নির্বাচিত কলাম
সাফ কথা
বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক নিষেধাজ্ঞায় রিজার্ভ কি বাড়বে?
কাজল ঘোষ
১৯ মে ২০২৪, রবিবারযেকোনো প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা, তথ্যের অবাধ প্রবাহ সেই প্রতিষ্ঠানের মৌল কাঠামোকেই শক্তিশালী করে। তথ্যের অবাধ প্রবাহের মাধ্যমে নিশ্চিত হয় সুশাসন। আর প্রতিষ্ঠানটি যদি হয় দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাহলে তো তার স্বচ্ছতা প্রমাণ করবে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি কতোটা শক্তিশালী।
পুরো পরিস্থিতি বিশ্লেষণে বেশ কিছু প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। ক. কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশ নিষিদ্ধ করায় রিজার্ভ উন্নতির কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা? খ. পত্র-পত্রিকায় তা দেশে বা দেশের বাইরে এ সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশ বন্ধ হয়েছে কিনা? গ. অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে? অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হলে তা সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে চাপা দেয়া কি সম্ভব? সাংবাদিকদের কাজ হচ্ছে সঠিক তথ্য প্রকাশে নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যাওয়া
এটি দু’সপ্তাহ আগের খবর। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকে আরও দু’ধাপ অবনমন ঘটেছে বাংলাদেশের। ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৬৫তম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে শুধু আফগানিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। গণমাধ্যম সূচকের মোট ১০০ পয়েন্টের মধ্যে বাংলাদেশ পেয়েছে ২৭ দশমিক ৬৪। গত বছর তা ছিল ৩৫ দশমিক ৩১। সেবার অবস্থান ছিল ১৬৩। ২০২২ সালে ৩৬ দশমিক ৬৩ পয়েন্ট নিয়ে ১৬২তম অবস্থানে এবং ২০২১ সালে ৫০ দশমিক ২৯ পয়েন্ট নিয়ে ১৫২তম অবস্থানে ছিল বাংলাদেশ। তবে গণমাধ্যম স্বাধীনতা সূচকের এরপরের বছরের রেটিং কতোটা নিচে নামবে নিশ্চিত না বলতে পারলেও অবস্থা নড়বড়ে এটা হলফ করে বলা যায়।
গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সূচকের ঠিক এক সপ্তাহের মধ্যেই সবচেয়ে আলোচিত খবরটি হচ্ছে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভেতরে সাংবাদিক প্রবেশ নিষিদ্ধ। বলা নেই, কওয়া নেই অকস্মাৎ নিষেধাজ্ঞা। সাংবাদিক সমাজ তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন এ ধরনের হঠকারী সিদ্ধান্তের। অর্থনীতিবিদরাও এ ধরনের সিদ্ধান্তের বিরূপ সমালোচনা করেছেন।
ব্যাংক খাতে চলমান অনিয়ম, লুটপাট ও অর্থ পাচারের তথ্য চেপে রাখতেই বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে কিনা, সেই প্রশ্ন তুলেছেন সাংবাদিক সমাজ। তারা বলেছেন, সাংবাদিকেরা সরকারের সহায়ক হিসেবে কাজ করে থাকেন। নানা ভালো কাজ ও অনিয়ম তুলে ধরে জনস্বার্থে বিভিন্ন সিদ্ধান্ত নিতে ভূমিকা রাখেন। এসব ভূমিকা পালন করা থেকে সাংবাদিকদের সরিয়ে রাখতে এবং তাদের মাধ্যমে ভুল ও অপ-তথ্য ছড়িয়ে দেয়ার জন্যই কি কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা দেয়া হয়েছে?
সমালোচনা হচ্ছে সর্বত্র। বাংলা?দেশ ব্যাংকে সাংবা?দিক প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে বেসরকা?রি সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেছেন, এতদিন সেখানে তথ্যের নৈরাজ্য চলছিল। এখন অপঘাত ঘটছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে সাংবাদিকদের প্রবেশ করতে দেয়া হচ্ছে না। তার মানে কী বার্তা দিচ্ছে? ওখানে এমন কিছু ঘটছে তা যদি জনসম্মুখে আসে তাহলে বড় ধরনের নাশকতা হয়ে যাবে। তার মানে সেখানে ‘ডাল মে কুচ কালা হে।’ এখন এটা কি মসুর ডাল না কি মুগ ডাল, নাকি সব ডাল। এটাই এখন বুঝার বিষয়।
সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ফাহমিদা খাতুন প্রশ্ন তুলেছেন, বাংলাদেশ ব্যাংক তার স্বাধীন সত্তা হারিয়ে ফেলেছে। মেরুদণ্ড সোজা রেখে নিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারছে না। বাইরে থেকে আরোপিত সিদ্ধান্ত কার্যকর করার প্রতি গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে। এমন সমালোচনার মধ্যেই শাসকদলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের প্রশ্ন তুলেছেন সাংবাদিকরা কেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকে যাবে। শনিবার আওয়ামী লীগ সভাপতির ধানমণ্ডির কার্যালয়ে সাংবাদিকদের তিনি বলেন, পৃথিবীর কোন দেশে সাংবাদিক সেন্ট্রাল ব্যাংকে ঢুকতে পারছে অবাধে? সব ওয়েবসাইটে আছে। আপনার জানার বিষয়, আপনি ভেতরে ঢুকবেন কেন?
জনমনে প্রশ্ন, হঠাৎ কী এমন ঘটেছে যে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশ করতে পারবে না, তা স্পষ্ট নয়। এরই মধ্যে খবর রটেছে রিজার্ভ চুরির। তাও ভারতের একটি মিডিয়ায়। যদিও বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃপক্ষ এ খবর উড়িয়ে দিয়েছেন। বাইরের দুনিয়ায় যখন এ ধরনের খবর রটছে তখন এ ধরনের নিষেধাজ্ঞায় ডালপালা ছড়ানো স্বাভাবিক। যেকোনো প্রতিষ্ঠানের স্বচ্ছতা, তথ্যের অবাধ প্রবাহ সেই প্রতিষ্ঠানের মৌল কাঠামোকেই শক্তিশালী করে। তথ্যের অবাধ প্রবাহের মাধ্যমে নিশ্চিত হয় সুশাসন। আর প্রতিষ্ঠানটি যদি হয় দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক তাহলে তো তার স্বচ্ছতা প্রমাণ করবে দেশের অর্থনৈতিক ভিত্তি কতোটা শক্তিশালী।
পুরো পরিস্থিতি বিশ্লেষণে বেশ কিছু প্রশ্নের জন্ম হয়েছে। ক. কেন্দ্রীয় ব্যাংকে সাংবাদিক প্রবেশ নিষিদ্ধ করায় রিজার্ভ উন্নতির কোনো সম্ভাবনা আছে কিনা? খ. পত্র-পত্রিকায় তা দেশে বা দেশের বাইরে এ সংক্রান্ত রিপোর্ট প্রকাশ বন্ধ হয়েছে কিনা? গ. অন্ধ হলে কি প্রলয় বন্ধ থাকে? অর্থনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হলে তা সাংবাদিকদের প্রবেশে নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে চাপা দেয়া কি সম্ভব?
সাংবাদিকদের কাজ হচ্ছে সঠিক তথ্য প্রকাশে নিরন্তর লড়াই চালিয়ে যাওয়া। এই কাজটি অনেকটাই সহজ হবে বলে মনে হয়েছিল ২০০৯ সালের এপ্রিলে যখন তথ্য অধিকার আইন পাস হয় সে সময় থেকে। কিন্তু সবই নির্ভর করছে রাজনৈতিক সদিচ্ছার উপর। আইন তার নিজস্ব গতিতে চলবে এই কথাগুলো আসলে বুকিশ। না হলে যেখানে তথ্য প্রাপ্তির অধিকার বা মত প্রকাশের স্বাধীনতা সংবিধান স্বীকৃত। সেখানে নিষেধাজ্ঞার বেড়াজালে আটকে দেয়া হচ্ছে সাংবাদিকদের।
কী লেখা আছে তথ্য অধিকার আইনের ২০ ধারায় তার উল্লেখ করতে চাই- ‘যেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধানে চিন্তা, বিবেক ও বাকস্বাধীনতা নাগরিকগণের অন্যতম মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃত এবং তথ্য প্রাপ্তির অধিকার চিন্তা, বিবেক ও বাকস্বাধীনতার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ; এবং যেহেতু জনগণ প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক ও জনগণের ক্ষমতায়নের জন্য তথ্য অধিকার নিশ্চিত করা অত্যাবশ্যক; এবং যেহেতু জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিত করা হইলে সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং সরকারি ও বিদেশি অর্থায়নে সৃষ্ট বা পরিচালিত বেসরকারি সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বৃদ্ধি পাইবে, দুর্নীতি হ্রাস পাইবে ও সুশাসন প্রতিষ্ঠিত হইবে; এবং যেহেতু সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত ও সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং সরকারি ও বিদেশি অর্থায়নে সৃষ্ট বা পরিচালিত বেসরকারি সংস্থার স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে বিধান করা সমীচীন ও প্রয়োজনীয়।’
২০০৯ সালে প্রণীত তথ্য অধিকার আইনে বাংলাদেশের যেকোনো নাগরিকের তথ্য প্রাপ্তির অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। কিন্তু নাগরিকরা সেই অধিকার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন নানাভাবে। সাংবাদিরকা পেশাগত কারণেই তথ্যের পেছনে ছুটেন। এটা তার স্বীকৃত অধিকার। কিন্তু তা যখন বাধাপ্রাপ্ত হয় তখন প্রশ্ন জাগে- আইন কী তাহলে খাতাপত্রে সংবিধানে? তথ্য অধিকার আইন কি কার্যকারিতা হারিয়েছে? এর বাস্তবভিত্তি কী ঠুনকো? তাহলে কী ‘জোর যার আইন তার’?
বাংলাদেশ ব্যাংক কেনো, গণমাধ্যম যে কোনো অকুস্থলে যেতে পারে। স্বচ্ছতা থাকলে, বাধা কেনো! তাহলে এমন কী অসচ্ছতা লুকানো অতল গহ্বরে? ধন্যবাদ কাজল দা কে।।
৩০ এমডি আমেরিকা গিয়ে যে টুকু দেউলিয়া হবার বাকি ছিল তাও ষোল কলায় পূর্ণ করবেন।