ঢাকা, ১৯ ফেব্রুয়ারি ২০২৫, বুধবার, ৬ ফাল্গুন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ১৯ শাবান ১৪৪৬ হিঃ

প্রথম পাতা

পাওনা না পেয়ে ভাড়া বাড়াচ্ছে বিদেশি এয়ারলাইন্স

শুভ্র দেব
২২ মে ২০২৪, বুধবারmzamin

বাংলাদেশের কাছ থেকে পাওনা ডলার ছাড় করে নিজ দেশে নিতে না পেরে টিকিটের মূল্য বাড়িয়ে চলছে বিদেশি এয়ারলাইন্স-গুলো। প্রায় দেড় বছরের বকেয়ার জন্য বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক চুক্তি লঙ্ঘনের অভিযোগ এনেছে আন্তর্জাতিক বিমান পরিবহন সংগঠন ইন্টারন্যাশনাল এয়ার ট্রান্সপোর্ট এসোসিয়েশন (আইএটিএ)। সংগঠনটি দ্রুত এয়ারলাইন্সগুলোর বকেয়া পরিশোধের তাগিদও দিয়েছে। সম্প্রতি এক বিবৃতিতে সংস্থাটি জানিয়েছে, বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর বাংলাদেশের কাছে পাওনা ৩২ কোটি ৩০ লাখ ডলার। যা বাংলাদেশি মুদ্রায় (প্রতি ডলার ১১৭ টাকা দরে) ৩ হাজার ৭৭৯ কোটি ১০ লাখ টাকা। বিবৃতিতে এশিয়া-প্রশান্ত অঞ্চলে আইএটিএ’র ভাইস প্রেসিডেন্ট ফিলিপ গোহ বলেছেন, লিজ চুক্তি, খুচরা যন্ত্রাংশ, ওভারফ্লাইট ফি এবং জ্বালানির মতো ডলার নির্ভর খরচ মেটাতে বিভিন্ন দেশের কাছে এই পাওনা সময়মতো পরিশোধ করা গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এই পাওনা পরিশোধে বিলম্ব দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতে আন্তর্জাতিক বাধ্যবাধকতার লঙ্ঘন এবং তা বিমান সংস্থার জন্য ঝুঁকির হার বৃদ্ধি করে। এর আগে ২০২২ সালের ডিসেম্বরে বাংলাদেশকে দেয়া আইএটিএ’র বিজ্ঞপ্তিতে ২০ কোটি ৮০ লাখ ডলার ও ২০২৩ সালের জুনে প্রায় ২১ কোটি ডলার বকেয়া থাকার বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছিল। 

গত বছর বাংলাদেশ, পাকিস্তান ছাড়া আরও তিনটি দেশকে বকেয়া পরিশোধের নোটিশ দিয়েছিল আইএটিএ। তবে অন্য তিনটি দেশই এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসলেও বাংলাদেশ পারেনি। এভিয়েশন সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অনেক দেশ এই সমস্যার সম্মুখীন হয়। তাদেরকে নোটিশও দেয় আইএটিএ। তবে অন্যান্য দেশ এই সংকট থেকে বেরিয়ে আসার উদাহরণ আছে। এসব বকেয়া সময়মতো পরিশোধ করা প্রয়োজন। কারণ এ ধরনের নোটিশের পরেও যদি পরিশোধ করা না হয় তবে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হবে। এ ছাড়া বকেয়া ডলারের জন্য একদিকে এয়ারলাইন্সগুলো বাংলাদেশ থেকে ফ্লাইট সীমিত করছে। অন্যদিকে তারা ভাড়া বাড়াচ্ছে। ফলে বাংলাদেশে টিকিট বিক্রি যেমন কমেছে তেমনি যাত্রীরাও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কিন্তু চলমান ডলার সংকটের কারণে বাংলাদেশও তাদের পাওনা পরিশোধ করতে পারছে না। এতে করে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ। সাম্প্রতিক সময়ে অনেক এয়ারলাইন্স বাংলাদেশে স্টেশন করার আগ্রহ দেখিয়েছে। তবে তারা যখন বকেয়ার বিষয়টি জানতে পারছে তখন তাদের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসছে। আবার যাত্রী বেশি হওয়াতে যেসব এয়ার লাইন্স ফ্লাইট বেশি পরিচালনার চিন্তা করেছিল তারাও ফ্লাইট কমিয়েছে। 
এভিয়েশন সূত্রগুলো বলছে, ৩০টি আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্স বাংলাদেশ থেকে ফ্লাইট পরিচালনা করে। বাংলাদেশে বিক্রি হওয়া টিকিট বিক্রির যে টাকা তারা পায় সেটি আইএটিএ’র মাধ্যমে পরিশোধ করা হয়। ট্রাভেল এজেন্সিগুলো টিকিট বিক্রি করে সেই টাকা আইএটিএ’র অ্যাকাউন্টে জমা দেয়। তবে বাংলাদেশ ব্যাংক চূড়ান্তভাবে টিকিটের অর্থ ছাড় দেয় এবং সেটি ডলারের মাধ্যমে পেমেন্ট করা হয়। কিন্তু ব্যাংকগুলোতে ডলার সংকট থাকায় পরিশোধ করা যাচ্ছে না। তবে সূত্র বলছে, বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যায়ক্রমে এয়ারলাইন্সগুলোর পাওনা ছাড় দিচ্ছে। তবে শিডিউল ব্যাংকগুলোতে ডলারের সংকট রয়েছে। 

ট্র্যাভেল ও রিক্রুটিং এজেন্সির ব্যবসায়ীরা বলছেন, বিদেশি এয়ারলাইন্সের পাওনা পরিশোধ না করাতে বহু ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে দেশের এভিয়েশন খাত। ডলারের দাম বাড়ার কারণে আগে যে দামে টিকিট কিনতে পারতেন যাত্রীরা এখন তার চেয়ে অনেক বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। প্রতি মাসে, বেশি টাকা গুনতে হচ্ছে যাত্রীদের। এতে করে যাত্রীরা ক্ষোভ প্রকাশ করছেন। বাধ্য হয়েই বেশি টাকা দিয়ে টিকিট কিনে গন্তব্যে যাচ্ছেন। বিগত বছরের তুলনায় এমনিতেই সব ধরনের যাত্রী কমে গেছে। তাই টিকিট বিক্রি করে যারা কমিশন পেতো সেটিও কমে গেছে। অনেক যাত্রী এখন কৌশলী হয়ে বিদেশ থেকে টিকিট কিনছেন। ফলে দেশের টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। সরকারও রাজস্ব হারাচ্ছে। দেশের টিকিট এজেন্টরাও কমিশন পাচ্ছে না। ফ্লাইট বন্ধ ও সীমিত করার কারণে বিমানবন্দরগুলোও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষ করে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের থার্ড টার্মিনাল ঘিরে যে পরিকল্পনা তার বাস্তবায়ন নিয়েও শঙ্কা তৈরি হয়েছে। 

ভিসা টিকিট এজেন্সির চেয়ারম্যান এমদাদুল হক মানবজমিনকে বলেন, এক লাফে ডলারের দাম ৭ টাকা বেড়ে যাওয়াতে যাত্রীদের পাশাপাশি আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি। কারণ ডলারের দাম বাড়ার কারণে টিকিট বিক্রি কমে গেছে। এতে করে আমাদের কমিশনও কম আসছে। অনেক বিদেশি এয়ারলাইন্স তাদের ফ্লাইটও কমিয়ে দিয়েছে। তাই সীমিত ফ্লাইট থেকেই যাত্রীরা তাদের টিকিট কাটছেন।  
আটাবের মহাসচিব আফসিয়া জান্নাত সালেহ মানবজমিনকে বলেন, ডলার এখন আমাদের জাতীয় ক্রাইসিস। বিদেশি এয়ারলাইন্সের যেসব  পাওনা বাংলাদেশে আছে সেগুলো রেমিট করতে হিমশিম খাচ্ছে। অনেক টাকাই জমা পড়েছে। সেজন্য তারা কম দামের টিকিট বাংলাদেশের জন্য বন্ধ করে রাখছে। অন্য দেশ বিক্রি করতে পারছে কিন্তু আমরা পারছি না। দেশে দাম বেশি থাকায় যাত্রীরা অন্য দেশ থেকে টিকিট ইস্যু করছে। বহুভাবে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত ও সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছি। এক্ষেত্রে তাদেরও কিছু করার নেই। সাত থেকে আট মাস তারা তাদের টাকা নিতে পারছে না। তারাও সমস্যার মধ্যে আছে। যাত্রীরাও বিপাকে আছে। প্রতিনিয়ত আমরা তাদের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছি। প্রবাসীরা দেশের বাইরে থেকেও টিকিটের দাম যাচাই করতে পারছে। যখনই দেখে দেশ থেকে টিকিট কাটলে বেশি টাকা গুনতে হচ্ছে তখন তারা বিদেশ থেকে টিকিট কাটছে। সেক্ষেত্রে দেশের টাকা বিদেশে চলে যাচ্ছে। আমরাও বিক্রি কম করছি। সরকারও টিকিট থেকে যে রাজস্ব পায় বিদেশ থেকে কাটলে সেটি পাচ্ছে না। অনেক বিদেশি এজেন্ট এখন গোপনে বাংলাদেশে এসে টিকিট বিক্রি করছে। তিনি বলেন, কিছু এয়ারলাইন্স চট্টগ্রাম থেকে তাদের ফ্লাইট বন্ধ করে দিয়েছে। ঢাকা থেকে অনেকে ফ্লাইট কমিয়ে দিয়েছে। আরও কিছু এয়ারলাইন্স কমানোর চিন্তা করছে। কিছু কিছু এয়ারলাইন্স এখনো চালিয়ে যাচ্ছে। তবে টাকা নিতে না পারলে ভবিষ্যতে পুরো ফ্লাইট বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশে বন্ধ করে দিলেও তারা তাদের অন্যান্য স্টেশন চালু রেখেছে। তাদের সমস্যা হবে না। 

এসোসিয়েশন অব ট্র্যাভেল এজেন্টস অব বাংলাদেশের (আটাব) প্রেসিডেন্ট ও এয়ার স্পিড লিমিটেডের ম্যানেজিং ডিরেক্টর আবদুস সালাম আরেফ মানবজমিনকে বলেন, ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়াতে গত এক বছরে ৩৫ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত টিকিটের মূল্য বেড়েছে। ডলারের দাম বাড়ায় যাত্রীদের বেশি টাকা দিতে হচ্ছে। সাধারণ যাত্রীরা তো এত বুঝে না। বেশি টাকা দিয়ে টিকিট কাটতে হচ্ছে এটিই তারা হিসাব করে। বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর যেসব শ্রেণির টিকিট আগে কম দামে পাওয়া যায় সেগুলো অনলাইনে ব্লক করে দামি টিকিট বাংলাদেশে বিক্রি করছে। অথচ বাংলাদেশ ছাড়া অন্য যেকোনো দেশ থেকে টিকিট কাটলে কম দামের টিকিট পাওয়া যায়। তারা বাংলাদেশে বেশি দামে আর অন্যান্য দেশে কম দামে বিক্রি করে। পাশের দেশের তুলনায় বাংলাদেশে টিকিটের মূল্য ২০ থেকে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি। সুযোগ সন্ধানীরা বিদেশ থেকে কম দামে টিকিট করিয়ে আনে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের লাভবান হওয়ার সুযোগ থাকে না। টাকা চলে যায় অবৈধভাবে হুন্ডি হয়ে বিদেশে। একদিকে আমাদের ডলার সংকট। অন্যদিকে টাকাও হুন্ডি হয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, এ বছর যাত্রীর সংখ্যাও অনেক কম। বিগত বছরের তুলনায় শ্রমিক, ওমরাহ, হজ ও ট্যুরিস্ট কমেছে। অর্থনৈতিক মন্দার যে প্রভাব সেটা দেখা যাচ্ছে। বিদেশি এয়ারলাইন্সগুলোর লভ্যাংশ বাংলাদেশ দিতে পারছে না। কারণ ডলার ছাড়া লভ্যাংশ দেয়া সম্ভব না। ডলার কিনতে পারছে না। ১ লাখ ডলার কিনতে গেলে শিডিউল ব্যাংক বলতেছে তাদের কাছে ১০ হাজার আছে। সেক্ষেত্রে এয়ারলাইন্সগুলো যে টিকিট বাংলাদেশে বিক্রি করে সেই টাকা নিতে পারছে না। যেটা মাসে মাসে পাঠাতে সেখানে অনেক মাসের বকেয়া রয়ে গেছে। এয়ারলাইন্স ও ফ্লাইট কমে গেলে সব চাপ এসে পড়বে যাত্রীদের ওপর। তখন টিকিটের দাম বাড়বে। ফ্লাইট কমে গেলে থার্ড টার্মিনালেও প্রভাব পড়বে। সেখানে ক্যাপাসিটি আছে কিন্তু ফ্লাইট না থাকলে বিমানবন্দরের বিনিয়োগটাও উঠবে না। এ ছাড়া প্রবাসী যাত্রীদের বেশি টাকা গুনতে হবে। এয়ারলাইন্স কোম্পানিও আগ্রহ হারিয়ে ফেলবে। সবদিক থেকেই নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। ইতিমধ্যে, চট্টগ্রাম থেকে জাজিরা এয়ারলাইন্স সপ্তাহে ৭টা ফ্লাইট দিতো। পুরোটাই বন্ধ করে দিয়েছে। ওমান এয়ারও বন্ধ করে দিয়েছে। ঢাকা থেকে কেথে প্যাসিফিক এয়ারওয়েজের ৫টা ফ্লাইট ছিল। এখন তারা সপ্তাহে ৩টা ফ্লাইট চালায়। কুয়েত এয়ারলাইন্সের ৭টা ফ্লাইট ছিল। এখন তাদের ৩টা আছে। তার্কিশ গত বছরই কমিয়ে দিয়েছিল। আগে তাদের ১৪টি ছিল এখন ৭টা চালায়। 

বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব ইন্টারন্যাশনাল রিক্রুটিং এজেন্সির (বায়রা) মহাসচিব ও ইস্ট ওয়েস্ট হিউম্যান রিসোর্স সেন্টারের পরিচালক বীর মুক্তিযোদ্ধা আলী হায়দার চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, খরচ বেড়ে যাচ্ছে। শ্রমিকদের ওপর চাপ বাড়বে। বাড়তি খরচ মেনে নিয়েই যাচ্ছে। এ ছাড়া কিছু করার নাই। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী শফিকুর রহমান চৌধুরী মানবজমিনকে বলেন, এসব বিষয় নিয়ে আমি বেসরকারি বিমান ও পর্যটন মন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলেছি। প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে বলে তিনি জানিয়েছেন।

পাঠকের মতামত

ব্যাংক এর এমডি রা বিদেশে গিয়ে ডলার খরচ করে ফুর্তি করে আর সরকার ডলারের অভাবে বিদেশি বিমানের পাওনা দিতে পারে না। সরকার এই সব সরকারি কর্মকর্তাদের বিদেশে গমন বন্ধ করা উচিত ।

Kazi
২২ মে ২০২৪, বুধবার, ৯:০০ পূর্বাহ্ন

এই ভাবেই একটি দেশের অর্থনীতি ধংস করে দেশকে অকার্যকর করে দেওয়া হয়। বাংলাদেশকে প্রকল্পিত ভাবে তলা বিহিন ঝুড়িতে বানিয়ে দেওয়া হচ্ছে।

Khan
২২ মে ২০২৪, বুধবার, ৫:১৬ পূর্বাহ্ন

lots of Development everywhere !!!

abu-mahtab
২২ মে ২০২৪, বুধবার, ১:০৮ পূর্বাহ্ন

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

প্রথম পাতা সর্বাধিক পঠিত

   
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status