অনলাইন

বঙ্গবন্ধুভক্ত একজন ফিদেল কাস্ত্রোর গল্প

হাসান হামিদ

২৭ নভেম্বর ২০১৬, রবিবার, ৯:২৪ পূর্বাহ্ন

নিন্দিত করুন । কোন ব্যাপার না । ইতিহাস আমাকে মুক্তি দেবে
— ফিদেল  আলেহান্দ্রো  কাস্ত্রো
সুখি হওয়ার জন্য সবচে বেশি প্রয়োজন স্বাধীনতা । কোথাও বেড়াতে গেলে আমার ভালো লাগে না তেমন; ভালো লাগে না, কারণ আমি সেখানে অতোটা মুক্ত থাকতে পারি না ।  ইচ্ছে হলেই পা ছড়িয়ে বসে পড়া; নিজের ঘর ছাড়া পারা যায় না কোথাও । আজকাল ঢাকা ছেড়েও আমি থাকতে পারি না, এই কোলাহলে শ্বাস না নিলে আমার দম বন্ধ লাগে । সেবার প্রফেসর ডঃ অরুণ চক্রবর্তী দেখেছিলেন কলকাতা থেকে ঢাকা ফিরতে এই সামান্য সময়ে আমার কতো ছটফটানি ছিলো ! এর কারণ আমি কেবল নিজের জায়গাটিতেই সবথেকে সুখি আর মুক্ত থাকি ।
আমার এই ঝুলপড়া রঙহীন দেয়াল, আধ-পুরনো বারান্দাই আমার সব । স্বাধীনতার, মুক্ত হওয়ার যে কী স্বাদ তা বিজয় পরবর্তী বাঙালি সেদিন বুঝেছিল । আমার কাছে তাই ভালোবাসা মানেই বাংলাদেশ, বাংলাদেশ মানেই শেখ মুজিবুর রহমান, একজন  হিমালয় মানব ।  বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল কমিউনিস্ট নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর। বঙ্গবন্ধু সারা বিশ্বের কাছে নিঃশর্ত সাহায্য চেয়েই বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সঙ্গে কোনো আপস তিনি করবেন না। তারপর দেশ মুক্ত হওয়ার পর, ১৯৭৩ সালে আলজেরিয়ায় অনুষ্ঠিত জোট নিরপেক্ষ আন্দোলনের (ন্যাম) চতুর্থ সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ ও কিউবা ছিল। সেই সময়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে কিউবার বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রোর সাক্ষাৎ হয়। সে সময় তিনি বঙ্গবন্ধুকে আলিঙ্গন করে বলেছিলেন, ‘আই হ্যাভ নট সিন দ্য হিমালয়েজ। বাট আই হ্যাভ সিন শেখ মুজিব। ইন পারসোনালিটি অ্যান্ড ইন কারেজ, দিস ম্যান ইজ দ্য হিমালয়েজ। আই হ্যাভ দাজ হ্যাড দ্য এক্সপিরিয়েন্স অব উইটনেসিং দ্য হিমালয়েজ।’ অর্থাৎ, ‘আমি হিমালয় দেখিনি। তবে শেখ মুজিবকে দেখেছি। ব্যক্তিত্ব ও সাহসে এই মানুষটি হিমালয়ের সমান। এভাবে আমি হিমালয় দেখার অভিজ্ঞতাই লাভ করলাম।’
বঙ্গবন্ধু ভক্ত এই ফিদেল কাস্ত্রোকে বুঝতে হলে কিউবা বিপ্লবের দিকে তাকাতে হবে । বিপ্লবের পরিকল্পনায় কাস্ত্রের প্রথম পদক্ষেপ ছিল মেক্সিকো হতে কিউবায় আক্রমণ চালান। হাভানা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে পড়ার সময়, ফিদেল কাস্ত্রো তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু করেন। এরপর কিউবার রাজনীতিতে একজন বিখ্যাত ব্যক্তিতে পরিণত হন। তাঁর রাজনৈতিক জীবন শুরু হয় প্রেসিডেন্ট ফালজেন্সিও বাতিস্তা এবং কিউবার উপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রাজনৈতিক প্রভাবের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী সমালোচনা নিবন্ধ লিখে। তিনি এ ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সমর্থ হন। অবশেষে তিনি ১৯৫৩ সালে মনকাডা ব্যারাকে একটি ব্যর্থ আক্রমণ করেন, এবং তারপর কারারুদ্ধ হন ও পরে ছাড়া পান। এরপর তিনি বাতিস্তার সরকার উৎখাতের জন্য সংগঠিত হওয়ার জন্য মেক্সিকো যান। ফিরে এসে ১৯৫৬’র ডিসেম্বরে সরকার উৎখাতে নামেন। এর আগে  ১৯৫৬ সালের ২৫শে নভেম্বর তারা কিউবার উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করে। পৌছানোর সাথে সাথেই বাতিস্তার সেনাবাহিনী কর্তৃক আক্রন্ত হন।তার ৮২ জন সহচরী মারা যান অথবা কারাবন্দী হয়, মাত্র ২২জন এ যাত্রায় বেঁচে যায়। চে গুয়েভারা তার বইয়ে লিখেছিলেন সেটা ছিল সেই রক্তক্ষয়ী মুখামুখি সংঘর্ষের সময় যখন তিনি তার চিকিত্সাসামগ্রীর সাথে একজন কমরেডের ফেলে যাওয়া এক বাক্স গোলাবারুদ নিয়েছিলেন, যা তাকে পরিশেষে চিকিত্সক থেকে বিপ্লবীতে পরিনত করে। সিয়েরা মস্ত্রা পর্বতমালায় বিদ্রোহীদের ছোট্ট একটা অংশ পুনরায় সংঘবদ্ধ হতে পেরেছিল। সেখানে তারা ২৬ শে জুলাই আন্দোলনের গেরিলা এবং স্থানীয় লোকজনদের সহযোগিতা লাভ করেছিলেন। সিয়েরা থেকে দল উঠেয়ে দেবার সময় কাস্ত্রোর একটি সাক্ষাতকার নিউয়র্ক টাইমসে প্রকাশ করা হয়। যার আগে ১৯৫৭ পর্যন্ত সারা পৃথিবীর মানুষ জানত না তিনি বেঁচে আছেন কি না! সেই নিবন্ধে কাস্ত্রো ও বিপ্লবীদের কাল্পনিক ছবি ছিল।
ফিদেল কাস্ত্রোকে বিভিন্ন প্রতিযোগিতা, কূটনীতি এবং অধ্যবসায়ের কথা জানিয়ে ছিলেন চে। যুদ্ধচলাকালীন চে বিদ্রোহী সেনাবাহিনীর অখন্ড অংশ হয়ে গিয়েছিলেন। ফিদেল কাস্ত্রো গুয়েভারাকে গ্রেনেড তৈরির কারখানা, রুটি সেকানোর জন্য চুল্লি প্রস্তুত এবং নিরক্ষর সঙ্গীদের লেখাপড়ার জন্য পাঠশালা তৈরির দায়িত্ব দেন। তাছাড়াও একটি স্বাস্থ্য কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, সামরিক প্রশিক্ষনের কর্মশালা আয়োজন এবং তথ্য সরবরাহের জন্য পত্রিকা প্রচার করার দায়ীত্ব প্রদান করেন। বিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন তিন বছর পর চে গুয়েভারাকে ’’কাস্ত্রোর মস্তিষ্ক’’’ বলে আখ্যায়িত করেছিল।
পরবর্তীকালে কাস্ত্রো কিউবান বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসেন যা যুক্তরাষ্ট্রের মদদে চলা বাতিস্তার স্বৈরশাসনকে ক্ষমতাচ্যুত করে। কিউবা বিপ্লবের প্রধান নেতা ফিদেল ১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ডিসেম্বর ১৯৭৬ পর্যন্ত কিউবার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন এবং এরপর ২০০৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্বেচ্ছায় সরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত কিউবার মন্ত্রী পরিষদের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। তিনি কিউবা কমিউনিস্ট দলের প্রধান হিসেবে ১৯৬১ সালে দলের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আমৃত্যু ছিলেন। তিনি কিউবার সর্বোচ্চ সামরিক পদ কমান্ডার ইন চিফ পদেও আসীন হন।
গত এপ্রিলে ফিদেল কাস্ত্রো দেশটির কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেসের শেষ দিনে নিজ বানীতে বলেছিলেন, ‘কিউবায় কমিউনিস্ট পার্টি এখনও তাদের নীতি অনুসরন করে চলছে। তাদের ধারণা বৈধ এবং কিউবার মানুষ বিজয়ী হউক’। তরুণ বয়সে তিনি ছিলেন যুগান্ত সৃষ্টিকারী একজন নেতা। তবে বার্ধক্যের কারণে নিজের সাথে হেরে গেলেন এই কিংবদন্তি। একাত্তরে মুক্তিকামী বাঙালিদের পক্ষে দাঁড়ানো ফিদেল কাস্ত্রোকে বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে ‘মুক্তিযুদ্ধ মৈত্রী সম্মাননায়’ ভূষিত করা হয়।
আজ অফিসে প্রথম যে সংবাদটিতে আমার চোখ আটকে যায় তা হলো, কিউবার প্রাক্তন বিপ্লবী নেতা ফিদেল কাস্ত্রো স্থানীয় সময় শুক্রবার রাত ১০টা ২৯ মিনিটে মারা গেছেন। খুব খারাপ লাগা আজকের দিনটি পার করেছি । কাস্ত্রোর ঘনিষ্ঠ সহযোগী অগাস্টিন ডায়াজ কারটে এর একটি উক্তি দিয়ে লেখাটি শেষ করবো, তিনি বলেন, ‘ফিদেল কাস্ত্রো ছিলেন তৃতীয় বিশ্বের শুভাকাঙ্ক্ষী দৈত্য’ । তৃতীয় বিশ্বের জন্য তিনি যা করেছেন অন্য কেউ তা করতে পারেনি ।
লেখক- গবেষক ও বেসরকারি সংস্থার উন্নয়ন কর্মকর্তা ।
Logo
প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2024
All rights reserved www.mzamin.com
DMCA.com Protection Status