নির্বাচিত কলাম
হা ল ফি ল বৃত্তান্ত
পাহাড়ে কেএনএফ সন্ত্রাস, দৃশ্যপটে লালজার বমের চিঠি
ড. মাহফুজ পারভেজ
১৬ মে ২০২৪, বৃহস্পতিবার১৯৯৭ সালে শান্তিচুক্তি সম্পাদিত হওয়ার ২৪ বছর পর বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতি কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) ও কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)’র সশস্ত্র কার্যক্রমের কারণে কিছুটা উত্তপ্ত হয়েছে। দীর্ঘ বছর শান্তিচুক্তির আওতায় মোটের উপর শান্তি, সম্প্রীতি ও স্থিতিশীলতা অব্যাহত থাকা একটি উল্লেখযোগ্য অর্জন। বিশ্বের বহু দেশেই শান্তিচুক্তি হলেও তা কিছুদিন পরেই ভেস্তে গেছে। বাংলাদেশে তেমন সংকট হয়নি। বরং কোনো তৃতীয় পক্ষের হস্তক্ষেপ ও অংশগ্রহণ ছাড়াই পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তির কাঠামোতে সংঘাতের অবসান হয়ে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান বিরাজ করছে।
উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো- শান্তিচুক্তির আগে যেসব জায়গায় অশান্তি বেশি ছিল, তা এখন সম্পূর্ণ শান্ত। আর যেসব জায়গা শান্ত ছিল, তা এখন অশান্ত। বিষয়টি সরজমিন লক্ষ্য করেছি- গত শুক্র ও শনিবার (১০ ও ১১ই মে) খাগড়াছড়িতে। খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি মং রাজবাড়ী থেকে বের হয়ে বাইরের শান্ত হাটবাজারের পরিবেশ-পরিস্থিতি দেখে মোটেও টের পাওয়া যায় না যে, কয়েক মাস আগেই পাহাড়ের আরেক প্রান্তের বান্দরবানে কুকি-চিন গোষ্ঠীর সশস্ত্র হামলায় সাধারণ জনজীবন তটস্থ হয়েছিল। সেখানে এখনো ভীতির আবহ বিরাজমান। কিন্তু এদিকের অবস্থা একেবারেই বিপরীত। উন্নয়ন ও অগ্রগতির স্পষ্ট ছাপ বৃহত্তর পার্বত্য চট্টগ্রামের উত্তরাংশে। মানিকছড়ির কাছেই রামগড়ে চালু হচ্ছে বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে আন্তর্জাতিক স্থলবন্দর। এ তুলনায় পাহাড়ের দক্ষিণাংশ, বিশেষত মিয়ানমার সীমানা সংলগ্ন বান্দরবান অপেক্ষাকৃত উত্তপ্ত। একদা শান্তিবাহিনীর আমলে যে উত্তরাঞ্চল ছিল সন্ত্রাসকবলিত, তা এখন শান্ত ও উন্নয়নমুখী। আর তখন যে দক্ষিণাঞ্চল ছিল শান্ত, সেটা বরং চাপা উত্তেজনায় টগবগ করছে।
শান্তিচুক্তির আওতায় উন্নয়ন, সম্প্রীতি ও শান্তির পথে চলমান পার্বত্য চট্টগ্রাম বর্তমানে ভূরাজনৈতিক ও অভ্যন্তরীণ কিছু কারণে আবার সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছে। রাজনৈতিক ও সামাজিক উদ্যোগে এসব সমস্যা কাটিয়ে শান্তির সুবাতাস ও উন্নয়নের মসৃণ ধারা চালু হলে বদলে যাবে সমগ্র পাহাড়ের চেহারা। অন্ধকার ও পিছিয়ে থাকা পাহাড় পরিণত হবে দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির ভ্যানগার্ডে।
সাধারণ মানুষও সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে শান্তির পক্ষে অবস্থান নেয়ায় পরিস্থিতির ইতিবাচক উত্তরণ হয়েছে। অতিসম্প্রতি কুকি-চীন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) ও কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)’র নেতৃবৃন্দের প্রতি ‘বম ভাষায়’ একটি অডিও বার্তা দিয়েছে ‘বম সোশ্যাল কাউন্সিল অব বাংলাদেশ’। বম ভাষায় কেএনএফ/কেএনএ’র প্রতি দেয়া কাউন্সিলের প্রধান লালজার লম বমের এই অডিও বার্তাটিতে শান্তির আহ্বান জানানো হয়েছে।
এতে বলা হয়েছে, বান্দরবানে যে ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর কারণে আমাদের মন ভালো নাই, কষ্টে আমরা দিন কাটাচ্ছি। এই অবস্থায় আপনারা যারা কেএনএ এবং কেএনএফ তাদের প্রতি আমাদের বম জাতি গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে অনুরোধ জানাচ্ছি- বাংলাদেশ সরকার অস্ত্রের জন্য যে কম্বিং অপারেশন চালাচ্ছে এর প্রভাব বম জাতির উপর পড়েছে এবং কেএনএফ’র দায়িত্বে যারা আছেন তারা বুঝতে চেষ্টা করেন, ১৪টি অস্ত্র ফেরত পাওয়ার জন্য সরকারের নির্দেশে সকল রাষ্ট্রীয় সংস্থা যে অভিযান চালাচ্ছে তা অস্ত্র ফেরত না পাওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে।
লালজার লম বলেন, অভিযান চলতে থাকলে বমদের প্রতি আরও বিভিন্ন বাধা-বিপত্তি আসবে এবং আমরা বম সোশ্যাল কাউন্সিল সরকারের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে গেছি বলে এখন পর্যন্ত বড় আকারে কোনো অভিযান চালানো হয়নি। কম্বিং অপারেশনের ফলে বিভিন্ন বম পাড়ার বাসিন্দারা ভয়ে পাড়ার বাইরে জঙ্গলে অবস্থান নিয়েছে এবং তারা খাদ্য সংকটে রয়েছে। ইতিমধ্যে অভিযানের ফলে বম জাতি গোষ্ঠীর অনেকে নিহত ও আহত হয়েছে। যারা মারা গেছে তাদের লাশ বম কাউন্সিল গ্রহণ করেছে এবং সৎকারের ব্যবস্থা করেছে। এই লাশগুলো আগে সামাজিক রীতিনীতি মেনে সৎকার করা হতো। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে তা আর সম্ভব নয়। যারা লাশ বহন এবং সৎকারে জড়িত তারাও ভয়ে ভয়ে তা করেছে এবং কবর খোঁড়া থেকে শুরু করে সমাহিত করা পর্যন্ত কাজগুলো অন্য সম্প্রদায়ের লোকজন করেছে। এই পরিস্থিতি তোমাদেরকে (কেএনএফ) চিন্তা করতে হবে। এই পরিস্থিতিতে আমরা গির্জায় যেতে পারছি না এবং ধর্মীয় রীতিনীতিগুলোও পালন করতে পারছি না। এবিষয়ে কেএনএফ/কেএনএ’র নেতৃবৃন্দ যারা আছো তাদেরকে চিন্তা করতে হবে।
তিনি বলেন, তোমরা যদি সরকারের কাছে অস্ত্র ফেরত দাও তাহলে সরকারও তোমাদেরকে ক্ষমা করে দিবে। আমি পুরো বম জাতিগোষ্ঠীর পক্ষ থেকে তোমাদের প্রতি অনুরোধ করছি- তোমরা যে ১৪টি অস্ত্র ছিনিয়ে নিয়েছো তা যত দ্রুত সম্ভব ফেরত দাও। ২২শে এপ্রিলের ৩য় বৈঠকের অপেক্ষা না করে তোমরা অস্ত্র ছিনতাই এবং লুট করেছো। তার কারণে আজ আমাদের বমদের এই অবস্থা। অস্ত্র ফেরত দিলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে শক্তিশালী শান্তি প্রতিষ্ঠা কমিটি গঠন করা হবে। এই কমিটিতে সরকারের পক্ষ থেকে গুরুত্বপূর্ণ লোকজন থাকবে। আমাদের অনুরোধ- অতীতের সবকিছু ভুলে নতুন যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে তাতে তোমরা সম্মতি দাও। বিশেষ করে নাথান বম, সভাপতি কেএনএফ; ভাং চুক লিয়ান বম, সহ-সভাপতি; লাল জং ময়, মুইয়া সাধারণ সম্পাদক, কেএনএফ; তোমাদের প্রতি পুরো জাতি গোষ্ঠীর পক্ষ থেকে অনুরোধ।
লালজার লম জানান, বর্তমানে আম, আদা, লিচু এবং আনারসের মৌসুমে বম জাতি গোষ্ঠীর কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়ে গেছে। তোমরা যে দেশ পাওয়ার স্বপ্ন দেখেছো তা কখনো সম্ভব না এবং আমাদের এত লোকজন নাই। সবকিছু বুলেটের মাধ্যমে হয় না। অনেক কিছু দু’পক্ষের আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা সম্ভব। কর্নেল ভাপুয়াপি তোমার মাধ্যমে আমি এই মেসেজ তোমাদের নেতাদের কাছে পাঠালাম।
সন্দেহ নেই, ‘বম সোশ্যাল কাউন্সিল অব বাংলাদেশ’- এর সভাপতি লালজার লম বম স্বপ্রণোদিত হয়ে যে আহ্বান জানিয়েছেন, তা অত্যন্ত তাৎপর্যবাহী। কারণ, শান্তি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত বা অস্ত্রের জোটে আসে না। শান্তি আসে সমাজে বসবাসকারী মানুষের একান্ত ইচ্ছা ও আগ্রহে। ‘বম সোশ্যাল কাউন্সিল অব বাংলাদেশ’ বম জনগণের পক্ষে দাঁড়িয়ে যে শান্তির বার্তা দিয়েছে, তা সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে জনগণের অবস্থানের বহিঃপ্রকাশ। এতে সন্ত্রাসী গোষ্ঠী জনসমর্থন ও নৈতিক বল হারাবে।
বম সোশ্যাল কাউন্সিল অব বাংলাদেশ’-এর আহ্বান এটাও প্রমাণ করেছে যে, সন্ত্রাসীরা জনবিচ্ছিন্ন এবং তাদের অগ্রহণযোগ্য কার্যক্রম জনগণকে বিপদগ্রস্ত করেছে। সন্ত্রাসীদের হটকারিতার ফলে সৃষ্ট বিরূপ পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে সাধারণ মানুষ। তাদের জানমাল ও অর্থনৈতিক জীবন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে এসবের দায়দায়িত্ব সশস্ত্র সন্ত্রাসী গ্রুপগুলোর উপর বর্তায়।
এ কথা সর্বজনবিদিত যে, সন্ত্রাসের মাধ্যমে সন্ত্রাসীদের কিছু লাভ হলেও বিরাট ক্ষতি হয় সাধারণ মানুষের। বিশ্বের সন্ত্রাসকবলিত বিভিন্ন দেশের পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হলে এ সত্য স্পষ্ট হয়। কারণ সেসব স্থানে মারা যাচ্ছে সাধারণ মানুষ। ঘরবাড়ি হারিয়ে উদ্বাস্তু হচ্ছে নিরীহ মানুষজন। অতএব, সন্ত্রাস কোনো অবস্থাতেই সাধারণ মানুষের জন্য কোনোই কল্যাণ বয়ে আনে না।
বরং শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের নীতিতে রাজনৈতিক কৌশল অবলম্বন করে কাজ করা হলে অনেক বেশি লাভ হয়। এতে দাবি-দাওয়া আদায়ের পথ যেমন প্রশস্ত হয়, তেমনিভাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কম হয়।
অতীতে জনসংহতি সমিতি সশস্ত্র শান্তিবাহিনী গঠন করে প্রচুর রক্তক্ষয় করলেও লাভবান হতে পারেনি। ভ্রাতৃঘাতী সংঘাতে তাদের অনেক বেশি ক্ষতি হয়েছে। তারা লাভবান হয়েছেন শান্তিচুক্তির মাধ্যমে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষমতার অংশীদার হতে পেরেছেন। কোটা ব্যবস্থায় চাকরি ও কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব সাফল্য পেয়েছেন। সর্বোপরি, উন্নয়নের নবযুগের দেখা পেয়েছেন তারা।
সামাজিক ও প্রশাসনিক দিক থেকে কোণঠাসা কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) ও কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)-এর সামনে সময় এসেছে তাদের কৌশল পুনঃনির্ধারণ করার। পুরনো পথে অস্ত্র হাতে চলার বদলে রাজনীতির মসৃণ পথে চলে তারা তাদের দাবি-দাওয়া নিয়ে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন করতেই পারে। গণতান্ত্রিক বাংলাদেশে নাগরিক সমাজের অধিকার আদায় করার সংবিধান ও আইন স্বীকৃত বহু পথ ও পন্থা আছে। সেগুলো গ্রহণ করাই তাদের জন্য সুবিবেচনার কাজ হবে।
কোনো দাবি আদায়ের জন্য সশস্ত্র পন্থায় সংঘাতের আশ্রয় নেয়া যেমনভাবে কাম্য নয়, তেমনিভাবে জন দাবি ও অধিকার অগ্রাহ্য করাও সমীচীন নয়। পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৩টি ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর পাশাপাশি রয়েছেন পাহাড়ে বসবাসকারী বাঙালি জনগোষ্ঠী। তাদের নিজ নিজ ভাষা, সংস্কৃতি ও অধিকার কীভাবে নিশ্চিত ও নিরঙ্কুশ রাখা যায়, সেটা দেখা রাষ্ট্রের দায়িত্ব। রাষ্ট্রকে অবশ্যই সে দায়িত্ব নিতে হবে এবং সকল আইন মান্যকারী নাগরিককে সুরক্ষা দিতে হবে। শান্তিচুক্তি সম্পাদন করে রাষ্ট্র পার্বত্য চট্টগ্রামের জন্য তেমনই একটি অনুকূল পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। ফলে বিভেদ বা হটকারিতার বদলে শান্তিপূর্ণ আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে নিজের অধিকার আদায়ে সচেষ্ট হওয়া সকলের দায়িত্ব।
কুকি-চিন ন্যাশনাল ফ্রন্ট (কেএনএফ) ও কুকি-চিন ন্যাশনাল আর্মি (কেএনএ)’র প্রতি ‘বম সোশ্যাল কাউন্সিল অব বাংলাদেশ’-এর আহ্বানে যে বাস্তবতার প্রতিফলন এবং সাধারণ বম জনগণের অভিমতের প্রতিধ্বনি রয়েছে, তা অনুধাবন করা হলে শান্তির পথ প্রসারিত হবে। হটকারিতার বদলে নিয়মতান্ত্রিক ধারা গ্রহণে যে প্রত্যাশা কাউন্সিলের পক্ষে জানানো হয়েছে, সেটা গ্রহণ করাই সংশ্লিষ্টদের জন্য কল্যাণকর হতে পারে।
লেখক: প্রফেসর, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ও নির্বাহী পরিচালক, চট্টগ্রাম সেন্টার ফর রিজিওনাল স্টাডিজ, বাংলাদেশ (সিসিআরএসবিডি)।