ঢাকা, ২ মে ২০২৪, বৃহস্পতিবার, ১৯ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ, ২৩ শওয়াল ১৪৪৫ হিঃ

প্রথম পাতা

নিয়ন্ত্রণহীন সড়ক-মহাসড়ক

নাজমুল হুদা
১৯ এপ্রিল ২০২৪, শুক্রবার

ঈদের ছুটি শেষে ঢাকায় ফিরছে মানুষ। নিম্ন আয়ের অনেক পরিবারের পক্ষেই বাসের ভাড়া মেটানো কষ্টকর। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এভাবেই ফিরছেন তারা। অনেক সময়ই ঘটছে ভয়ঙ্কর দুর্ঘটনা। বৃহস্পতিবার সকালে ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কের কোনাবাড়ী এলাকা থেকে ছবিটি তুলেছেন জীবন আহমেদ

সড়কে ব্যয় হচ্ছে হাজার হাজার কোটি টাকা। বাস্তবায়ন হচ্ছে একের পর এক বড় প্রকল্প। তারপরও কমছে না সড়ক দুর্ঘটনা। বরং আগের চেয়ে দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি বাড়ছে। পঙ্গুত্ববরণ করেও পরিবারের বোঝা হয়ে বেঁচে থাকছেন অনেকে। সম্প্রতি পরপর দু’দিন দুটি মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় ফের আলোচনায় নিরাপদ সড়ক। মঙ্গলবার ফরিদপুরে বাস ও পিকআপের সংঘর্ষে ১৫ জনের প্রাণহানি ঘটে। পরদিন বুধবার ঝালকাঠিতে অটোরিকশা, প্রাইভেটকারকে পিষে দেয় অতিরিক্ত লোডের ট্রাক। এতেও ১৪ জনের প্রাণহানি ঘটে। পৃথক দু’টি দুর্ঘটনার পরেই সামনে আসে যানবাহন ও চালকের নানা ত্রুটি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নিয়ন্ত্রণহীনভাবে চলছে দেশের সড়ক-মহাসড়ক। এতে সড়কে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়ে দুর্ঘটনা বাড়ছে। নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলোও কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না। রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচালনা এবং নিয়ন্ত্রণ সব ক্ষেত্রে রয়েছে ত্রুটি আর গাফিলতি। দীর্ঘদিন ধরে মহাসড়কে তিন চাকার যান চলাচলে নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। মহাসড়কে দুর্ঘটনার পেছনে অনেক ক্ষেত্রে এমন অবৈধ যানবাহন দায়ী। এ ছাড়া যানবাহনের ফিটনেস না থাকা, অদক্ষ চালকের হাতে ভারী যানবাহন চালানোয় একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটেছে। 

ফরিদপুর সদর উপজেলার কানাইপুরের তেঁতুলতলায় বাস ও পিকআপের সংঘর্ষে ১৫ জনের প্রাণ যাওয়ার পর জানা যায়, দুর্ঘটনায় পড়া বাসটির ফিটনেস সনদ ও রুট পারমিট ছিল না। যে পিকআপের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়েছে সেটি যাত্রী পরিবহন করা হয়েছিল যা একেবারেই নিষিদ্ধ। পিকআপের সেই যাত্রীদের প্রাণহানি ঘটে। আর ঝালকাঠি জেলার গাবখান সেতুর টোল প্লাজায় দুর্ঘটনায় ১৪ মৃত্যুর পর জানা যায়, যে ট্রাকটি অটোরিকশা ও প্রাইভেটকারকে পিষে দেয় সেই ট্রাকের চালকের লাইসেন্স ছিল হালকা শ্রেণির। অর্থাৎ ট্রাক চালানোর লাইসেন্সই ছিল না তার। আর ট্রাকের সক্ষমতার চেয়ে ৭ টন বেশি মাল বোঝাই করা ছিল। 

ঈদের পর এই দু’টি দুর্ঘটনা আলোচনায় আসলেও সড়ক, মহাসড়কে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা। এর অধিকাংশই থাকে আলোচনার বাইরে। বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটির (বিআরটিএ) তথ্য বলছে, গত বুধবার সারা দেশে ১৯টি দুর্ঘটনায় ৩১ জন নিহত হয়েছেন ও আহত হয়েছেন ৪১ জন। তার আগের দিন মঙ্গলবার সারা দেশে ২৪টি দুর্ঘটনায় ৩৭ জন নিহত ও আহত হয়েছেন ৪৯ জন। এ ছাড়া গত সোমবার সারা দেশে ১৯টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২০ জন নিহত, আহত ১৪ জন। রোববার ১৩টি দুর্ঘটনায় ৯ জন নিহত, আহত ২৯ জন। শনিবার ১৮টি দুর্ঘটনায় ২৪ জন নিহত, আহত ১৩ জন এবং ঈদের দিন শুক্রবার ১১টি দুর্ঘটনায় ১১ জন নিহত ও আহত হয়েছেন ৭ জন। বিআরটিএ’র এই হিসাবেই গত ৬ দিনে ১০৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১৩২ জন নিহত ও আহত হয়েছেন ১৫৩ জন। বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০১৬ সাল থেকে ২০২৩ সাল পর্যন্ত ৮ বছরে ঈদুল ফিতরে ১ হাজার ৯৭৮টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২ হাজার ৩০৭ জন নিহত হয়েছে। আহত হয়েছেন ৬ হাজার ২২ জন। একই সময়ে ঈদুল আজহায় ১ হাজার ৮৮৪টি সড়ক দুর্ঘটনায় ২ হাজার ১৬৮ জন নিহত হন। আহত হয়েছেন ৫ হাজার ৬৭৮ জন।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, সড়কে যানবাহন চালাতে হলে রুট পারমিট, নির্দিষ্ট বাহনের জন্য স্বতন্ত্র ড্রাইভিং লাইসেন্স, ফিটনেস সনদসহ বিভিন্ন সরকারি অনুমোদন প্রয়োজন হয়। তবে এসব প্রয়োজনীয় সনদ ছাড়াই সড়কে দেদারছে চলছে যানবাহন। সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকে ম্যানেজ করে এসব যানবাহন সড়কে চলছে। 

বিআরটিএ’র হিসাবে চলতি বছরের মার্চ মাসে সারা দেশে ৬২৪টি সড়ক দুর্ঘটনা ঘটেছে। এসব দুর্ঘটনায় ৫৫০ জন মানুষ মারা গেছেন। আহত হয়েছেন ৬৮৪ জন। অর্থাৎ গড়ে প্রতিদিন ১৮ জন মানুষের মৃত্যু হচ্ছে সড়ক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে। সড়ক দুর্ঘটনা কমাতে এনআরএসসি ২০১৫ সালের ১লা আগস্ট থেকে ২২টি জাতীয় মহাসড়কে নছিমন, করিমন, থ্রি-হুইলার, অটোরিকশা, অটোটেম্পো ও সব অযান্ত্রিক যানবাহন চলাচল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব পায় বিআরটিএ, জেলা প্রশাসন, বাংলাদেশ পুলিশ ও হাইওয়ে পুলিশ। কিন্তু সিদ্ধান্তটি বাস্তবায়িত হয়নি।

বিআরটিএ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সারা দেশে নিবন্ধিত অটোরিকশার সংখ্যা ৩ লাখ ২২ হাজার ৫৮৯। অনিবন্ধিত অটোরিকশার সংখ্যা কারও জানা নেই। সংসদে বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রীর দেয়া হিসাবে ব্যাটারিচালিত রিকশা-ভ্যান ও ইজিবাইকের সংখ্যা ৪০ লাখ। এসবই অবৈধভাবে মহাসড়কে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বিআরটিএ সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে সারা দেশে ৬০ লাখ যানবাহনের মধ্যে ৪৪ লাখের মতো মোটরসাইকেল। এর জন্য কোনো ফিটনেস সনদ দরকার হয় না। বাকি ১৬ লাখ যানবাহনের মধ্যে ৬ লাখ ১৮ হাজারের মতো যানবাহনের ফিটনেস সনদ হালনাগাদ নেই। অর্থাৎ অবৈধভাবে এসব যানবাহন সড়কে চলাচল করছে। গত মার্চ মাসে যেসব দুর্ঘটনা হয়েছে তারমধ্যেও রয়েছে নিষিদ্ধ যানবাহন। মার্চে দুর্ঘটনার শিকার মোটরযানের মধ্যে রয়েছে- জিপ ৩০টি, বাস-মিনিবাস ৯০টি, ট্রাক-কাভার্ড ভ্যান ২০৪টি, পিকআপ ৪০টি, মাইক্রোবাস ১৯টি, এম্বুলেন্স ৪টি, মোটরসাইকেল ২০৪টি, ভ্যান ২৯টি, ট্রাক্টর ৩০টি, ইজিবাইক ৪১টি, ব্যাটারিচালিত রিকশা ৪৪টি, অটোরিকশা ৭২টি ও অন্যান্য যান ১৪৮টিসহ ৯৫৫টি যানবাহন। এরমধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রাণহানি ঘটেছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায়- ১৬১ জন। এরপরই রয়েছে ট্রাক দুর্ঘটনায় নিহতের সংখ্যা ৮৫ জন।

সড়কের দুর্ঘটনা প্রসঙ্গে আক্ষেপের কথা জানিয়েছেন নিরাপদ সড়ক চাই (নিসচা) চেয়ারম্যান ইলিয়াস কাঞ্চন। মানবজমিনকে তিনি জানিয়েছেন, সড়কে দুর্ঘটনা কমানোর জন্য যে পদক্ষেপ নেয়া দরকার তা আমাদের এখানে নেয়া হচ্ছে না। এজন্য দুর্ঘটনাও কমছে না। এগুলো সরকারকে অনেকবার বলা হয়েছে। সেমিনার হয়েছে। তবে তাতে কোনো কাজ হচ্ছে না। সরকার পরিবহন সেক্টরের মতামতকে প্রাধান্য দেয় উল্লেখ করে ইলিয়াস কাঞ্চন বলেন, সরকার ও পরিবহন সেক্টরের লোকদের মধ্যে যে সম্পর্ক, পরিবহন সেক্টরের লোকরা বলে, এই সরকারকে ক্ষমতায় রেখেছে পরিবহন সেক্টরের মানুষ। পুলিশও বলে। তো যারা সরকারকে ক্ষমতায় রেখেছে সরকার তাদের কথা শুনবে নাকি ইলিয়াস কাঞ্চন আন্দোলন করে তার কথা শুনবে?

দুর্ঘটনা কমার জন্য অবকাঠামো উন্নয়নই একমাত্র শর্ত না বলে মনে করেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক শামছুল হক। তিনি মানবজমিনকে বলেছেন, দুর্ঘটনা কমানোর সবচেয়ে বড় শর্ত হচ্ছে রাস্তা যেন সুশৃঙ্খলভাবে পরিচালিত হয় সেই পরিবেশ বজায় রাখা। এই কাজটা করতে হয় দরদ দিয়ে সারা বছর করতে হয়। সড়ক বানানো হয়েছে বৈধ গাড়িগুলো নিরাপদে চলবে, বৈধ ব্যবহারকারীরা নিরাপদে চলবে। কিন্তু সেই সড়কের উপরে বাণিজ্যের প্রসার ঘটালে, হাট-বাজার বসালে, অসঙ্গতিপূর্ণ ব্যবহার করলে সড়কের পরিবেশ বিশৃঙ্খল হয়ে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেল। অবৈধ গাড়িগুলো বৈধ চালকের সঙ্গে চললে, ধীরগতির গাড়ি দ্রুত গতির গাড়ির সঙ্গে চলা শুরু করলে গতির বিশৃঙ্খলা হয়ে গেল। এই বিশৃঙ্খলা একদিনে তৈরি হয়নি। প্রথম দিকে যখন দেখেছে, মহাসড়কে নসিমন-করিমন সরকার নিষেধ করেছে তাও সড়কে চালাতে পারছে। এসব চললেও পুলিশকে কেউ জবাবদিহি করছে না, পুলিশ দায়বদ্ধ না। এভাবে এই ছোট সমস্যা এখন জটিল থেকে জটিলতর হয়ে গেছে।

নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলো কার্যকর কোনো ভূমিকা পালন করছে না উল্লেখ করে অধ্যাপক সামছুল হক বলেন, বিশৃঙ্খলা কোনো সড়কে থাকলে দুর্ঘটনা আমাদের পিছু ছাড়বে না। প্রতিদিন যেখানে সেখানে যাত্রী উঠানো নামানো হচ্ছে। তারমানে নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থাগুলো ঘুমাচ্ছেন। তারা কাজ করছেন না। যারা সুশৃঙ্খল করবেন তারা নিজেদের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন না করলে সরকার যে উন্নয়নের মাধ্যমে যানজট ও দুর্ঘটনা কমাতে চাচ্ছেন এটা অলীক স্বপ্ন। বিজ্ঞান এটাকে সমর্থন দেয় না। বিজ্ঞান বলে, যদি রাস্তাও না থাকে কিন্তু সুশৃঙ্খল পরিবেশ বজায় থাকে তাহলে ওই রাস্তায়ও প্রোডাকটিভি বেশি হবে। রাস্তা সুশৃঙ্খল হবে। এতে দুর্ঘটনাও কম হবে। সরকার মনে করে মেগাপ্রজেক্ট করলে মনে হয় সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। কিন্তু সিস্টেমের মধ্যে এটা একটা ছোট অংশ। বড় অংশটাই হলো রক্ষণাবেক্ষণ, পরিচালনা এবং নিয়ন্ত্রণ। এটা আমাদের দেশে উপেক্ষিত।
 

প্রথম পাতা থেকে আরও পড়ুন

প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরী
জেনিথ টাওয়ার, ৪০ কাওরান বাজার, ঢাকা-১২১৫ এবং মিডিয়া প্রিন্টার্স ১৪৯-১৫০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা, ঢাকা-১২০৮ থেকে
মাহবুবা চৌধুরী কর্তৃক সম্পাদিত ও প্রকাশিত।
ফোন : ৫৫০-১১৭১০-৩ ফ্যাক্স : ৮১২৮৩১৩, ৫৫০১৩৪০০
ই-মেইল: [email protected]
Copyright © 2022
All rights reserved www.mzamin.com