প্রথম পাতা
ব্লকেডে দুর্ভোগ
স্টাফ রিপোর্টার
১১ জুলাই ২০২৪, বৃহস্পতিবারকাওরান বাজারে কোটা বিরোধীদের রেলপথ অবরোধ। ছবি: জীবন আহমেদ
সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের একদফা দাবিতে চলমান আন্দোলনে গতকালও কার্যত অচল ছিল দেশ। শিক্ষার্থীরা সড়ক, মহাসড়ক ও রেলপথে তাদের বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি পালন করেন। এতে রাজধানীসহ সারা দেশ স্থবির হয়ে যায়। সড়কে তৈরি হয় যানবাহনের দীর্ঘ জট। সারা দেশে রেল যোগাযোগ বন্ধ থাকে ৫ ঘণ্টার বেশি। চরম দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ মানুষ। পূর্বঘোষিত বাংলা ব্লকেড কর্মসূচির অংশ হিসেবে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে এ কর্মসূচি পালন করেন আন্দোলনকারীরা। শিক্ষার্থীরা যখন অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে রাজপথে তখন সুপ্রিম কোর্টে হয় কোটা নিয়ে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের ওপর শুনানি। দুপুরে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আপিল বেঞ্চ কোটা নিয়ে হাইকোর্টের রায়ের ওপর চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা জারি করেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা আদালতের আদেশকে স্বাগত জানালেও কর্মসূচি প্রত্যাহার করেননি। তারা দাবি করেন সরকারের নির্বাহী আদেশের মাধ্যমে কোটা সমস্যার স্থায়ী সমাধান। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার পর শাহবাগ থেকে অবরোধ তুলে নিয়ে শিক্ষার্থীরা আজও অর্ধবেলা বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি পালনের ঘোষণা দেন। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আসিফ মাহমুদ বলেন, আগামীকাল (আজ) বিকাল সাড়ে তিনটা থেকে সারা দেশে রেলপথ ও সড়কে বাংলা ব্লকেড কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে। বিকাল সাড়ে তিনটায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গ্রন্থাগারের সামনে থেকে মিছিল নিয়ে ব্লকেড কর্মসূচির শুরু হবে। সারা দেশে শিক্ষার্থীরা তাদের নিকটস্থ পয়েন্টে ব্লকেড কর্মসূচি পালন করবেন। তিনি বলেন, আমাদের আজকের সকাল-সন্ধ্যার ব্লকেড কর্মসূচি সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। ২০১৮ সালের কোটা বাতিলের পরিপত্রের বিষয়ে আইনি প্রক্রিয়ায় আমরা হাইকোর্টের বারান্দায় যেতে চাই না। আমরা পড়াশোনায় থাকতে চাই। আমাদের একদফা দাবি না মানা পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা রাজপথে থাকবেন। নির্বাহী বিভাগকে বলতে চাই, দ্রুত সময়ের মধ্যে আমাদের দাবি মেনে নিন, যাতে আমরা দ্রুত পড়ার টেবিলে ফিরে যেতে পারি। যতদিন না আমাদের দাবি মেনে না নেয়া হয় ততদিন আমরা আমাদের এ আন্দোলন চলবে। তার আগে নির্বাহী বিভাগ থেকে সুস্পষ্ট নির্দেশনা আসতে হবে। একটি কমিশন গঠন করতে হবে। যার মাধ্যমে ন্যূনতম কোটা রাখা যেতে পারে। আরেক সমন্বয়ক সারজিস আলম বলেন, আমাদের দাবি আদালতের কাছে নয়, সরাসরি নির্বাহী বিভাগের কাছে। আদালত কাজ করছেন ২০১৮ সালের পরিপত্র নিয়ে। পরিপত্রের ক্ষেত্রে যেকোনো সিদ্ধান্ত আসতে পারে। কিন্তু আমাদের একদফা দাবি শুধু রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগ বা সরকারই পূরণ করতে পারে। সব গ্রেডে কোটার যৌক্তিক সংস্কারের বিষয়টি আমাদের কাছে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ সরকারি চাকরিতে তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণিতে কোটা বৈষম্য আরও বেশি। শিক্ষার্থীদের যে দাবি, সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ কোটা রাখা, সেটিকে সামনে রেখে সরকার একটি পরিপত্র বা ডকুমেন্ট জারি করতে পারে। শুধু প্রতিবন্ধী, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ন্যূনতম কোটাকে আমরা সমর্থন করি। জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে সুবিধা দিলেও এসব কোটা ৫ শতাংশের বেশি রাখার প্রয়োজন হয় না। তিনি বলেন, নির্বাহী বিভাগের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে প্রতিশ্রুতি, একটি নির্বাহী আদেশ বা পরিপত্র জারি করে একটি কমিশন গঠনের মাধ্যমে সমাধানটি করা যেতে পারে। এটি সরকারের নীতিগত সিদ্ধান্তের বিষয়। জাতীয় সংসদ থেকে আইন প্রণয়ন করে আমাদের একদফা দাবি বাস্তবায়ন করতে হবে। নির্বাহী বিভাগ বা সরকার চাইলে এই সংবাদ সম্মেলনই আমাদের শেষ সংবাদ সম্মেলন হতে পারে।
এর আগে সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেন্ট্রাল লাইব্রেরির সামনে ব্লকেড কর্মসূচি পালনের জন্য জড়ো হন শিক্ষার্থীরা। সেখান থেকে শিক্ষার্থীদের বিশাল মিছিল মধুর ক্যান্টিন, কলা ভবন, বিজনেস ফ্যাকাল্টি, হলপাড়া, ভিসি চত্বর ও টিএসসি হয়ে শাহবাগ মোড়ে গিয়ে অবরোধ শুরু করেন। এ সময় তারা কোটাবিরোধী বিভিন্ন স্লোগান দেন। দুপুর সোয়া ১১টা থেকে শুরু হওয়া শাহবাগের অবরোধ কর্মসূচি চলে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত। একই সময়ে অবরোধ কর্মসূচি পালিত হয় ইন্টারকন্টিনেন্টাল, সায়েন্সল্যাব, কাঁটাবন, চাঁনখারপুল, গুলিস্তান, পল্টন, হাইকোর্ট মোড়, জিওপি, মৎস্য ভবন, কাকরাইল, বাংলামোটর, কাওরান বাজার, ফার্মগেট, আগারগাঁও, মহাখালীসহ রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ সব মোড়ে। বন্ধ করে দেয়া হয় রেলপথ ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। অবরোধের কারণে কার্যত অচল হয়ে পড়ে রাজধানী ঢাকা। সকাল ১০টা থেকে শুরু হওয়া এ কর্মসূচির কারণে সড়কে তৈরি হয় দীর্ঘ যানজট। ঘণ্টার পর ঘণ্টা সড়কে দাঁড়িয়ে থাকতে হয় যানবাহনকে। এমনকি তীব্র ভোগান্তিতে পড়তে হয় সাধারণ মানুষকে। বিশেষ করে অফিসগামী মানুষ ও জরুরি প্রয়োজন বের হওয়া মানুষের ভোগান্তির শেষ ছিল না। এসব পথ অবরোধ করায় যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, শ্যামপুর, জুরাইন, পুরান ঢাকা, মিরপুর, শ্যামলী, বিজয় সরণি, গাবতলী, বনানী, ধানমণ্ডি, আজিমপুর, মিরপুর রোড, পান্থপথ, শান্তিনগরসহ বিভিন্ন এলাকায়ও যানজট তৈরি হয়। এ ছাড়াও চাঁনখারপুলে ফ্লাইওভার বন্ধ করে দেয়ায় তীব্র যানজট তৈরি হয় ফ্লাইওভারে। আন্তঃজেলা বাসগুলোকে ঢাকায় প্রবেশ করতে তীব্র ভোগান্তি পোহাতে হয়। অন্যদিকে শিক্ষার্থীদের অবরোধের কারণে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে সৃষ্টি হয় দীর্ঘ যানজট। প্রায় ২০ কিলোমিটারের যানজটে তীব্র ভোগান্তি পোহাতে হয় যাত্রীদের।
সরকারি চাকরির কোটায় আপাতত স্থিতাবস্থা
সরকারি চাকরিতে (৯ম থেকে ১৩তম গ্রেড পর্যন্ত) কোটা পদ্ধতি সংক্রান্ত বিষয়বস্তুর ওপর চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা দিয়ে সব পক্ষকে এ স্থিতাবস্থা মেনে চলতে নির্দেশ দিয়েছেন আপিল বিভাগ। গতকাল প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন পাঁচ সদস্যের আপিল বিভাগ দুই শিক্ষার্থী ও রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এ আদেশ দেন। আগামী ৭ই আগস্ট পরবর্তী দিন ধার্য করা হয়েছে। একইসঙ্গে, আপিল বিভাগ কোটা বিরোধী আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরতে ও পরীক্ষায় অংশ নিতে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের শিক্ষার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করতে বলেছেন।
পর্যবেক্ষণ ও নির্দেশনায় আপিল বিভাগ বলেছেন, দেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও প্রক্টর এবং অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানেরা তাদের ছাত্রছাত্রীদের নিজ নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে নিয়ে শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ নিশ্চিত করার কথা বলেন। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা চাইলে আইনজীবীর মাধ্যমে তাদের বক্তব্য আদালতের সামনে তুলে ধরতে পারেন। আদালত মূল আবেদন নিষ্পত্তির সময় তাদের বক্তব্য বিবেচনায় নেবেন।
প্রধান বিচারপতির আহ্বান: ১১টা ৪৩ মিনিটে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসানের নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের পাঁচ সদস্যের বিচারপতির বেঞ্চে এই শুনানি শুরু হয়। শুরুতে শুনানি করেন রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান আইন কর্মকর্তা অ্যাটর্নি জেনারেল আবু মোহাম্মদ (এএম) আমিন উদ্দিন। শুনানি শেষে আপিল বিভাগ সরকারি চাকরির প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণিতে কোটা পদ্ধতি বাতিলের পরিপত্র ‘অবৈধ’ ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেয়া রায়ের ওপর চার সপ্তাহের স্থিতাবস্থা দিয়েছেন। পরে কোটা বিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান। প্রধান বিচারপতি বলেন, প্রতিবাদকারীরা চাইলে আদালতে তাদের বক্তব্য উপস্থাপন করতে পারবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের ক্লাসে ফিরিয়ে নিতে ভিসিদের উদ্যোগ নেয়ার আহ্বানও জানান তিনি। শুনানিকালে প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান বলেন, এটা নিয়ে রাস্তায় নেমে যারা স্লোগান দিচ্ছেন সেটা এপ্রিশিয়েট করার মতো না। তবে আমার যা মনে হয় তারা ভুল বুঝেই এটা করেছে। যাই হোক তারা আমাদেরই ছেলেমেয়ে। আমি প্রথম দিনেই বলেছি রাস্তায় স্লোগান দিয়ে আদালতের (জাজমেন্ট চেঞ্জ) রায় পরিবর্তন করা যায় না এটার জন্য (প্রপার স্টেপ) যথাযথ পদক্ষেপ নেন। আজকে আমি ধন্যবাদ জানাই যে দুটি ছেলে এসেছেন (হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিয়ে) তাদের আইনজীবী শাহ মনজুরুল হককে। তারা অন্ততঃ পক্ষে একটি যথাযথ উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রতিবাদকারী শিক্ষার্থীদের প্রতি প্রধান বিচারপতি বলেন, স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদকারীরা চাইলে আইনজীবীর মাধ্যমে তাদের বক্তব্য আদালতের সামনে তুলে ধরতে পারবেন। আর আদালত মূল দরখাস্তটি নিষ্পত্তিকালে তাদের বক্তব্যটি বিবেচনায় নিবে। প্রধান বিচারপতি বলেন, রাতে টেলিভিশন যখন দেখি মনে হয় সমস্ত জ্ঞান তাদেরই। আর আমরা যারা এখানে বসে আছি আমাদের কোনো জ্ঞানই নাই। এত কথা বলে উস্কানি দেয়ার তো কোনো মানে হয় না। কোটা নিয়ে হাইকোর্টের রায়ের প্রসঙ্গে প্রধান বিচারপতি বলেন, এখন সেটা (রায়টি) সঠিক হয়েছে কি, হয় নাই- তা দেখার অধিকারটা কার? সেটা দেখার অধিকার সুপ্রিম কোর্টের। একমাত্র আপিল বিভাগের। আমাদের ক্ষমতা আছে হাইকোর্টের রায়টি বাতিল করার বা না করার। আবার বলতে পারি হাইকোর্টের রায়টি ঠিক হয়নি বা হয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা কোনটা বলবো? রায়টি আমাদের সামনে না আসা পর্যন্ত তো তা বলতে পারছি না। আমার মনে হয় রায়টি আমাদের সামনে আসুক, রায়টি আসলে আমরা প্রপার মূল্যায়ন করবো। শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে বলে প্রধান বিচারপতি বলেন, সকল প্রতিবাদী কোমলমতী শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরে গিয়ে নিজ নিজ কাজে অর্থাৎ পড়াশোনায় মনোনিবেশ করতে বলছি। আর দেশের সকল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মহোদয়, প্রক্টর ও অন্যান্য বিদ্যালয়ের প্রধানগণকে তাদের শিক্ষার্থীদের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ফিরিয়ে নিয়ে শিক্ষার উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করবেন বলে এই আদালত আশা করে।
আদালতে দুই শিক্ষার্থীর আবেদনের পক্ষে শুনানি করেন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক। রাষ্ট্রপক্ষে শুনানি করেন অ্যাটর্নি জেনারেল এ এম আমিন উদ্দিন। আর রিটের পক্ষে শুনানি করেন আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী।
অ্যাটর্নি জেনারেল যা বলেন-
আদেশের পর অ্যাটর্নি জেনারেল এএম আমিন উদ্দিন সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি ছিল, পরবর্তীতে সেটা ২০১৮ সালে কোটা পদ্ধতির বিষয়ে সরকার একটি কমিটি করে প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণির সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে সেটা বাতিল করে দেন। তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির চাকরির ক্ষেত্রে সেটা বহাল থাকে। পরবর্তীতে এটা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে একটি মামলা হয়। সেই মামলায় শুনানি নিয়ে হাইকোর্ট বিভাগ রায়ে কোটা পদ্ধতি বাতিলের প্রজ্ঞাপন বাতিল করে দিয়েছেন। অর্থাৎ হাইকোর্টের রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে কোটা পদ্ধতি যেটা আগে ছিল, সেটাই আবার বহাল হয়ে যায়। পরবর্তীতে রায়টি চ্যালেঞ্জ করে আমরা আপিল বিভাগে একটি আবেদন করি। যেহেতু রায়ের অনুলিপি পাওয়া যায়নি, তাই আমরা সিএমপি ফাইল করেছিলাম। সেই সিএমপি কোর্টে আসছে আজ (গতকাল বুধবার) শুনানি হলো। আমরা কোর্টকে বললাম, এখনো রায়ের অনুলিপি পাইনি। রায় না পাওয়া পর্যন্ত আমরা কিছু করতে পারছি না। যেহেতু গত ৫ বছর ধরে কোটা পদ্ধতিটা বিলুপ্ত ছিল। সেই ক্ষেত্রে নতুন করে রায় না পাওয়া পর্যন্ত হাইকোর্টের রায়ের ওপর আমরা স্থগিতাদেশ চেয়েছিলাম।
অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আপিল বিভাগ উভয়পক্ষকে শুনানি করে স্থিতাবস্থা দিয়েছেন। অর্থাৎ যে অবস্থায় আছে, সেই অবস্থায়ই থাকবে। কোটা কি থাকছে, কি থাকছে না- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন যেহেতু স্থিতাবস্থা আছে, যেগুলো ছিল, সবগুলো থাকবে। অ্যাটর্নি জেনারেল আন্দোলনকারীদের বিষয়ে বলেন, আমি বলবো সুপ্রিম কোর্ট এটা বিবেচনায় নিয়েছেন। সুপ্রিম কোর্টের আদেশেও আছে আন্দোলনকারীদের কোনো বক্তব্য থাকলে তারা আইনজীবীর মাধ্যমে আপিল বিভাগে দিতে পারবে। তাই এখন আর যৌক্তিক কোনো কারণ নেই। এখন উচিত এটা বন্ধ করে নিজ নিজ অবস্থানে ফিরে যাওয়া। আন্দোলন করে জনদুর্ভোগ আর বাড়ানোর যৌক্তিক কোনো কারণ নেই।
কোটার প্রকৃত অবস্থা কি হলো- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আগে যে অবস্থায় ছিল সেই অবস্থায়ই আছে। স্থিতাবস্থা দেয়া হয়েছে সাবজেক্ট ম্যাটারে। সাবজেক্ট ম্যাটারে এটা বাতিল করা ছিল। যে বিজ্ঞপ্তিগুলো রয়েছে, সেগুলোতে কোটা পদ্ধতি লাগবে না। নতুন করে কোনো বিজ্ঞপ্তি দিতে হলে, এখন আপাতত কিছু করবে না। মামলাটা আগামী মাসের ৭ তারিখে শুনানি হবে, তখন ঠিক করবে এটা।
শিক্ষার্থী ও রিটকারীর দুই আইনজীবী যা বলেন-
আইনজীবী শাহ মঞ্জুরুল হক বলেন, আপিলেট ডিভিশনের স্ট্যাটাসকো আদেশের ভুল বুঝাবুঝির কোনো সুযোগ নেই। স্ট্যাটাসকো আদেশের অর্থ হচ্ছে হাইকোর্ট ডিভিশনের যে রায় আছে, সেই রায়ের কার্যকারিতা থাকবে না। ২০১৮ সালে কোর্টা বাতিল করে যে প্রজ্ঞাপন দিয়েছিল সেই প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী অফিসের নিয়োগ সংক্রান্ত কার্যক্রম পরিচালিত হবে। অর্থাৎ কোটা পদ্ধতি বাতিল করে ২০১৮ সালে যে প্রজ্ঞাপন দিয়েছিল সেই প্রজ্ঞাপনটিই বহাল থাকবে। তিনি বলেন, বিষয়টি আপিল বিভাগে বিচারাধীন থাকা অবস্থায় শিক্ষার্থীরা যদি নতুন কোনো সার্কুলার বা প্রজ্ঞাপন দিতে বলে সরকারের পক্ষে সেটা দেয়া কিন্তু এখন সম্ভব না। এটি ডিসলভ করতে হলে আপিল বিভাগ শুনানির জন্য যেদিন রেখেছেন সেদিন আসতে হবে। সেদিন এসে আন্দোলনকারীরা নিজে কিংবা আইনজীবীর মাধ্যমে কথা বলতে বলেছেন প্রধান বিচারপতি। আপিল বিভাগের এই আদেশের পরেও কেউ কেউ শিক্ষার্থীদের ভুল বুঝাচ্ছেন। শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, এখানে ভুল বুঝার কোনো সুযোগ নেই। আপনাদের কোনো কথা থাকলে আপিল বিভাগে আসতে হবে। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে শাহ মনজুরুল হক বলেন, স্ট্রে ও স্ট্রাটাসকো টেকনিক্যাল ওয়ার্ড। স্ট্রে-এর অর্থ যা বুঝায় ও স্ট্রাটাসকোর অর্থও তাই বুঝায়। প্রধান বিচারপতি আন্দোলনকারীদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার জন্য, শান্তিপূর্ণ অবস্থা বজায় রাখার জন্য বলেছেন।
আইনজীবী মনসুরুল হক চৌধুরী বলেন, স্ট্রাটাসকো মানে হলো, যে অবস্থায় আছে, সে অবস্থায় থাকবে। হাইকোর্টের রায়ের কার্যকারিতা স্থগিত থাকবে। তিনি আরও বলেন, আপিল বিভাগ কিন্তু হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেননি। স্থিতাবস্থা দিয়েছেন। আপাতত নিয়োগে কোটা অনুসরণ করার আপাতত দরকার হবে না।
ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন: এদিকে কোটা বাতিলের দাবিতে বাংলা ব্লকেডের অংশ হিসেবে রেলপথও অবরোধ করেছেন শিক্ষার্থীরা। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে এ অবরোধ কর্মসূচি পালন করেন তারা। এতে ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ স্থবির হয়ে পড়ে। প্রায় সাড়ে ৫ ঘণ্টা পর বিকালে শিক্ষার্থীরা অবরোধ তুলে নিলে রেল যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়। কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার আনোয়ার হোসেন জানিয়েছেন শিক্ষার্থীদের অবরোধে প্রায় সাড়ে ৫ ঘণ্টা রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকার পর বিকাল ৫টা ২০ মিনিটে স্বাভাবিক হয়। এর আগে দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে ঢাকার রেলপথ অবরোধ করেন আন্দোলনকারীরা। এ সময় কাওরান বাজার ও মহাখালী রেলগেট এলাকায় আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা রেললাইনের উপরে কাঠের গুঁড়ি ও বাঁশ ফেলে অবরোধ করেন। এতে করে ঢাকার সঙ্গে সারা দেশের রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। এ ছাড়াও রেল ক্রসিংয়ের ব্যারিকেডের গেট ফেলে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। এতে রেলগেট দিয়ে কোনো যানবাহনও চলাচল করতে পারেনি।
সড়কে আটকে দেয়া হয় কূটনীতিকসহ ভিআইপিদের গাড়িও: এদিকে শিক্ষার্থীরা ব্লকেড কর্মসূচি চলাকালে ভিআইপিদের গাড়িও আটকিয়ে দেন। বিভিন্ন এলাকায় তারা যাতায়াত করতে চাইলে শিক্ষার্থীরা তাদের যেতে দেননি। শিক্ষার্থীদের অবরোধের কারণে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে গাড়ি থেকে নেমে যান ঢাকায় ইউরোপীয় ইউনিয়নের মিশন প্রধান চার্লস হোয়াইটলি এবং উপপ্রধান বার্নড স্পানিয়ের। পরে তারা হেঁটে ও অটোরিকশায় চড়ে গন্তব্যে পৌঁছান। চার্লস হোয়াইটলির গতকাল দুপুর ১২টায় জাতীয় সংসদে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাতের কথা ছিল। এমন যাতায়াত উপভোগ করার কথা জানালেও ঠিক সময়ে পৌঁছতে না পারায় আক্ষেপ করেছেন হোয়াইটলি। এক্সপ্রেসওয়ের এফডিসি প্রান্ত থেকে জাতীয় সংসদের দিকে তাদের এই যাত্রার একটি ভিডিও মাইক্রোব্লগিং সাইট এক্স-এ পোস্ট করেছেন তিনি। আর ভিডিওটি তৈরি করেছেন বার্নড স্টানিয়ের। এছাড়াও মৎস্য ভবনে আটকে দেয়া হয়েছে জাপানের এক কূটনীতিকের গাড়ি, বঙ্গবাজারে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপসের গাড়ি ও সায়েন্সল্যাবে এক সংসদ সদস্যের গাড়ি।
চট্টগ্রামে সড়ক ও রেলপথ অবরোধ: চট্টগ্রাম নগরীর দেওয়ানহাটে রেলপথ ও টাইগার পাসে সড়কপথ অবরোধ করেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় (চবি) ও অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষার্থীরা। এ সময় শিক্ষার্থীরা চট্টগ্রামের সঙ্গে সারা দেশের ট্রেন চলাচল বন্ধ করে দেন। গতকাল সকাল সাড়ে ১১টায় নগরীর দেওয়ানহাটে জড়ো হয়ে শিক্ষার্থীরা রেললাইন অবরোধ করেন। এরপর দুপুর ১টায় শিক্ষার্থীরা ২ ভাগ হয়ে একটি অংশ রেললাইনে অবস্থান নেন ও অপর একটি অংশ নগরীর টাইগারপাস এসে সড়কপথ অবরোধ করেন। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা জনান, মেধাবীদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার লড়াইয়ে আমরা অংশগ্রহণ করেছি। কোটা বৈষম্যের কারণে মেধাবীদের জন্য সকল রাস্তা সংকীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। আমরা মেধাবী দ্বারা পরিচালিত একটি স্মার্ট বাংলাদেশ দেখতে চাই।
এদিকে সড়কপথ অবরোধের ফলে নগরীতে দীর্ঘ যানজটের সৃষ্টি হয়। অবরোধের কারণে নগরের পাহাড়তলীর পথ থেকে আসা যানবাহন সিটি কর্পোরেশনের অস্থায়ী কার্যালয়ের সামনের পথ ধরে বের হয় লালখান বাজারে। টাইগারপাসের পথে আটকা পড়ে শত শত গাড়ি। এসব যানবাহনের যাত্রীরা বেশির ভাগ হেঁটে গন্তব্যে যান। নগরের প্রবেশমুখ সিটি গেট, দুই নম্বর গেট, একে খান, আগ্রাবাদ এক্সেস রোড, অলঙ্কার পর্যন্ত গণপরিবহনের সংখ্যা বেশ কিছুটা কম দেখা গেছে। সিএনজি অটোরিকশা ও ব্যক্তিগত পরিবহনের সংখ্যাও ছিল বেশ কম।
কুমিল্লায় শিক্ষার্থীদের অবরোধে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে দীর্ঘ যানজট: বৃষ্টি উপেক্ষা করে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক অবরোধ করে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারীরা। মহাসড়কে শিক্ষার্থীরা অবস্থান নেয়ার পাশাপাশি দড়ি টেনে ও গাছের খুঁটি ফেলে বাধা সৃষ্টি করেন। গতকাল সকাল-সন্ধ্যা ‘বাংলা ব্লকেড’ কর্মসূচির অংশ হিসেবে মহাসড়কের কুমিল্লার কোটবাড়ী বিশ্বরোড দখলে নেন তারা। কর্মসূচিতে কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় (কুবি), ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজসহ কুমিল্লার অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন। আন্দোলন কর্মসূচি শুরু হওয়ার পর ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের ২টার দিকে কয়েক কিলোমিটার যানজট সৃষ্টি হয়। মহাসড়কের চট্টগ্রামগামী লেনে যানজট ক্যান্টনমেন্ট এলাকা পার হয়। ঢাকামুখী লেনে পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড পর্যন্ত ছাড়ায় পরিবহনের জটলা। এদিকে, মহাসড়কে অবরোধ থাকার কারণে কুমিল্লা নগরীতে গাড়ির চাপ বেড়ে যায়। মহাসড়কের আলেখারচর, জাগুরঝুলি ও কোটবাড়ী বিশ্বরোড হয়ে অনেক গাড়ি শহরে প্রবেশ করে। এতে যানজটের সৃষ্টি হয়। সকাল থেকে মহাসড়কের বিভিন্ন অংশে গিয়ে দেখা যায়, বাসের উপস্থিতি অত্যন্ত কম। দূরপাল্লার বাস কম চলাচল করছে। তবে আন্তঃজেলা কিছু বাস মহাসড়ক হয়ে চলাচল করছে। তবে সড়কে কাভার্ডভ্যান ও ট্রাকের আধিক্য ছিল।
ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়ক অবরোধ: ঢাকা-রাজশাহী মহাসড়কের অন্যতম প্রবেশদ্বার অবরোধ করে রেখেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় (রাবি) ও রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (রুয়েট) শিক্ষার্থীরা। দুপুর ১টায় মহাসড়কের চৌদ্দপাই এলাকার বাইবাস মোড় অবরোধ করেন তারা। বেলা ১১টা থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্যারিস রোডে জড়ো হতে থাকেন শিক্ষার্থীরা।
ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ জাবি শিক্ষার্থীদের: ঢাকা-আরিচা মহাসড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী আরিফ সোহেল বলেন, আমরা কোটা নিয়ে স্থায়ী সমাধান চাই। সব গ্রেডে অযৌক্তিক এবং বৈষম্যমূলক কোটা বাতিল করে সংবিধানে উল্লিখিত অনগ্রসর গোষ্ঠীর জন্য কোটাকে ন্যূনতম মাত্রায় আনতে হবে।
সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক অবরোধ শাবিপ্রবি শিক্ষার্থীদের: সকাল-সন্ধ্যা বাংলা ব্লকেডের অংশ হিসেবে বৃষ্টিতে ভিজে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ মিছিল ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেছেন শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। সকাল ১১টার দিকে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন সড়কে বিক্ষোভ মিছিল করেন শিক্ষার্থীরা। পরবর্তীতে দুপুর ১২টার দিকে মিছিলটি নিয়ে প্রধান ফটকে অবস্থান করে সিলেট-সুনামগঞ্জ সড়ক অবরোধ করেন তারা। এদিকে অবরোধের ফলে সড়কের দুইপাশ জুড়ে তৈরি হয়েছে তীব্র যানজট। অনেকে হেঁটে পার হচ্ছেন সমাবেশস্থল। তবে জরুরি কাজের যানবাহনসহ এম্বুলেন্স ছেড়ে দিচ্ছেন শিক্ষার্থীরা।