মত-মতান্তর
স্মৃতিতে অবরুদ্ধ গণতন্ত্র এবং একজন নেত্রী শেখ হাসিনা
রিয়াজ উদ্দিন রিয়াজ
১৬ জুলাই ২০২২, শনিবারফজরের আজান দেবে দেবে এই মুহূর্তে মোবাইলে রিংটোন বেজে উঠলো। খবর আসলো আমাকে সকালে জজকোর্টে থাকতে হবে। নেত্রী শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হতে পারেন এমন আভাস দিলো। এমন কথায় মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল। কিছুটা হতাশা আসলো নিজের ভেতর। তবে একটা বিষয় সাহস যোগাচ্ছিল এই ভেবে যে বঙ্গবন্ধু কন্যাকে যেখানেই নেয়া হোক না কোনো, তিনি যেভাবে যে অবস্থাতেই থাকুন না কেনো আওয়ামী লীগকে সংগঠিত করতে তার একটা নির্দেশই যথেষ্ট। সে সাহসে ঘর থেকে বের হয়ে গেলাম। ওইদিনের আবহাওয়া ছিল ভীষণ খারাপ। চলছে অঝোরে বৃষ্টি। নেতাকর্মীদের ফোনে মেসেজ দিয়ে সবাইকে প্রস্তুত থাকতে বললাম।
আমিও একটু পেছনে সরে যাই। সুযোগ বুঝে আবারো বেষ্টনীর ভেতর ঢুকে ঠিক নেত্রীর পাশে গিয়ে দাঁড়াই। এভাবে আদালতের ভেতরে নেত্রীর সঙ্গে ঢুকে যাই। এদিকে বাইরে পুলিশ নেতাকর্মীদের ছত্রভঙ্গ করতে লাঠিচার্জ, টিয়ারশেল ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করছে। আমরা তখন আদালতের ভেতর, নেত্রীকে সিএমএম কোর্টের ম্যাজিস্ট্রেট কামরুন্নাহারের আদালতে তোলা হয়েছে। ৮টা ৩৫ মিনিটে শুনানি শুরু হয়। শুনানিতে নেত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে সব দেখেছি এবং শুনেছি। নেত্রী শেখ হাসিনা সে সময় আদালতে ম্যাজিস্ট্রেটের উদ্দেশ্যে বলেন- ‘আমার আরগুমেন্ট এবং আমার আইনজীবীদের আবেদনের ভিত্তিতে আপনি কোনো স্বাধীন সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন না। আপনার ইচ্ছা থাকলেও বিচারিক মাইন্ড অ্যাপ্লাই করে ন্যায়বিচারের স্বার্থে স্বাধীনভাবে আদেশ দিতে পারবেন না। আপনাকে সরকার যেভাবে আদেশ লিখে দিয়েছে, আপনি সেভাবেই করবেন। আপনার হাত-পা বাঁধা। তারপরও আমার এ আবেদন মামলার মূল নথিতে অন্তর্ভুক্ত হওয়া দরকার। দয়া করে আমার এ কথাগুলো মামলার মূল নথিতে লিখে দেবেন। আমার যতটুকু মনে হচ্ছে সরকার আমার বিরুদ্ধে এ মামলার রায়ও লিখে রেখেছে।
আমার বিরুদ্ধে করা এই মামলার বাদীকে আমি জীবনেও দেখিনি। তার নামও শুনিনি। আমাকে হয়রানির উদ্দেশ্যে দেশের বিরুদ্ধে গভীর চক্রান্তের অংশ হিসেবে এই মামলা করা হয়েছে। আগামী নির্বাচনে আমাকে বাদ দিয়ে যেনতেন নীল নকশার নির্বাচন অনুষ্ঠান করার জন্য এটা করা হয়েছে। যৌথবাহিনীর সদস্যরা আমাকে গ্রেপ্তার করতে গেলে ওয়ারেন্ট আছে কিনা জানতে চাইলে তারা ওয়ারেন্ট দেখাতে পারেনি। আমি বিচারের মুখোমুখি হতে ভয় পাই না। জেল-জুলুম, নির্যাতন, এমনকি মৃত্যুকেও ভয় পাই না। এ কারণেই আমি বিচারের মুখোমুখি হয়েছি। আমি মহান আল্লাহ ছাড়া কাউকে ভয় পাই না। জনগণ আমার সঙ্গে আছে। আল্লাহতায়ালা সহায় হলে কোনো চক্রান্ত সফল হবে না। আগেও আমাকে হত্যার চেষ্টা করা হয়েছে। তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। ৯৬ থেকে ২০০১ সাল পর্যন্ত ৫ বছর আমি রাষ্ট্র ক্ষমতায় ছিলাম। এটাই ছিল দেশের স্বর্ণযুগ। দেশকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ করেছি। জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি এনে দিয়েছি। বঙ্গবন্ধুর কন্যা হিসেবে কখনো নিজে নীতি ও আদর্শচ্যুত হওয়ার ব্যাপারে কল্পনাও করতে পারিনি। চাঁদাবাজি তো দূরের কথা আমার শাসনামলে ১ শতাংশ দুর্নীতিও হয়নি।
বিদেশের মাটিতে দেশের মর্যাদা বৃদ্ধি করেছি। যদি চাঁদাবাজ বা অর্থলোভী হতাম, তাহলে বিশ্বের সেরা ১০টি বিশ্ববিদ্যালয় আমাকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি প্রদান করতো না। এই ডক্টরেট ডিগ্রি ছাড়াও বেশ কয়েকটি অর্থনৈতিক অ্যাওয়ার্ড পেয়েছি, যা দেশের মর্যাদাকে অনেক উঁচুতে উঠিয়েছে। বঙ্গবন্ধু পরিবারের দুই মেয়ে আমরা, রাষ্ট্র থেকে কিছুই নেইনি। বরং ত্যাগের ব্যাপারে উদাহরণ সৃষ্টি করেছি। ফারাক্কা চুক্তি-শান্তি চুক্তির মাধ্যমে দেশের অনেক দিনের সমস্যা আমিই সমাধান করেছি। অন্তর্জাতিক পর্যায়ে ব্যক্তিগতভাবে আমার ভিন্ন ধরনের ইমেজ রয়েছে। চাঁদাবাজি করলে এগুলো অর্জন করতে পারতাম না। ‘৬২ সাল থেকে ছাত্র রাজনীতির মাধ্যমে মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম করে অভ্যস্ত। মৃত্যুভয়ও আমাকে সংগ্রাম থেকে পিছু হটাতে পারবে না। এই সরকার দেশটাকে ধ্বংসের কাছে নিয়ে এসেছে। দেশ ও জনগণের প্রতি দরদ ও দায়বোধ নেই। বিদ্যুৎ সমস্যা ও দ্রব্যমূল্য নিয়ে মানুষ আজ দিশাহারা। আমি এ ব্যাপারে কথা বলায় আমাকে হেনস্তা করতে এ মামলা দেয়া হয়েছে। আমি দুর্নীতি বা চাঁদাবাজি করেছি, এ কথা দেশের একজন অন্ধ মানুষও বিশ্বাস করবে না। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপ নিয়ে এরা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করেছে। ৬ মাস পার হলেও এখন পর্যন্ত ভোটার তালিকা তৈরির ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারেনি। নির্বাচনের জন্য ৮৭% একটি তামাশার রোডম্যাপ ঘোষণা করেছে।
সরকার এখন মানুষের ভোটাধিকার লঙ্ঘন করে বন্দুকের নল দিয়ে মানুষের অধিকার হরণ করতে চায়।’ জবানবন্দির শেষ পর্যায়ে নেত্রী বলেন, মাননীয় আদালত, আমি জানি আপনি আমাকে ইচ্ছা থাকলেও জামিন দিতে পারবেন না। তবে দয়া করে আমাকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠাবেন না। সেখানে ‘৭৫ সালের বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার ফাঁসির আসামি রয়েছে। এটাকে আমি নিজের নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি বলে মনে করি।’ আদালত সেদিন নেত্রীর জামিন নামঞ্জুর করেন। আমরা কর্মীরা আবেগে কেঁদে ফেলি। আবেগাপ্লুত নেতাকর্মীরা পুলিশ-র্যাবের ব্যাপক নিরাপত্তা বেষ্টনীর মাঝেও সেøাগানে সেøাগানে মুখরিত করে। ‘শেখ হাসিনার কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে, নেত্রীবিহীন নির্বাচন- মানি না মানবো না, জেল-জুলুম-হুলিয়া নিতে হবে তুলিয়া, অবৈধ সরকার- মানি না মানবো না, ক্ষমতা না জনতা-জনতা জনতা’ এসব সেøাগানে প্রকম্পিত হয় আদালত প্রাঙ্গণ। আমরা সেদিন হাসপাতালের বেড ছেড়ে ঢাকা শহরের বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মানববন্ধন, মিছিল করেছি, করিয়েছি। সেদিন সাব-জেলের সামনে ক্ষমতাসীনদের রক্তচক্ষুর ভয় উপেক্ষা করে সাহসী ও ত্যাগী নেতাকর্মীরা অবিরাম অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছে। আন্দোলনের মাধ্যমে নেত্রীকে মুক্ত করে এনেছি আমরা। অবরুদ্ধ গণতন্ত্র মুক্ত হয়েছে। নেত্রীর মুক্তি আন্দোলন তথা দুর্দিনের আওয়ামী লীগের একজন নগন্য কর্মী এই আমাকে নেত্রী মূল্যায়ন করেছেন। এ প্রাপ্তি আমার জন্য অনেক। আমি চেষ্টা করে যাচ্ছি নেত্রীর এই আবেগের সঠিক অনুধাবন করতে। শুধু আমি কেনো দেশের একেবারে তৃণমূলের ত্যাগী কর্মীকেও খুঁজে খুঁজে বের করে তিনি মূল্যায়ণ করেছেন। তৃণমূল প্রিয়, কর্মী প্রিয় এই নেত্রী দেশরত্ন শেখ হাসিনা আমাদের প্রিয় আপা অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে আজ দেশকে নিয়ে গেছেন বিশ্বের বিস্ময়ের কাছাকাছি। আর আমরা হয়েছি গর্বিত।
লেখক: দপ্তর সম্পাদক, ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগ।
সাবেক সহ-সভাপতি বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।