ঢাকা, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, বুধবার, ৬ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৯ শাবান ১৪৪৬ হিঃ

শেষের পাতা

তারা বিশ্বাসের লুটপাটের অজানা কাহিনী

রাশিদুল ইসলাম, খুলনা থেকে
১৩ জুলাই ২০২৪, শনিবারmzamin

 খুলনার ডুমুরিয়া উপজেলার সরাফপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান রবিউল  ইসলাম রবি হত্যাকাণ্ডে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য আজগর আলী তারা বিশ্বাস গ্রেপ্তার হওয়ার পর বেরিয়ে আসছে তার লুটপাট ও জমি দখলের অজানা কাহিনী। হত্যা মামলায় ডুমুরিয়া থানার পুলিশ পাঁচদিনের রিমান্ডে নিয়েছে তারা বিশ্বাসকে। গতকাল ছিল রিমান্ডের তৃতীয় দিন । দীর্ঘদিন খুলনা মহানগরীর উপকণ্ঠ ডুমুরিয়ার বিলপাবলা, গুটুদিয়া, মোস্তর মোড় এলাকার সাধারণ মানুষ তারা বিশ্বাস ও  তার বাহিনীর কাছে ছিল জিম্মি। তাদের অত্যাচারে বসতবাড়ি ছেড়ে অন্যত্রে চলে গেছে এমন পরিবারের সংখ্যা অনেক। নির্যাতিতরা  এতদিন কেউ  মুখ খুলতে সাহস পায়নি। সোমবার তারা বিশ্বাস গ্রেপ্তার হওয়ার পর ভুক্তভোগীরা সংঘবদ্ধ হয়ে বিচারের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল, মানববন্ধন, সভা-সমাবেশ অব্যাহত রেখেছেন।

ভুক্তভোগীদের মধ্যে কথা হয় ডুমুরিয়া উপজেলার পূর্ববিল পাবলা এলাকার নারায়ণ চন্দ্র বিশ্বাসের সঙ্গে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা আজগর বিশ্বাস তারা প্রতারণার মাধ্যমে ০.২৫ একর জমি ৫০ লাখ টাকা দাম ঠিক করে নিজের নামে পাওয়ার দলিল করে নেন। সে সময় তিনি বলেন, জমি বিক্রি করে তোমাকে টাকা দিয়ে দেবো। কিন্তু তিনি প্লট আকারে জমি বিক্রি করলেও আজ পর্যন্ত আমার পাওনা টাকা দেননি। আমি টাকা ফেরত পেতে মন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ ও জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট সুজিত অধিকারীর কাছে লিখিত আবেদন করে দ্বারে দ্বারে ঘুরছি। কিন্তু প্রতারক তারা বিশ্বাস এখন বলছে- তোকে আমি চিনি না। তার ভয়ে আমি দীর্ঘদিন দেশের বাহিরে ছিলাম। আমি এই ভূমিদস্যু তারা বিশ্বাসের বিচার চাই। আমার পাওনা টাকা ফেরত চাই। 

আরেক মৎস্য ঘের ব্যবসায়ী রায়েরমহল এলাকার মোল্লা জিহাদুল ইসলাম বলেন, চক আসানখালী মৌজায় আরএস দাগ নম্বর-১২৮২ ও ১২৮০ নম্বর দাগের ঘেরটি দখল করে বাঁশের বেড়া দিয়ে আটকে আমার মৎস্য ঘেরের ভেতরে বালু ফেলে ৫ লাখ টাকার মাছ লুট করে নিয়ে যায় তারা বিশ্বাস। এ ঘটনায় অভিযোগ দেয়া হলে আদালতের নির্দেশে বালু ফেলা বন্ধ রয়েছে। কিন্তু আমরা জমির কাছে যেতে সাহস পাচ্ছি না। 

একইভাবে আশা, আলমগীর ও বাবুর ২৮ শতক জমি দখল করে নিয়েছে তারা ও তারেক বিশ্বাস। এ ছাড়া বয়রার আতিয়ার দারোগার ছেলে মনিরের বাঁশতলা এলাকার ৫০ শতাংশ জমি এবং রেললাইনের পাশের জমি দখল করে নিয়েছে। মনির বলে তারা বিশ্বাসের দখলে রয়েছে সাধারণ মানুষের হাজার হাজার বিঘা জমি। এবার এ জমি উদ্ধার করে ফিরিয়ে দেয়া উচিত। একই ভাবে সাজ্জাদ মীরের কৈয়া রায়ের মহল সড়কের মাদ্রাসার পাশে, কালাম কমিশনারের রায়ের মহল বাজার এলাকার ৫ বিঘা জমি দখল করে নিয়েছে ভূমিদস্যু তারা। হ্যাচারি রোডের স্কুলের পাশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মল্লিকদের ফসলি জমিতে বালু ফেলে দখল করে নিয়েছে। মল্লিক বাবু ফেরত পেতে খুলনার আওয়ামী লীগের নেতাদের বাড়ি বাড়ি ঘুরে বেড়িয়েছেন কিন্তু কোনো ফায়দা পাননি। রায়ের মহল মোস্তর মোড় এলাকার চর হাসানখালী মৌজায় আজিবর মোল্লা, সেলিনা খাতুন, শামিমা, ফরিদা, মাহমুদ হোসেন, আসমা বেগম, মনোয়ার, ফারুক হোসেন, জসিমসহ ১৫ জন ছিন্নমূল মানুষ ৮৬ শতক জমি কেনেন। রাতের আঁধারে সন্ত্রাসীদের দিয়ে এদের সাইনবোর্ড ভেঙে জমি দখলে নেয় তারা বিশ্বাসের লোকজন।

রায়ের মহল উত্তরপাড়া দাউদ শেখের ছেলে বেলালের জমি দখলে বাধা দিলে তারা বিশ্বাস নিজে ফিল্মি স্টাইলে হামলা করে বেলালকে দিনে-দুপুরে রক্তাক্ত জখম করে। পরে পুলিশ এসে তাকে উদ্ধার করলেও কোনো মামলা দিতে সাহস পায়নি বেলালের পরিবার।
একই ভাবে তারা বিশ্বাসের হাতে রক্তাক্ত জখম হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল রায়ের মহলের কফিল উদ্দিনের ছেলে সেলিম। একই এলাকার ছোট খোকার পরিবারের জমি দখল করে  বালু ফেলে রাতারাতি  বিশ্বাস প্রোপার্টির সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দখল করে নিয়েছে। 
পত্রিকার হকার আজিবর মোল্লা কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমরা দিন আনি দিন খাই, অনেক কষ্ট করে এই জমিটি কিনেছি। ভেবেছিলাম আমাদের মাথাগোঁজার ঠাঁই হবে। এখন আমাদের নামে একটি মিথ্যা মামলা দিয়ে জোরপূর্বক জমি দখল করে নিয়েছে। প্রশাসনের কাছে আমাদের দাবি সঠিক বিচার ও জমি ফেরত চাই।

ভুক্তভোগীদের অভিযোগ- তারা বিশ্বাস ও তার জমি দখলের বাহিনী প্রধান মাইদুল। রাস্তার পাশে একখণ্ড জমি কিনে বালু ফেলে পেছনের জমির  মালিকদের যাতায়াতের পথ বন্ধ করে দিয়ে কমদামে জমি বিক্রি করাতে বাধ্য করে। প্রতিবাদ করলে এবং কোনো কৃষক জমি দিতে না চাইলে তার বাহিনী প্রধান মাইদুলের নেতৃত্বে নির্যাতন এবং জোরপূর্বক জমি দখল করে নেয়। অভিযোগ রয়েছে- বেসরকারি নর্দার্ন বিজনেস অ্যান্ড টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির নির্মাণাধীন ভবনের পথ আটকে বন্ধ করে দিয়ে মোটা অংকের টাকা দাবি করেছিল তারা। তবে সিটি মেয়র তালুকদার আব্দুল খালেকের হস্তক্ষেপে সে যাত্রায় রক্ষা পান ভার্সিটি কর্তৃপক্ষ।

রূপসা, জিরোপয়েন্ট, বয়রা, রায়ের মহল, আড়ংঘাটা, দেয়ানা, ডুমুরিয়ার বিল পাবলা, চর হাসানখালী, কৈয়াসহ আশপাশের এলাকায় একসময় প্রচুর পরিমাণে ধান ও মাছ চাষ হতো। খুলনা শহর ও আশপাশের এলাকার মানুষ এ অঞ্চলের মাছ, ধান ও সবজির উপর নির্ভরশীল ছিল। সরজমিন দেখা গেছে, সেই ধানক্ষেত ও মৎস্য খামার আর নেই। সেখানে ধুুধু বালুর মাঠ। সরকারি ও ব্যক্তি মালিকানাধীন শত শত বিঘা জমি দখল করে বিশ্বাস প্রোপার্টিজের নামে সাইন বোর্ড টাঙানো হয়েছে।
তারা বিশ্বাস গ্রেপ্তার পর ভুক্তভোগী অনেকেই বিচারের দাবিতে সোচ্চার হতে শুরু করেছে। দখল হওয়া জমি ফেরত  পেতে ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে।

দুধ দিয়ে গোসল করে তারা বিশ্বাস
খুলনা সহ সারা দেশের আলোচিত ভয়ঙ্কর খুনি এরশাদ সিকদার খুন করে দুধ দিয়ে গোসল করে উল্লাস করতো। একই ভাবে প্রতিপক্ষের জমি দখল ও  লুটপাট করে পরাস্ত করতে পারলে দুধ দিয়ে গোসল করে অনুসারীদের নিয়ে উল্লাস করতো তারা বিশ্বাস। 
তার অপকর্মের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতো কেসিসি’র সাবেক কাউন্সিল ও ভারপ্রাপ্ত মেয়র আনিচুর রহমান বিশ্বাস। বিগত সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচনে আনিস বিশ্বাস পরাজিত হলে ওইদিন রাতেই দুধ দিয়ে গোসল করে উল্লাস করে সোশ্যাল মিডিয়ায় প্রচার করে ভাইরাল হয়েছিল তারা বিশ্বাস।

প্যারিসের দৌড়-ঝাঁপ
ভূমিদস্যু তারা বিশ্বাস গ্রেপ্তারের পর প্যারিস নামে এক যুবক পুলিশ প্রশাসন, প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতার দ্বারে দ্বারে এমনকি মিডিয়া ম্যানেজ প্রজেক্ট নিয়ে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছে। ভুক্তভোগীদের অভিযোগ রবি চেয়ারম্যান হত্যাকাণ্ডের দুইদিন আগে একই গাড়িতে তারা ও প্যারিসকে গভীর রাতে ডুমুরিয়ার গুটুদিয়া ও কৈয়া বাজার এলাকায় দেখা গেছে। তারা অনুসারীরা প্রচার চালাচ্ছে প্যারিস ভাই সবকিছু দেখাশোনা করছে। কিছুদিনের মধ্যে মুক্তি পেয়ে বেরিয়ে আসবে তারা ভাই।
এদিকে রবি চেয়ারম্যান হত্যা মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ডুমুরিয়া থানার ওসি তদন্ত শাহিনুর রহমান বলেন। মামলার অন্যতম আসামি অর্থ যোগানদাতা ও মদতদাতা আসগর বিশ্বাস তারাকে রিমান্ডে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে। তার সকল অপকর্মের ব্যাপারে আমরা খোঁজ-খবর নিচ্ছি। তারা বিশ্বাসের সঙ্গে আর কোনো সহযোগী ও মদতদাতার নাম তদন্তে এলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।

 

 

পাঠকের মতামত

এখানে শুধু শুধুই আমার নামটা ব্যবহার করলেন! কেউ কারোর নামে অভিযোগ দিলো, সেটা যাচাই-বাছাই না করেই রিপোর্ট করে দিলেন!

Shaikh Mahidur Rahma
১৩ জুলাই ২০২৪, শনিবার, ১:০৫ পূর্বাহ্ন

শেষের পাতা থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

শেষের পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status