প্রথম পাতা
সৎ করদাতারা তিরস্কৃত
স্টাফ রিপোর্টার
৮ জুন ২০২৪, শনিবার![](https://mzamin.com/uploads/news/main/113453_sot.webp)
আগামী অর্থবছরের জন্য প্রস্তাবিত বাজেট দিয়ে চলমান সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব নয় বলে মনে করছে গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)। সংস্থাটির মতে- বাজেটে সামষ্টিক অর্থনীতির ক্ষেত্রে দিক নির্দেশনা নেই, অথচ উচ্চাকাক্সক্ষী কথা আছে। এ ছাড়া চলমান অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় বাজেটে মূল্যস্ফীতির চাপ কমিয়ে জনজীবনে স্বস্তি আনাসহ যে বিষয়গুলোতে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া দরকার ছিল সে বিষয়ে পর্যাপ্ত পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। বাজেটে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ক্ষেত্রে লক্ষ্যমাত্রা উল্লেখ করা হলেও কীভাবে সেটি অর্জিত হবে তাও বলা হয়নি। একইসঙ্গে কালোটাকা আবারো সাদা করার সুযোগ দিয়ে সৎ করদাতাদের তিরস্কৃত করা হয়েছে বলেও জানিয়েছে সংস্থাটি। তবে বাজেটের আকার খুব বেশি না বাড়ানোকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে সিপিডি।
গতকাল রাজধানীর বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ২০২৪-২৫ অর্থ বছরের বাজেট পর্যালোচনা সংক্রান্ত সংবাদ সম্মেলনে সিপিডি’র গবেষকরা এসব কথা বলেন। সংবাদ সম্মেলনে মূল বক্তব্য উপস্থাপন করেন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। উপস্থিত ছিলেন সিপিডি’র সম্মানীয় ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান, গবেষণা পরিচালক ড. খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো তৌফিকুল ইসলাম খানসহ অন্য গবেষকরা।
ফাহমিদা খাতুন বলেন, এক্সট্রা অর্ডিনারি সময়ে অর্ডিনারি বাজেট দেয়া হলো। আমাদের প্রত্যাশা ছিল এই বাজেট অনেক উদ্ভাবনী হবে। এখানে সৃজনশীল ও কিছু সাহসী পদক্ষেপ থাকবে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জিং সময়ে গতানুগতিক এই বাজেট কোনো ধরনের সমস্যার সমাধান দিতে পারবে না মন্তব্য করে তিনি বলেন, চলমান অর্থনৈতিক উদ্বেগ মোকাবিলায় যে দৃঢ় পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন, বাজেটে সেই পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। এবারের বাজেট আমাদের কাছে অতীতের বাজেটের মতোই মনে হয়েছে।
১৫ শতাংশ কর দিয়ে বিনা প্রশ্নে অপ্রদর্শিত আয় বৈধ করার সুযোগ ফিরিয়ে আনার সমালোচনা করে ফাহমিদা খাতুন বলেন, আমরা গত কয়েক বছর ধরে দেখছি এই সুবিধা দেয়ার পরও রাজস্ব সংগ্রহ খুব বেশি বাড়ে না। যারা সৎভাবে আয় করে কর দিচ্ছেন, তাদের সর্বোচ্চ করের হার ৩০ শতাংশ। আর যারা কর দেননি, আয় কীভাবে করেছেন তা পরিষ্কার না, তাদের ১৫ শতাংশ কর দিয়ে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে। এটা সৎ করদাতাদের প্রতি চরম অন্যায়। নৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয়। এতে যারা কর ফাঁকি দিচ্ছে তাদের উৎসাহিত করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, উচ্চ মূল্যস্ফীতি, নিম্ন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ, টাকার দুর্বল মান, আমদানি কমে যাওয়া, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সরবরাহে সমস্যাসহ সামষ্টিক অর্থনীতিতে যন্ত্রণা চলছে। প্রত্যেকটা জায়গায় অস্বস্তি রয়েছে। এরকম সময়ে প্রস্তাবিত বাজেটে যেসব প্রক্ষেপণ করা হয়েছে সেগুলো বাস্তবতার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। সামষ্টিক অর্থনীতির সংকট মোকাবিলায় মূল্যস্ফীতির চাপ কমিয়ে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর স্বস্তি আনার উদ্যোগ দরকার ছিল। সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাড়ানো দরকার ছিল। মানুষ খাদ্য অভ্যাস, জীবনযাত্রার ব্যয় কাটছাঁট করে চলছে। সেগুলোতে ফেরত আনতে চাইলে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মুদ্রানীতি দিয়ে সম্ভব না। এর সঙ্গে সহযোগী রাজস্ব নীতির সহযোগিতা দরকার। কিন্তু প্রস্তাবিত বাজেটে সে ধরনের পদক্ষেপ স্পষ্ট নয়। বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বাড়ানোর কিছু লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়েছে। তবে কীভাবে হবে তা স্পষ্ট নেই।
সিপিডি’র নির্বাহী পরিচালক বলেন, জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৬ দশমিক ৮ শতাংশ ধরা হয়েছে। বিনিয়োগ প্রক্ষেপণ অনেক বেশি। চলতি অর্থবছরের সংশোধিত বাজেটে মোট বিনিয়োগ ধরা হয়েছে জিডিপি’র ৩১ শতাংশ। আর প্রস্তাবিত বাজেটে তা ৩৩ শতাংশ প্রাক্কলন করা হবে। এর মধ্যে বেসরকারি বিনিয়োগে ২৭ দশমিক ৩ শতাংশ প্রাক্কলন করা হয়েছে। এ বিনিয়োগ কীভাবে হবে তা বোধগম্য নয়। কি ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে তা স্পষ্ট নয়। সরকারের প্রাক্কলিত বিনিয়োগ লক্ষ্য অর্জনে ৩ লাখ ৪৩ হাজার ৫৪৭ কোটি টাকা বাড়তি লাগবে। কোথা থেকে টাকা আসবে?
প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনা ও ৮ শতাংশ রপ্তানি প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা বাস্তবসম্মত নয় বলেও মন্তব্য করেন ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, মে মাসে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ শতাংশের ওপরে। তাই কোনো লক্ষ্যমাত্রা ছাড়াই এটিকে ৭ শতাংশের নিচে নামিয়ে আনা চ্যালেঞ্জিং হবে। এ বছর রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ছিল মাত্র ২ শতাংশ। অতিরিক্ত ৬ শতাংশ কোথা থেকে আসবে? তিনি বলেন, ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে মূল্যস্ফীতি, জিডিপি প্রবৃদ্ধি, বিনিয়োগের যেসব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে তা অতি উচ্চাভিলাষী ও বাস্তবসম্মত নয়। বাজেটে মূল্যস্ফীতি ৬ দশমিক ৫ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য উচ্চাকাক্সক্ষা ছাড়া কিছুই নয়। এ ছাড়া চলমান অর্থনৈতিক উদ্বেগ মোকাবিলায় যে দৃঢ় পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন, তা ২০২৪-২৫ অর্থবছরের বাজেটে নেয়া হয়নি।
বাজেটে আগামী অর্থবছর শেষে মোট রিজার্ভ প্রাক্কলন করা হয়েছে ৩২ বিলিয়ন ডলার। এটি বাংলাদেশ ব্যাংকের গ্রস হিসাব মন্তব্য করে ফাহমিদা খতুন বলেন, আইএমএফ’র বিপিএম৬ পদ্ধতিতে কতো হবে তা বলা হয়নি। আমরা দেখেছি, বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে গত ৫ই জুন রিজার্ভ ছিল ২৪ দশমিক ২ বিলিয়ন ডলার। অন্যদিকে বাজেটে ডলারের বিনিময় হার ধরা হয়েছে ১১৪ টাকা, যা গত ৫ই জুন ছিল ১১৭ টাকা ৯৫ পয়সা। রিজার্ভ বাড়ানোর লক্ষ্য থাকলেও টাকার মান বাড়ানো হচ্ছে, যা বোধগম্য নয়। সরকার আগামী দিনে ডলারের বিপরীতে টাকার মান বাড়ানোর পরিকল্পনা নিয়ে থাকতে পারে-এমন মন্তব্য করে তিনি বলেন, বর্তমান সংকটের সময়ে টাকার মান বাড়বে কীভাবে তা বোধগম্য না। তিনি বলেন, মূল্যস্ফীতি রোধ ও নিম্ন আয়ের মানুষকে স্বস্তি দিতে বাজেটে যে পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে, তা যথেষ্ঠ নয়। বাজেটে জিডিপি প্রবৃদ্ধি, বেসরকারি ও ব্যক্তিগত খাতের বিনিয়োগে অবাস্তব লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে।
সংবাদ সম্মেলনে সিপিডি’র বিশেষ ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমান এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, যতটুকু মনে আছে, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতিহারের ৩ নম্বর অধ্যায়ে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছিল দুর্বৃত্তায়ন, ঋণখেলাপি, করখেলাপিদের বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স-নীতি ঘোষণা করবেন তারা। কিন্তু এখন যে কালোটাকা সাদা করার সুযোগ দেয়া হচ্ছে, সেটা দলটির নির্বাচনী ইশতিহারের সঙ্গে সম্পূর্ণ সাংঘর্ষিক। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগ ঐতিহ্যবাহী দল। রাজনৈতিক এ দলটি যে দর্শন নিয়ে চলে, তার সঙ্গে বাজেটের এমন পদক্ষেপ বিপরীতমুখী। যিনি করখেলাপ, ঋণখেলাপ করছেন, তাদের সমন্বয়ে বাংলাদেশে দুষ্টচক্র সৃষ্টি হয়েছে। এ দুষ্টচক্রকে কি প্রতিবছর মাথায় হাত বুলিয়ে কিছু সুবিধা দিয়ে কালোটাকা সাদা করে অর্থনীতিতে নিয়ে আসা হবে, নাকি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতিহারে যে দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে জিহাদের ঘোষণা রয়েছে, সেদিকে যাওয়া হবে? বাজেটে তো সেটা আমরা দেখলাম যে কোনদিকে তারা গেলেন। এটা খুবই দুঃখজনক। এটা বন্ধ করা বড় একটি রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আশা করি আওয়ামী লীগের নেতারা এটা করবেন।
কালোটাকা সাদা করার সুযোগের পাশাপাশি দুর্নীতিবাজদের এবার আরও বড় সুযোগ দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগে কালোটাকা সাদা করার পর তা নিয়ে দুদক বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান প্রশ্ন তুলতে বা ব্যবস্থা নিতে পারবে কিনা, তা নিয়ে অস্পষ্টতা ছিল। দেখা গেল-তারা ট্যাক্স দিয়ে টাকা সাদা করে ফেললো, কিন্তু দুদক ধরতে পারতো। এবার কিন্তু সেটাও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। অন্য কেউই এ নিয়ে প্রশ্ন করতে পারবেন না। সিপিডি’র এই সম্মানীয় ফেলো বলেন, কালোটাকা সাদা করার এ নীতি নৈতিকভাবেও অগ্রহণযোগ্য, অর্থনৈতিকভাবেও এটা ফলপ্রসূ না। বছরের পর বছর এ সুযোগ দিয়েও টাকা আসছে না। আমি যদি এখন কর না দেই, কয়েক বছর পর যদি সেটা ১৫ শতাংশ দিয়েই হয়ে যায়, তাহলে এখন কেন দেবো? এ সিন্ডিকেটটা মনে করে এটাও (১৫ শতাংশ) বা কেন দেবো আমি। দেশ থেকে তারা তো টাকা বের করেই ফেলেছে। মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আগামী বাজেটে এমপিদের জন্য গাড়ি আমদানিতে শুল্ক কর বসানোর সুপারিশ করা হয়েছে। তারা কর দিয়ে উদাহরণ হতে পারেন, কৃচ্ছ্র সাধনের সময়ে তাদেরও অংশগ্রহণ হোক।
এবারের বাজেটে সাধারণ মানুষের জন্য খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়াবে বলে মন্তব্য করেছেন সিপিডি’র গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম। তিনি বলেন, বিভিন্ন খাতে নতুন করে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। বছরে চারবার জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি ঘটবে। আর নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানি শুল্কে যে ছাড় দেয়া হয়েছে তা আমদানিকারকদের পকেটে ঢুকে যাবে। এটা থেকে খুব বেশি সুফল আসবে না। ফলে প্রস্তাবিত বাজেট মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের বদলে এটা আরও উস্কে দেবে।
পাঠকের মতামত
আপনার বা আমার কথা সোনার দেশ এটা না। এটা স্মার্ট বাংলাদেশ!