ঢাকা, ১৮ এপ্রিল ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ৮ শাওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

নির্বাচিত কলাম

চলতি পথে

ঈদযাত্রা কবে সহনীয় হবে?

শুভ কিবরিয়া
১৫ জুলাই ২০২২, শুক্রবার
mzamin

খুব সচেতন থেকেছি রেলপথে, নৌপথে, সড়কপথে কখনই ঈদের আগের দিনে যেন ঘর থেকে না বেরুই সেটা নিশ্চিত করতে। এর মধ্যে বাংলাদেশে বহু পরিবর্তন ঘটে গেছে। আরিচা-নগরবাড়ীর ফেরির রমরমা দিন হারিয়ে গেছে। যমুনার উপর সেতু হয়েছে। পদ্মার উপরও নিজের অর্থায়নে সেতু করার সামর্থ্য আমরা দেখিয়েছি।

 

নব্বইয়ের দশকের শেষদিকের কথা। কেমন করে যেন ঈদের সময় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাড়ি ফেরার সময়টি পড়ে গেল ঠিক আগের দিন। সে বার ছিল রোজার ঈদের সময়। ঈদুল ফিতরের আগের দিন। ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশনের বড় ফুটওভারব্রিজের ওপর আমরা আটকে গেলাম। একসঙ্গে বেশ ক’টি ট্রেন থেমেছে।

বিজ্ঞাপন
নানা ট্রেনের যাত্রীরা ফুটওভার ব্রিজের ওপর দিয়ে নিজ নিজ গন্তব্যে যাবেন। কিন্তু উভয় দিকের যাত্রীরা একই সময় পথ পারাপার হতে চাইছেন। সবাই সবার আগে যেতে চাইছেন। সম্ভবত ফুটওভারব্রিজে যতজন যাত্রী স্বচ্ছন্দে যেতে পারেন তার চাইতে বহুগুণ মানুষ উঠে পড়েছেন সেই ব্রিজে। আমার সহযাত্রী এক পরিবার। তাদের সঙ্গে আছে এক শিশুকন্যা। সেই শিশুটিকে নিয়ে আমরা আটকে গেলাম। ঘণ্টার পর ঘণ্টা, প্রচণ্ড রোদে, আমরা কোন দিকেই যেতে পারছিনা। প্রচণ্ড ভিড়ে বিপুল মানুষের শ্বাস-প্রশ্বাসের ভারে বাতাসও ভারী হয়ে উঠেছে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম ভবিষ্যতে কখনো আর ঈদের ঠিক আগের দিনে এরকম যাত্রায় বেরুবো না। সে এক ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা। 

নারী-শিশু-বৃদ্ধ মানুষ তো বটেই স্বাভাবিক সোমত্ত মানুষরাও হাঁপিয়ে গেলেন। পরে কর্তৃপক্ষের নজরে এলে বহু ঘণ্টার চেষ্টার পর সেই যাত্রায় মুক্তি মিললো।  এরপর খুব সচেতন থেকেছি রেলপথে, নৌপথে, সড়কপথে কখনই ঈদের আগের দিনে যেন ঘর থেকে না বেরুই সেটা নিশ্চিত করতে। এর মধ্যে বাংলাদেশে বহু পরিবর্তন ঘটে গেছে। আরিচা-নগরবাড়ীর ফেরির রমরমা দিন হারিয়ে গেছে। যমুনার উপর সেতু হয়েছে। পদ্মার ওপরও নিজের অর্থায়নে সেতু করার সামর্থ্য আমরা দেখিয়েছি। ইতিমধ্যে আমাদের রেল যোগাযোগ দুর্বল হয়েছে। সড়কপথের বাণিজ্য রমরমা হারে বেড়েছে। সড়কপথে মনোযোগও বেড়েছে ভীষণ। যে সব হাইওয়েতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে আমরা এখন চলাচল করি সেসব হাইওয়ের গেটআপ মেকআপেও পরিবর্তন এসেছে অনেক। হাইওয়েতে যানজট যেন না হয় সে জন্য আন্ডারপাসের ব্যবস্থা হয়েছে, স্থানীয় যানের জন্য আলাদা লেনও হয়েছে। কিন্তু ঈদযাত্রার সময় মানুষের দুর্ভোগ কমার কোনো ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যায়নি। এবার কোরবানির ঈদের তারিখ নির্ধারিত হয়েছে ১০ই জুলাই ২০২২ রোববার। ৮ই জুলাই শুক্রবার, ভাবলাম ঢাকা ছাড়বো। 

ঢাকা থেকে মাত্র ১৩০ কিলোমিটার দূরত্বের ওইদিনের বাসের টিকিট আগেই লাপাত্তা। নানা পথে তদ্বির চালিয়ে টের পেলাম টিকিট আগেই লাপাত্তা হওয়ার নানা মজার মজার তথ্য। ইতিমধ্যে মিডিয়া চাউর করেছে রেলের টিকিট নিয়ে কি দুর্ভোগই না পোহাতে হয়েছে যাত্রী সাধারণকে। আগে টিকিট কালোবাজারির একটা এনালগ পদ্ধতি ছিল। কালোবাজারির মাঠের মানুষদের চোখে দেখা যেত। এখন অনলাইন আর ডিজিটাল কালোবাজারির সফটওয়ার এতটাই শক্তিমান যে টিকিট বাজারে আসার আগেই লাপাত্তা হয়। কারা এসব টিকিট কাটে, কাদের হাতে টিকিট যায়, সেই টিকিট কীভাবে বিক্রি করা হয়, সেটা বের করাও সহজ কাজ নয়। রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ কেন মানুষের কষ্ট লাঘবে আরেকটু তৎপর হতে পারে না, কেন ঈদের সময় আরও বেশি ট্রেন-বগি সংযুক্ত করে না, মানুষকে একটু স্বস্তি দিতে পারে না, সেটা ঠিক বুঝতে পারি না। এখনকার রেলমন্ত্রীর কথাবার্তা কিংবা পদক্ষেপে কোনো আত্মবিশ্বাসের ছাপও দেখি না। বুঝতে পারি বছরের পর বছর রেলওয়ের সম্পত্তি যারা বেহাত করছে, রেলওয়েতে লুণ্ঠনপর্ব জারি রেখেছে, সেই রেলতান্ত্রিক-আমলাচক্রের জাল ছিন্ন করা আমাদের রেলমন্ত্রীর কর্ম নয়।

 ফলে তার জন্য ফিতা কাটা আর ফটোসেশনই সারকথা, জনদুর্ভোগ দূর করা বহুদূরের বিষয়।  একটা কথা না বললেই নয়, বহু বছর রেলওয়েতে সরকারের কোনো মনোযোগ ছিল না। বহু বছর ধরেই আমাদের রেলওয়ে নানা ষড়যন্ত্রের জালে বিপদাপন্ন ছিল। এ সরকারের বড় কৃতিত্ব হচ্ছে, রেলওয়েতে নতুন করে মনোযোগ দিয়েছে। রেলওয়েতে বিনিয়োগ বাড়ছে। নতুন নতুন অবকাঠামো তৈরিতে সরকার উদ্যমী হয়েছে। সেই ব্যয় কতটা সাশ্রয়ী, কতটা জনপ্রয়োজনীয়, কতটা সঠিক বা অগ্রাধিকার ভিত্তিক, কতটা অ-লুণ্ঠনমূলক, সেই প্রশ্ন তোলা যেতেই পারে। কিন্তু এটা স্বীকার করতেই হবে, রেল এখন নতুন মনোযোগের, নতুন আগ্রহের বিষয় বটে। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই রেল বিষয়ে সরকার আগ্রহী হওয়ার পর ঝানু রাজনীতিবিদ প্রয়াত রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিৎ সেনগুপ্ত একটা বড় ঝাঁকুনি দিয়েছিলেন। সেই ঝাঁকুনিতে বড় কাজও হয়েছিল। যদিও দুর্জনেরা বলেন- সেই ঝাঁকুনি তিনি এমন জায়গাতেই দিয়ে ছিলেন যে, সেটা সামলানোর ক্ষমতা তার ছিল না। 

 

 

ফলে তার এক সহকারীর ঘরে টাকার বস্তার কেলেঙ্কারির মতো কালো পরিণতির তিলক পরেই তাকে বিদায় নিতে হয়েছে খুবই খারাপ পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে। সেই ঘটনা নিশ্চয় এখনকার রেলমন্ত্রীদের জন্যও শিক্ষণীয়। ফলে রেলজনিত জনদুর্ভোগ কাটাতে সহসাই যে কেউ খুব সাহসী হবেন- সেটা আশা করাও বাতুলতা! সড়কপথের ওপর আমাদের ভরসা ছিল। কিন্তু টিকিট কাটতে গিয়ে প্রথম ধাক্কাটা পেলাম। স্বাভাবিক উপায়ে টিকিট পেলাম না। অনেক ধরনের ধরাধরির পর একটা টিকিটের খবর পেলাম, এবং সেটা কেবল যাত্রার মুহূর্তেই সংগ্রহ করা যাবে, সেটাই জানানো হলো। পুরো প্রক্রিয়াটা জানার পর সেটা আমাকে শুধু অবাকই করেনি, দুর্ভাবনাতেও ফেলে দিলো। এক সময় ভাবতাম অল্প বয়সে কিংবা ছাত্রজীবনে মানুষ নানারকম দুষ্কর্মের সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে টাকা আয়ের নেশায়। পরে কর্মজীবনে তার পথ বদল হয়। কর্মজীবনকেই মূলক্ষেত্র বানায়। সেখানেই যে যেভাবে পারে আয়ের উৎস নির্ধারণ করে। এবার সেই ধারণায় চির ধরলো। আন্দাজ করলাম, আমার অনুমান ভুল।

 ছাত্রজীবনে যে মেধাবী শিক্ষার্থী নানারকম প্রতিযোগিতা মূলক পরীক্ষার প্রশ্নের তাৎক্ষণিক উত্তর বাতলিয়ে দিয়ে বড় বড় চক্রের উপকার করতো অর্থের বিনিময়ে, বহু বছর পর বড় পদে গিয়েও তার সে স্বভাব এখনো বদলায়নি। কিংবা যে শিক্ষার্থী শিক্ষা জীবনে বাড়তি আয়ের আশায় আগাম বাস-রেলযাত্রার টিকিট কেনা-বেচায় সহযোগিতা করতো আগাম বিনিয়োগ করে, চাকরি জীবনে সম্মানজনক পেশায় আসার পরও, তার বাড়তি আয়ের সে নেশা কাটেনি। সম্ভবত এটা একটা বদ নেশা। চাইলেও হয়তো কাটানো যায় না। অথবা যারা এই কাজ করেন, তারা এটাকে বাড়তি আয়ের একটা চলমান প্রজেক্ট হিসেবেই দেখেন। ন্যায়-অন্যায় বোধের দায় তাদের বিন্দুমাত্র বিচলিত করে না। যা হোক, আমার দোলাচল ভাঙল এক বন্ধুর সহযোগিতায়। চেনা এক মানুষের নিজস্ব বাহনে সহযাত্রী হবার সুযোগ মিললো। বাসের টিকিট কেনার হ্যাপা থেকে বাঁচলাম। ঈদের ঠিক দু’দিন আগে রাস্তার যানজট এড়াতে ভোর ৬টায় ঢাকার মিরপুর থেকে রওয়ানা হলাম টাঙ্গাইলের উদ্দেশ্যে। মিরপুরের টেকনিক্যাল মোড় থেকে গাবতলী দেড় কিলোমিটার রাস্তা পার হতে ঠিক দু’ঘণ্টা সময় লাগলো। 

গাবতলী পার হয়ে ঠিক বুঝলাম না কেন এতক্ষণ থেমে ছিলাম। এরপর গাবতলী থেকে সাভার-নবীনগর-চন্দ্রা হয়ে টাঙ্গাইল আসতে ১০ ঘণ্টা সময় লেগেছে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়ি কেন চললো না স্বাভাবিক গতিতে তার কারণ বুঝিনি। রাস্তায় যানজট মোকাবিলার কোনো সরকারি ব্যবস্থা চোখে পড়েনি। কোথাও জেলাপ্রশাসনের পক্ষ থেকে কোনোরকম ব্যবস্থাই দেখিনি। পুলিশের উপস্থিতিও ছিল খুবই স্বল্প। বাসের সিট স্বল্পতা ও লাগামহীন ভাড়ার বিষয়ে কোনো প্রশাসনিক পদক্ষেপ ছিল না বলে, মানুষকে গরু বহনকারী ফিরতি ছোট ট্রাক, বড় ট্রাক এমন কি কুরিয়ার সার্ভিসের বড় বড় কাভার্ডভ্যানে প্রচণ্ড গরমে অবর্ণনীয় কষ্টে যাতায়াত করতে হয়েছে। মানুষের কষ্ট লাঘবের কোনো দুনিয়াবি ব্যবস্থা ছিল না বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই মানুষকে ক্ষোভ উৎরে দিতে দেখেছি। একজন উঁচুপদের প্রকৌশলী পরিবারসহ নিজ বাহনে ঢাকা থেকে উল্লাপাড়া যেতে পথিমধ্যে ফেসবুকে ৯ জুলাই ২০২২ দুপুর ৩.১৫ মিনিটে লিখেছেন, ‘যমুনা নদীর উপর সেতুটা বানাইবার বুদ্ধিটাকে যে দিয়েছে? এর চেয়ে আমাদের আরিচা-নগরবাড়ী ফেরি পারাপার অনেক বেশি সাশ্রয়ী ছিল! কোনো ঈদেই ভুলেও আর বাড়ির দিকে যাবো না।’

 আরেকজন ব্যাংকার বহু কষ্টে রাজশাহী পৌঁছে ফেসবুকে লিখেছেন, ‘রাজশাহী আসছি ২২ ঘণ্টা ৪৫ মিনিটে ঢাকা থেকে। সব অঙ্গে ঈদের সুখ।’ আমার মনে হয়েছে সড়কপথে বিশেষ করে ঢাকা থেকে টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু হয়ে উত্তরাঞ্চলে যাতায়াতে মানুষের কষ্ট লাঘবের ব্যাপারে স্থানীয় প্রশাসন, মন্ত্রণালয় ও সরকারের উদ্যোগ ও উদ্যমের যথেষ্ট ঘাটতি ছিল। হয়তো পদ্মা সেতুর বিষয়ে সমস্ত চিন্তা কেন্দ্রীভূত থাকায় ন্যূনতম মনোযোগ পায়নি এ অঞ্চলের সড়কপথের যাত্রীসাধারণ। টিকিটের বাড়তি দামের ব্যাপারে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের নিষ্ক্রিয়তাও বাস সিন্ডিকেটকে বেশ উৎসাহী ও বেপরোয়া করেছে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, ঈদের সময় সড়কপথে অনেক বেশি চাপ পড়ে। ফলে স্বাভাবিক ব্যবস্থা সেখানে টিকিয়ে রাখা সহজ ব্যাপার নয়। কিন্তু কিছু বাড়তি মনোযোগ ও সামান্য কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করলে মানুষের কষ্ট অনেকটাই কমানো যেত। আরেকটু সহনীয় করা যেত এ অসহনীয় ঈদযাত্রা। 

লেখক: সিনিয়র সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক 

[email protected]

নির্বাচিত কলাম থেকে আরও পড়ুন

আরও খবর

   

নির্বাচিত কলাম সর্বাধিক পঠিত

Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status