বাংলারজমিন
শোলাকিয়ায় জঙ্গি হানার ছয় বছর
স্টাফ রিপোর্টার, কিশোরগঞ্জ থেকে
৭ জুলাই ২০২২, বৃহস্পতিবার২০১৬ সালের ৭ই জুলাই। দিনটি ছিল বৃহস্পতিবার। ঈদুল ফিতরের দিন। সময় সকাল পৌনে ৯টা। কিশোরগঞ্জ শহরের প্রতিটি রাস্তা, অলিগলিতে জনস্রোত। সবাই শোলাকিয়ার দিকে যাচ্ছিলেন। ১০টায় শুরু হবে ঈদ জামাত। মাঠে চলছে সহকারী ইমামের বয়ান। এরমধ্যেই হঠাৎ দুমদাম বিস্ফোরণের শব্দ। বিস্ফোরণ হয় মাঠ থেকে দুইশ’ গজ দূরে আজিমউদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয়ের পাশে, মুফতি মোহাম্মদ আলী মসজিদ সংলগ্ন রাস্তায়।
এরমধ্যেই হাতবোমা ছুড়ে মারা হয় পুলিশকে লক্ষ্য করে। বোমার বিস্ফোরণে কয়েকজন পুলিশ সদস্য মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। আক্রান্ত অন্য পুলিশ সদস্যরা আত্মরক্ষার্থে পিছু হটেন। চেকপোস্ট আক্রান্ত হওয়ার খবরে অন্য পুলিশ সদস্যরা ঘটনাস্থলে গিয়ে জঙ্গিদের ধরতে অভিযানে নামেন। এ সময় জঙ্গিরা পুলিশকে লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু করে। পুলিশও পাল্টা গুলি ছোড়া শুরু করে। চেকপোস্টটি দিয়ে ঈদগাহমুখী মুসল্লিরা তখন আত্মরক্ষার্থে দিগ্বিদিক ছুটতে থাকেন। জঙ্গি হামলা ও বন্দুকযুদ্ধের পুরো বিষয়টি পাঁচতলার বাসা থেকে প্রত্যক্ষ করেন সবুজবাগ এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী হাফিজুর রহমান রেণু। তিনি জানান, ঘুম থেকে উঠে জামাতে যেতে গোসলের প্রস্তুতি নেন তিনি, এমন সময়েই বোমার বিস্ফোরণ। ঘটনার বিবরণ এবং জঙ্গিদের অবস্থান জানিয়ে হাফিজুর রহমান রেণু সদর থানার ওসিসহ জেলা পুলিশের ঊর্ধ্বতন একাধিক কর্মকর্তাকে ফোনে অবহিত করেন। এরপরই পুলিশ জঙ্গিদের ধরতে অভিযান শুরু করে। পুলিশের সঙ্গে জঙ্গিদের গোলাগুলিতে তখন কান ঝালাপালা অবস্থা। জঙ্গিরা ঢুকে পড়ে রেণুর বাসার সামনে সবুজবাগ গলিতে। ভয়ে বাসার সবাই দরজা-জানালা বন্ধ করে মেঝেতে শুয়ে পড়েন। নিচের কেচিগেট লাগিয়ে দেয়া হয়। হাফিজুর রহমান রেণু বাসার চারতলায় গিয়ে জানালার পাশে অবস্থান নেন। তার বাসার পাশের বাসার বাইরে ঘুপচিতে দুই জঙ্গি অবস্থান নিয়েছিল।
তাদের ধরতেই গুলিবিনিময়। হাফিজুর রহমান রেণু বলেন, ‘পুলিশ গুলি ছুড়তে ছুড়তে যখন ঘুপচির দিকে এগিয়ে যায় তখন এক হামলাকারী পুলিশকে লক্ষ্য করে হাতবোমা নিক্ষেপ করে। ঘুপচির ওপাশে দেয়াল দিয়ে বন্ধ থাকায় দুই হামলাকারী আটকা পড়ে যায়। এক হামলাকারী এ সময় হাতে থাকা চাপাতি ঘোরাতে ঘোরাতে পুলিশকে আক্রমণ করতে আসে। একপর্যায়ে সে সময়ের কিশোরগঞ্জ সদর থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ মুর্শেদ জামান (বর্তমানে অষ্টগ্রাম থানার ওসি) সহ কয়েকজন পুলিশ সদস্য একের পর এক গুলি করে চাপাতি হাতে থাকা জঙ্গিকে মাটিতে ফেলে দেন। সবুজবাগ গলি থেকে পুলিশের ওপর জঙ্গিরা গুলি ছুড়ছে। নিক্ষেপ করছে হাতবোমা। বিপরীত দিক থেকে পুলিশও পাল্টা গুলি ছুড়ছে। এ সময় একটি গুলি সবুজবাগ এলাকার বাসিন্দা গৌরাঙ্গনাথ ভৌমিকের ঘরের টিনের জানালা ভেদ করে ঘরে তার স্ত্রী ঝর্ণা রানী ভৌমিকের মাথায় গিয়ে লাগে। সঙ্গে সঙ্গেই মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। মৃত্যু হয় তার। অন্যদিকে জঙ্গি হামলায় আহতদের মধ্যে কিশোরগঞ্জ জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে কনস্টেবল জহিরুল ইসলাম তপুর মৃত্যু হয়। এ ছাড়া কনস্টেবল আনসারুল হককে ময়মনসিংহ সিএমএইচে নেয়ার পর ওইদিনই দুপুরে সেখানে তার মৃত্যু হয়। এ ছাড়া পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ঘটনাস্থলে নিহত হয় নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া জঙ্গি আবির রহমান (২৩)। ঘটনাস্থল থেকে অপর জঙ্গি দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট এলাকার শফিউল ইসলাম ওরফে ডন (২২)কে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় র্যাব আটক করে।
পরবর্তীতে নান্দাইলের ডাংরী এলাকায় র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে সে মারা যায়। ওইদিন জীবন তুচ্ছ করে প্রথম প্রতিরোধ গড়েন চেকপোস্টের দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা। জঙ্গিদের হামলায় দুইজন নিহত ও ১৪ পুলিশ সদস্য আহত হন। পুলিশ বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিয়ে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে জঙ্গিদের প্রতিরোধ করায় নির্বিঘ্নে অনুষ্ঠিত হয়েছিল শোলাকিয়ার বৃহত্তম ঈদ জামাত। ঘটনাস্থল সবুজবাগ গলির নাম এখন ‘ঝর্ণা রানী ভৌমিক সড়ক’। গলির ভেতরে বিভিন্ন বাসার দেয়ালে এখনো গুলির চিহ্ন। এগুলো এখনো মুছেনি। ছয় বছরেও এলাকাবাসী ভুলতে পারেননি সেই দুঃসহ স্মৃতি। সেই ভৌমিক নিবাসে আজও শোকের আবহ। যে জানালাটা ভেদ করে গুলি ভেতরে গিয়ে ঝর্ণা রানী মারা যান, জানালাটার পাশে টানানো ৭ই জুলাইয়ের স্মৃতি হিসেবে টানানো হয় ঝর্ণা রানীর ছবি। ঝর্ণা রানীর স্বামী গৌরাঙ্গ ভৌমিক জানান, ‘ছোট ছেলে শুভদেব মায়ের ছবি নিয়ে এখনো কাঁদে। বাইরে কোনো কিছুর শব্দ হলেই ভয়ে আঁতকে ওঠে সে। রাতে ‘মা’ ‘মা’ করে চিৎকার করে প্রায়ই ঘুম থেকে জেগে ওঠে। ঘুমানোর আগে দরজা জানালা ভালো করে বন্ধ করতে বলে আমাকে।’ শুধু ঝর্ণা রানী ভৌমিকের পরিবারের সদস্যরা নয়, সেই ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় এলাকাবাসীও এখনো ভুলতে পারেননি সেদিনের দুঃসহ স্মৃতি। তাদের ভাষ্য, এখনো সেদিনের কথা মনে হলে তারা আঁতকে ওঠেন। বিশেষ করে শিশুদের মন থেকে এই ঘটনার স্মৃতি দূর হচ্ছে না কিছুতেই।