান থেকে পাওয়া যাবে ৪৬ কোটি ঘনফুট। বাকি ৩৯ কোটি ঘনফুট কিনতে হবে খোলাবাজার থেকে। অর্থাৎ প্রায় ৫০ শতাংশ কিনতে হবে খোলা বাজার থেকে, যা করোনার কারণে গত বছর ছিল মাত্র ২০ শতাংশ। দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির অধীনে বাংলাদেশ ১০ ডলার দামে প্রতি ইউনিট গ্যাস পাচ্ছে আর খোলা বাজারে গ্যাসের দাম ওঠানামা করে। এখন খোলা বাজারে এলএনজির প্রতি ইউনিট ৪০ ডলার ছাড়িয়ে যাবার প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ সেই গ্যাস আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। সামপ্রতিক বিদ্যুৎ সংকটের পেছনে এটাই প্রধান কারণ। 

প্রশ্ন হচ্ছে, বাংলাদেশ কেন তার চাহিদার সঙ্গে সম্পর্ক রেখে দীর্ঘমেয়াদি গ্যাস আমদানির চুক্তি করেনি? তাহলে তো আর আমাদের এই মাশুল দিতে হতো না। এখন এটা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় খোলা বাজারে এলএনজির এই অতি উচ্চ মূল্যের কারণে দীর্ঘমেয়াদি কোনো সুবিধাজনক চুক্তি বাংলাদেশ করতে পারবে না। আছে আরও ভয়ঙ্কর সংকটের পদধ্বনি। ইউক্রেনের উপরে রাশিয়ার আগ্রাসনের পরিপ্রেক্ষিতে ইউরোপ রাশিয়ার ওপরে তার জ্বালানি নির্ভরতা কমানোর জন্য সব রকম পদক্ষেপ নিতে শুরু করেছে। এ ছাড়াও রাশিয়ার দিক থেকেও ইউরোপের ওপরে চাপ তৈরি করার জন্য গ্যাস সরবরাহ কমানো হচ্ছে। সার্বিক পরিস্থিতিতে ইউরোপকে গ্যাসের জন্য অন্যান্য উৎসের সন্ধানে যেতেই হবে এবং সেই প্রক্রিয়া শুরু হয়েও গেছে। ফলে গ্যাসের দাম যেমন আরও বাড়বে তেমনি ইউরোপের শক্তিশালী দেশগুলোকেই গ্যাস দেবে গ্যাস উৎপাদনকারী দেশগুলো।

সুতরাং বাংলাদেশের পক্ষে কোনো দেশের সঙ্গে নতুন করে দীর্ঘমেয়াদি গ্যাস আমদানির চুক্তি করার কোনো সম্ভাবনা আছে বলে মনে হয় না।  গ্যাস আমদানির আলোচনাটা করলাম সামপ্রতিক সংকটের পরিপ্রেক্ষিতে। মূল সংকট আসলে নিজেদের জ্বালানি নিরাপত্তা অভ্যন্তরীণভাবে নিশ্চিত করার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও সেটা না করা। দেশের ভূ-ভাগে গ্যাস অনুসন্ধান একেবারেই কমিয়ে দেয়া হয়েছে। ভারত এবং মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নিষ্পত্তি হওয়ার পর বঙ্গোপসাগরে আমাদের এক্সক্লুসিভ ইকোনমিক জোনে গ্যাস অনুসন্ধান করে উত্তোলন শুরু হয়ে যাবার কথা ছিল আরও অনেক আগেই। মিয়ানমার সেটা করছে কয়েক বছর থেকেই।  নিজ দেশে পর্যাপ্ত গ্যাস প্রাপ্তির যথেষ্ট সম্ভাবনার পরও বাংলাদেশের জ্বালানির কৌশলপত্রে এলএনজি আমদানিকেই পথ হিসেবে দেখানো হয়েছে। মজার ব্যাপার প্রতিবছর এলএনজি আমদানির কারণে যে তিন থেকে পাঁচ হাজার কোটি টাকা (যা সময়ের সঙ্গে আরও বাড়বেই) ভর্তুকি সরকারকে দিতে হয় সেই টাকাটা গ্যাস অনুসন্ধান এবং উত্তোলনে ব্যয় করলে দেশ তার নিজের গ্যাসেই জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারতো। বাংলাদেশ যে গ্যাস সম্পদে বিপুলভাবে সমৃদ্ধ সেটি বিভিন্ন আন্তর্জাতিক জরিপে উঠে এসেছে। 

২০০১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ইউএসজিএস পেট্রোবাংলার সঙ্গে  যৌথ জরিপে  দেখা যায় যে বাংলাদেশে অনাবিষ্কৃত গ্যাস সম্পদের গড় পরিমাণ ৩২ টিসিএফ। একই সময় নরওয়ের জাতীয় তেল ও গ্যাস কোম্পানি এনডিপি বাংলাদেশ সরকারি এজেন্সির সঙ্গে সম্পাদিত জরিপে দেখা যায় যে দেশে অনাবিষ্কৃত গ্যাস সম্পদের গড় পরিমাণ ৪২ টিসিএফ। ২০১৮ সালে ডেনমার্কের গ্যাস পরামর্শ জরিপে দেখা যায় যে, এর পরিমাণ ৩৪ টিসিএফ। এরা সবাই যে এ বিষয়ে একমত তাহলো, বাংলাদেশে যথেষ্ট মাত্রায় গ্যাস অনুসন্ধান না হওয়ার কারণে গ্যাস সংকট তৈরি হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে গ্যাস সম্পদের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের সর্বাপেক্ষা কম অনুসন্ধানকৃত দেশগুলোর একটি। এলএনজি আমদানি, সেটা খালাস এবং গ্যাসে রূপান্তরের টার্মিনাল ব্যবসা ইত্যাদির সঙ্গে সরকারের অতি গুরুত্বপূর্ণ, ক্ষমতাশালী অলিগার্করা জড়িত, এটাই কি দেশের নিজস্ব সম্পদ অনুসন্ধান এবং উত্তোলন করতে অনীহার প্রধান কারণ? দেশের বিদ্যুৎ এবং জ্বালানি খাতকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখলে চলবে না, দেখতে হবে অন্যান্য খাতের সঙ্গে মিলিয়ে। এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে ব্যাংকিং খাত। এই খাতে একের পর এক ব্যাংক লুট হয়েছে। 

বর্তমান সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম মেয়াদেই সোনালী ব্যাংকের হলমার্ক কেলেঙ্কারি, বেসিক ব্যাংক কেলেঙ্কারি প্রকাশিত হয়েছে আমাদের সামনে। এরপর একে একে ফার্মার্স ব্যাংক, কয়েকটি ব্যাংকবহির্ভূত ফিন্যান্সিয়াল প্রতিষ্ঠানে পিকে হালদারের কেলেঙ্কারি আর সর্বশেষ আমাদের সামনে এসেছে ইউনিয়ন ব্যাংক কেলেঙ্কারির কথা। ব্যাংকিং খাতে লুটপাট চালানোর জন্য সরকার একের পর এক আইন এবং বিধি বদলে ফেলেছে, বাংলাদেশ ব্যাংককে দুর্বল করেছে ক্রমাগত। এসবই করেছে কিছু অলিগার্কের হাতে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে দেয়ার জন্য। শুধু সেটাই নয়, সামান্য টাকা পরিশোধ করে ইচ্ছাকৃত ঋণ খেলাপিদের ঋণ পুনঃতফশিল করে নতুন ঋণ পাবার ব্যবস্থাও করে দেয়া হয়েছে। নানা কায়দায় সরকার খেলাপি ঋণ লুকিয়ে ফেলার চেষ্টা করেছে, করছে এখনো। তাই সরকার বলার চেষ্টা করে খেলাপি ঋণের পরিমাণ এখন এক লক্ষ কোটি টাকার কিছু বেশি। অথচ ২০২০ সালেই আইএমএফ তার এক রিপোর্টে বাংলাদেশের প্রকৃত খেলাপি ঋণ প্রায় আড়াই লাখ কোটি টাকা বলে জানিয়েছিল। 

আর খেলাপি ঋণ নিয়ে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা করা অর্থনীতিবিদ ড. মইনুল ইসলাম জানান, অবলোপনকৃত, আদালতের স্থগিতাদেশ নেয়া, নামমাত্র পেমেন্টে পুনঃতফশিল করাসহ নানা কৌশলে লুকিয়ে রাখা খেলাপি ঋণ প্রায় ৪ লাখ কোটি টাকা। তিনি এটাও জানান, এরা সব ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি অর্থাৎ এরা ব্যাংক থেকে টাকা তুলে নিয়ে গিয়েছেন সেটা আর কখনো ফেরত দেবেন না বলেই। একটা তথ্য এখানে যুক্ত করে রাখি, ড. মইনুল কোনোভাবেই সরকারবিরোধী পক্ষের অর্থনীতিবিদ নন।  পরিশেষে বলি খাতটি বিদ্যুৎ হোক কিংবা আর্থিক প্রতিষ্ঠান- সরকারের মূল লক্ষ্য আসলে একটাই। ইনডেমনিটি দিয়ে হোক, নতুন নতুন আইন তৈরি করে হোক কিংবা বিদ্যমান আইন পরিবর্তন করে হোক তাকে ক্ষমতায় আনা এবং ক্ষমতায় থাকতে সাহায্য করা কিছু অলিগার্কের হাতে অবিশ্বাস্য পরিমাণ অর্থ তুলে দেয়া। জনগণের কাছে জবাবদিহিতার বালাই যেহেতু নাই এমন কি পাঁচ বছর পরপর ভোট দিয়ে সরকার গঠনের ক্ষমতাও যেহেতু তাদের কাছ থেকে কেড়ে নেয়া হয়েছে সুতরাং সরকারের সত্যিই কোনো ঠ্যাকা পড়েনি মানুষের কথা ভাববার, মানুষের স্বার্থ দেখবার। তার চেয়ে বরং টিকে থাক অলিগার্ক, হোক আরও শক্তিশালী। কারণ সরকার টিকিয়ে রাখার মূল রসদ তো তারাই যোগাড় করে। 

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status